শনিবার, ৪ জানুয়ারী, ২০১৪

চূড়ান্ত হাসি বিরোধী দলই হাসবে


বিরোধ যখন তুঙ্গে ওঠে, ঠিক তখন নেতৃত্ব প্রকাশের সময়। মানুষের বিপদে যে সামনে এসে দাঁড়ায়, তাকে মানুষ নেতার মর্যাদা দেয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সেই বিভীষিকাময় রাতে নিরীহ মানুষকে বিপদের মধ্যে ফেলে রেখে নেতারা পালিয়েছিলেন, সেই দিন জিয়াউর রহমান মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন; একজন মেজর থেকে তিনি রাষ্ট্রনায়ক হয়েছেন, হয়েছেন কোটি কোটি মানুষের নেতা। তিনি জেল-জুলুম ও জীবনের পরোয়া করেননি। জেল রাজনীতির একটি অংশ, জেল নেতাদের আরেক আবাসন; যারা রাজনীতি করেন, মানুষের জন্য কাজ করেন তারা জেলকে ভয় করেন না। জেলকে ভয় করলে নেলসন ম্যান্ডেলা পৃথিবীর অবিসংবাদিত নেতা হতেন না। এই মহাপুরুষ প্রায় তিন যুগ জেলে কাটিয়েছেন। জেল তার জন্য বয়ে এনেছে সৌভাগ্য, তিনি ইতিহাসে নিজের নামই শুধু লিখে যাননি; ইতিহাস সৃষ্টিতেও রেখে গেছেন সুস্পষ্ট অবদান। কাজেই জেলের ভয়ে রাজনীতিকেরা পালিয়ে থাকতে পারেন না, তা হলে ইতিহাসে তারা রাজনীতিবিদ হিসেবে স্থান করে নিতে পারবেন না।

বাংলাদেশের মানুষের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে এক অত্যাচারী শাসক। এ সরকার কেড়ে নিয়েছে মানুষের সকল গণতান্ত্রিক অধিকার। দমনপীড়ন, জেল-জুলুম ও অত্যাচার-নির্যাতনে তারা সৃষ্টি করেছে এক কলঙ্কজনক ইতিহাস। চলমান সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রীকে গৃহবন্দী করে, আরেকটি রাজনৈতিক দলের প্রধানকে অসুস্থতার কথা বলে সিএমএইচে ভর্তি করে ও অন্য আরেকটি রাজনৈতিক দলের প্রায় সব শীর্ষ নেতাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে কথা বলে জেলে আটকে রেখে এবং সব পেশাজীবী সংগঠন, বিশিষ্ট নাগরিক ও জাতিসঙ্ঘসহ বিশ্ব নেতাদের অনুরোধ ঊপো করে ভোটবিহীন, প্রার্থীবিহীন এক হাস্যকর ও তামাশার নির্বাচনের নাটক মঞ্চস্থ করছে। মানুষ অসহায়ের মতো চেয়ে তা দেখছেন আর ক্রোধে ফুঁসছেন, তাদের পাশে কোনো নেতৃত্ব নেই; যারা মাঠে থেকে এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কথা, তারা আছেন আত্মগোপনে। এ কারণে রাজনীতির মাঠ কর্মী শূন্য হয়ে পড়েছে।

সত্য কথা বলতে ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে এবং ন্যায়ের পে অবস্থান নিতে গিয়ে যদি কোনো রাজনীতিবিদকে জেলে যেতে হয়, তা হলে সেই জেল অবশ্যই সৌভাগ্যের। পলায়নপর মন নিয়ে কোনো গণ-আন্দোলন হয় না, বরং আন্দোলন আরো তিগ্রস্ত হয়, কর্মীরা নিরুৎসাহিত হয়ে মাঠ ছেড়ে দেন; বর্তমান পরিস্থিতিতেও আমরা তাই দেখছি, নেতাদের আত্মগোপনের কারণে একটি গণ-আন্দোলন নিশ্চিত তিগ্রস্ত হয়েছে। তবে কোনো গণদাবি পরিত্যক্ত হয়েছেÑ এমন নজির ইতিহাসে নেই। বিএনপির নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি নিরেট গণদাবি। রাজপথে জনগণ এ দাবি আদায় করেই ছাড়বে, জয় তাদেরই হবে; তারাই চূড়ান্ত হাসি হাসবে।

রাজনীতিতে সিদ্ধান্তহীনতা বলতে কোনো বিষয় নেই। রাজনীতিবিদেরা কোনো সময় সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন না। কেননা রাজনীতিতে সিদ্ধান্তহীনতার পরিণাম কোনো দিন ভালো হয় না। রাজনীতিতে সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে, রাজনীতিবিদদের চরম মূল্য দিতে হয়। কোন কাজটি এ মুহূর্তে করতে হবে, কোনটির জন্য করতে হবে অপোÑ রাজনীতিতে এটি নির্ধারণ করা জরুরি। বিরোধ যখন তুঙ্গে ওঠে, তখনই নেতৃত্ব প্রকাশের সময়। এ সময় নেতৃত্বের আত্মগোপন রাজনীতিতে অবধারিত পরাজয় ডেকে আনে। প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে যারা নেতৃত্ব দিতে পারেন, তারাই নেতৃত্বের কঠিন পরীায় উত্তীর্ণ হন; ইতিহাস তাদের গলায় নেতৃত্বের মালা পরায়। 

একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছে দেশের চলমান রাজনীতি। জাতীয় নেতৃবৃন্দকে পাইকারি হারে মামলায় জড়ানো হচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে দমনে সরকার আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করার নগ্ন কৌশল দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তুলবেÑ এতে কোনো সন্দেহ নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার দমনপীড়ন চালিয়ে বিরোধী দলকে সম্পূর্ণ দুর্বল করতে চাচ্ছে; যাতে বিরোধী দল কোনো কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারে। 

কথায় বলে, নিজের সম্মান বা মর্যাদা না থাকলে অন্যকেও সম্মানিত করা যায় না; বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে তার বাসভবনে গৃহবন্দী করে রেখেছে বর্তমান শাসক। সরকারের ইজ্জত-সম্মানবোধ থাকলে, এহেন ন্যক্কারজনক আচরণ প্রতিপ শীর্ষ রাজনীতিকের ওপর করার আগে তারা শতবার চিন্তা করত। আত্মসম্মানবোধহীন এক দুর্বল সরকারের প্রতিচ্ছবিই ফুটে উঠেছে সরকারের এ আচরণে!

কাজেই এ অবস্থায় নেতাদের আত্মগোপন কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত নয়; কেননা তাতে আন্দোলনের গতি ধরে রেখে রাজনৈতিক ফসল ঘরে তোলা বিরোধী জোটের জন্য নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জ! সরকার আন্দোলন দমাতে চূড়ান্ত কৌশল হিসেবে ন্যক্কারজনক পথের আশ্রয় নিয়েছে, এখানে তাদের জন্য একটি যুক্তি আছে; মানুষ শেষ রার জন্য অনেক কিছুই করে। কিন্তু বিরোধী দলের মামলার ভয়ে আত্মগোপনে যাওয়ার কোনো যুক্তি নেই। কেননা দেশের মানুষের সেন্টিমেন্ট তাদের প।ে আন্দোলনের গতিকে একটি যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে জেল অবশ্যই রাজনীতির একটা কৌশল। এ কৌশলে আন্দোলন আরো চাঙ্গা হয়, নেতাকর্মীদের মনোবল বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এখন হয়েছে ঊল্টো, নেতাদের আত্মগোপনের কারণে মাঠ হয়ে পড়েছে কর্মীশূন্য।

আওয়ামী লীগ সময়-সুযোগ বুঝে রাজনীতিতে অভিনব কৌশল প্রয়োগ করে প্রতিপকে ঘায়েল করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে। একটির পর একটি ইস্যু তারা তৈরি করে রাজনীতিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে। তাতে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও তারা উপকৃত হয়। যুদ্ধাপরাধের তাদের তৈরী ইস্যু। এটিকে তারা জিইয়ে রেখেছে বিরোধী দলকে ঘায়েল করতে। তারা যথাসময়ে এটি ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা তুলে নিচ্ছে।

দেশে বেপরোয়া বন্দুকের ব্যবহার চলছে। মতায় থাকা ও মতায় যাওয়ার উৎস হিসেবে বন্দুককে বেছে নেয়া হয়েছে। কিন্তু বন্দুকের নল মতার উৎস নয়, মতার উৎস হচ্ছে জনগণ; জনগণের ওপর গুলি ও দমনপীড়ন চালিয়ে কেউ মতায় থাকতে পারেনি। পুলিশ শুধু মানুষের ওপর গুলিই চালাচ্ছে না, সন্ত্রাসী কায়দায় ন্যক্কারজনক ও অকল্পনীয়ভাবে দখল করে নিচ্ছে রাজনৈতিক দলের কার্যালয়। বিএনপির প্রধান কার্যালয় আজ পুলিশের দখলে। অপেশাদারিত্ব ও দলবাজির এক ভয়াল চেহারা ফুটে উঠেছে পুলিশের এই ন্যক্কারজনক আচরণে। পুলিশের এমন বেপরোয়া আচরণ অতীতে ল করা যায়নি। পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে, এর পেশাদারিত্ব ও ঐতিহ্য নষ্ট করে দেয়া হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের মতো একটি ফ্যাসিবাদী চরিত্র সম্পন্ন দলের কাছ থেকে কোনো রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করতে হলে দলটিকে রাজনৈতিক চাপে না ফেলে তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। রাজনৈতিক েেত্র চুল পরিমাণ ছাড়ও শাসকদল বিরোধীদলকে দিচ্ছে না! উল্টো হামলা-মামলা, গুম-গ্রেফতার করে এবং বিভিন্ন নন-ইস্যুকে রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়ে সারাণ বিএনপিকে ভয়ানক তটস্থ ও প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রেখেছে শাসকদল। বিএনপির নেতাকর্মীরা পালিয়েও বাঁচতে পারছেন না! বাঁচতে পারছে না জোটের অন্যান্য দলের নেতাকর্মীরাও! এহেন অবস্থায় মাঠকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে রাজপথে নেতাদের উপস্থিতি অপরিহার্য।

চলমান আন্দোলন অস্তিত্ব রার আন্দোলন। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা গ্রাম-গঞ্জ-পাড়া-মহল্লায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, তাদের সাথে বিএনