বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১৪

গণতন্ত্রের চাদরে মোড়ানো এক নব্য স্বৈরতন্ত্র


বর্তমান বিশ্বে ক্ষমতা বদলের যতগুলো পন্থা আছে তার মধ্যে সর্ব উত্তম পন্থা হলো গণতন্ত্র। বিভিন্ন কারণে গণতন্ত্র জনগণের মাঝে প্রিয় হয়ে উঠছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো এই ব্যবস্থায় দেশের প্রতিটি নাগরিক নিজের স্বাধীন মতামত পেশ করতে পারেন। তবে এই গণতন্ত্র নিয়েও অনেক কথা আছে। অনেক বিশেষজ্ঞ অবশ্য এটাকে একটা খারাপ শাসন ব্যবস্থা হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। কারণ বেশি মানুষ এক দিকে মতামত দিলেই সেটা ভাল নাও হতে পারে আবার অভিজ্ঞতা ও বাস্তব সম্মত চৌকষ ব্যক্তি সংখ্যায় কম হলেও সেই মতটাই ভাল হতে পারে। অভিজ্ঞ ও জ্ঞানী মানুষ শত অশিক্ষিত মানুষের চেয়ে ভাল হওয়ার কথা, কিন্তু গণতন্ত্র এটাকে সমর্থন করে না। এজন্যই কেউ কেউ বলে থাকেন যে গণতন্ত্র হলো অশিক্ষিত শাসন ব্যবস্থা। তবে অশিক্ষিত মানে মূর্খ নয়। সে যাই হোক আর যে যাই বলুক বর্তমান বিশ্বে ক্ষমতা পরিবর্তনের জন্য এর চেয়ে উত্তম ব্যবস্থা সম্ভবত আর একটি নেই।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা লক্ষণীয়। বাংলাদেশের মানুষের কাছেও গণতন্ত্র জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মূলত বাংলাদেশের জন্মই হয়েছে গণতন্ত্রের বিকাশ সাধনের জন্য। সেই হিসেবে বলা যায় বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখনও তরুণ পর্যায়েই রয়ে গেছে কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই অবস্থাতেই তরুণ গণতন্ত্রের টু’টি চেপে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা আমাদের সংবিধানে গণতন্ত্রের কথা খুব সুন্দর করে ব্যক্ত করেছি ঠিক কিন্তু তা অনেকটা সংবিধান পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। আমাদের সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, সেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।”
এই অনুচ্ছেদে মূলত চারটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে (১) মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা (২) মৌলিক স্বাধীনতা (৩) মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত করণ (৪) প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এর সবগুলিই আজ চরমভাবে ভূলুন্ঠিত। আজকে মানবাধিকার কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। যদি আমার মতের পক্ষে হয় তবেই সেটা মানবাধিকার আর যদি আমার মতের বিরুদ্ধে যায় তাহলে সেটা মানবাধিকার লঙ্ঘন। সমগ্র বিশ্বে প্রায় একই অবস্থা। আজকে যদি আমরা ফিলিস্তিনের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব-সেখানকার অসহায় আর নির্যাতিত মানুষেরা যখন জালিমশাহী ই¯্রাইলের সৈন্যবাহিনীর দিকে ঢিল ছুঁড়ে মারছে তখন সেটা হয় মানবাধিকার লঙ্ঘন বা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড কিন্তু ইস্রাইলী সৈন্যরা যখন ফিলিস্তিনিদের দিকে গুলী ছুঁড়ে তখন নাকি সেটা হয় আত্মরক্ষা! বর্তমান বাংলাদেশেও ঠিক একই অবস্থা। বিরোধীদলের নেতা কর্মীরা যখন মজলুম অবস্থায় নিরুপায় হয়ে ঢিল ছুঁড়ে তখন সরকার কর্তৃক লেলিয়ে দেয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকার পন্থিরা সেটার জবাব দেয় বন্দুকের নল দিয়ে। আর এভাবে তারা শত শত বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীকে হত্যা করেই চলছে। বিরোধী দল যেটা করছে সেটা মানবাধিকার লঙ্ঘন আর সরকারি দল যেটা করছে সেটা মানবাধিকার সংরক্ষণ! মানুষের মানবিক মর্যাদা আজকে ধুলোর সাথে মিশে গেছে। স্বাধীনতা আজকে সোনার হরিণ। আশঙ্কা নিয়েই মানুষ ঘর থেকে বের হয় আর আশঙ্কাসহই ঘরে ফেরে। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় ভাবে হয়তো জীবিত আর ঘরে ফেরা নাও হতে পারে। অন্যদিকে ঘরে থাকলে যে কোন সময় খুন বা অজ্ঞাত কারণে গ্রেফতার হওয়া লাগতে পারে। সব মিলিয়ে কোথাও তিনি স্বাধীনতা অনুভব করেন না। অথচ গণতন্ত্রের অন্যতম বিষয়ই হলো মৌলিক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা।
অজ্ঞাত কোন কারণে এক একজন গ্রেফতার হচ্ছে, তারপর তার কাছে বড় মাপের একটা টাকার অংক চাওয়া হচ্ছে যদি তা দিতে পারে তাহলে হয়তো মুক্তি নয়তো তথাকথিত ক্রসফায়ার বা অমানবিক নির্যাতন অথবা জেল। আজকে কাউকে গ্রেফতার করতে কোন প্রমাণ বা মামলা অথবা সময় লাগে না। যে কোন সময় যে কোন কাউকে ইচ্ছে হলেই গ্রেফতার করা যায়। এক আজব অবস্থা আর গ্রেফতার করার পর শুধু দিনের পর দিন নয়, মাসের পর মাসও কোর্টে না তুলে বন্দিকে নিয়ে তথাকথিত অভিযান চালানো হয় যা সম্পূর্ণ সংবিধানবিরোধী। কারণ আমাদের সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদের (১) এ বলা আছে “গ্রেফতারকৃত কোন ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেফতারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাঁহার দ্বারা আত্মপক্ষ-সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না।” অথচ বর্তমানে এর কোন পরোয়াই করা হয় না।
আবার অনুচ্ছেদ ৩৩ এর (২) এ বলা হয়েছে “গ্রেফতারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে গ্রেফতারের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে (গ্রেফতারের স্থান হইতে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আনয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ব্যতিরেকে) হাজির করা হইবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাহাকে তদতিরিক্তকাল প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না।” অথচ এর কোনটাই সঠিকভাবে করা হচ্ছে না, এটা কি কোন অবস্থাতেই মেনে নেয়া যায়?
বলা হলো নির্বাচন করতেই হবে নয়তো সংবিধান অমান্য করা হবে, আর এই নির্বাচন হবে বর্তমান সরকারের অধীনেই। অথচ জনগণ বললো ভিন্ন কথা। জনগণ বললো যে, না ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নয় নির্বাচন করতে হবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। এ নিয়ে অনেক মিডিয়া জরিপ চালালো, সেই জরিপের মাধ্যমে উঠে আসলো প্রকৃত চিত্র। বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো জরিপ চালালো যে কত ভাগ মানুষ বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন চায় আর কত ভাগ চায় নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম যে দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায় (প্রথম আলো ৫ নভেম্বর’১৩)। কিন্তু শাসক গোষ্ঠী সেই জনগণের কথা মানলেন না।
যেহেতেু তাদের হাতে শক্তি আছে সেহেতু অন্য যে যাই বলুন তাতে কিছু যায় আসে না, নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করে জনগণকে ঠ্যাঙ্গানোর মধ্য দিয়ে হলেও নির্বাচন করতেই হবে, এ বিষয়ে সংবিধানে কি বলা আছে বা হলো তাতে কোন যায় আসে না। সহজভাবে বললে বলা যায় নিজের মতকে দাঁড় করানোর জন্য সংবিধানকে যদি ছিঁড়তে হয়- ছেঁড়া হবে, কাটতে হয় কাটা হবে, ল্যাঙ মারতে হয় তবে তাই করা হবে এরপরও নিজের অসুবিধা হবে এমন কাজ করা যাবে না! তাহলে এমন সংবিধানের দরকারটা কি। যখন যেই গোষ্ঠী শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবেন তাদের কথায় আমরা চললাম। শাসকরা উঠতে বললে আমরা উঠবো আর বসতে বললে বসবো এমনটা করাই তো মনে হয় ভাল।
অবশ্য এটা শুধু বাংলাদেশে নয় বরং অনেক দেশেই লক্ষ্য করা যায়। আমরা দেখলাম মিসরে এককভাবে মুসলিম ব্রাদারহুড ৫১ ভাগের বেশি জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর বহির্বিশ্বের ষড়যন্ত্রে সেনাবাহিনী ক্ষমতা ছিনিয়ে নিল আর এখন পর্যন্তও সেটা কুক্ষিগত করেই রেখেছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো এখন পর্যন্তও কোন গণতান্ত্রিক দেশ এর বিরুদ্ধে শক্ত কথা বলে নাই। অথচ মিসরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই ক্ষমতার পালা বদল ঘটেছিল। আর মজার বিষয় হলো গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা আমেরিকা মিসরের এই অবস্থা দেখেও নিলর্জ্জভাবে বললো যে, মিসর গণতন্ত্রের দিকেই এগুচ্ছে! যেখানে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হলো সেই অবস্থা দেখেও তারা এমন বাজে কথা বলতে পারলো! যেহেতু সেখানে ইসলামপন্থিরা ক্ষমতায় সেহেতু তারা গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতায় গেলেও সেটা গণতন্ত্র নয় আর সেনা কর্মকর্তারা যেহেতু আমেরিকার পা চাটা গোলাম সেহেতু তারা যাই করুক না কেন সেটাই গণতন্ত্র যদিওবা সেনাবাহিনী ব্রাদারহুড পন্থি হাজার হাজার নেতা কর্মীকে নির্মমভাবে গুলী করে হত্যা করছে! হায়রে গণতন্ত্র!
বাংলাদেশের অবস্থাও আজ এর চেয়ে কম নয়! বিরোধী দলকে ঠ্যাঙ্গানোর জন্য যত রকম পন্থা অবলম্বন করা দরকার বর্তমান সরকার সেটাই করতে প্রস্তুত। যদি কাউকে মারতে হয় মারবে, গুম করতে হয় গুম করবে, হুমকি-ধমকি বা ভয় ভীতি দেখাতে হয় তবে তাই করবে, মামলা দিয়ে বাড়ি ছাড়া বা জেলে দিতে হয় তবে তাই করা হবে অর্থাৎ যখন যা করা প্রয়োজন তাই করা হবে এরপরও ক্ষমতায় টিকে থাকতে হবে।
বিরোধী দলকে ভালভাবে কোন কর্মসূচী পালন করতে দেয়া হচ্ছে না। সভা-সমাবেশতো দুরের কথা একটা মানববন্ধন পর্যন্ত করতে দেয়া হচ্ছে না। এমনকি দলীয় অফিসগুলো পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অফিসের ভিতরে বসেও যদি কোন বৈঠক করা হয় তাহলে সেটাও নাকি নাশকতার পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত। আর এই অবস্থায় এমনকি অফিস ভেঙ্গে হলেও সেখান থেকে বিরোধী দলের নেতা কর্মীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে।
অথচ আমাদের সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে “জনশৃঙ্খলা বা জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তি সঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।”
এসব বিষয় থেকে এটা স্পষ্ট যে বর্তমান সরকার আমাদের সংবিধানের বিরুদ্ধে কাজ করছেন। আর এই কথাগুলো বলতে গেলেই হয় জেলে যেতে হবে নয়তো আপনার বাড়ি-ঘর গুড়িয়ে দেয়া হবে। আমি বুঝি না আসামী ধরার সাথে বাড়ি-ঘর ভেঙ্গে দেয়ার সম্পর্কটা কি?
তাহলে যেখানে জনগণ বা বিরোধী দলকে সহ্যই করা হচ্ছে না আর সংবিধানকে করা হচ্ছে থোরাই কেয়ার তাহলে সেখানে গণতন্ত্র আছে বলে যদি কেউ দাবী করে তাহলে সেটা কিভাবে মানা সম্ভব? এটা হলো “মুখে গণতন্ত্র আর মনে স্বৈরাচার” অবস্থা। স্বৈরতন্ত্রের যতগুলো বৈশিষ্ট্য আছে বর্তমান সময়ে তার প্রত্যেকটিই মিলে যায়।
উইকিপিডিয়ায় স্বৈরতন্ত্রের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তা এমন “স্বৈরতন্ত্র হচ্ছে একজনের শাসন। স্বৈরতন্ত্র হচ্ছে কোন বিশেষ ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারিতা যিনি সে দেশের জনগণ, সংবিধান আইনের রীতি-নীতি অগ্রাহ্য করে এককভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং তার একক নির্দেশনায় দেশকে শাসন করে তাকে স্বৈরচারিতা বলা হয়। যখন রাষ্ট্রে এক ব্যক্তির ক্ষমতার মাধ্যমে সকল কাজ সম্পন্ন হয় তাই স্বৈরশাসন। যে ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা নেতা অগণতান্ত্রিক বা জোর করে ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে তার অধীনস্থ করে রাখে।”
এই সবগুলো বিষয় ধারাবাহিকভাবে সাজালে এটাই প্রতীয়মান হয় যে বর্তমানে আমাদের দেশে গণতন্ত্রের তেমন বালাই নেই বরং এখানে চলছে গণতন্ত্রের আবরনে বা চাদরে মোড়ানো এক নব্য স্বৈরতন্ত্র। আমরা যদি সচেতন হয়ে এই স্বৈরতন্ত্রকে উৎখাত করতে না পারি তাহলে নির্ঘাত আগামী দিনে এর জন্য আমাদেরকে অনেক বড় মাশুল দিতে হতে পারে। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads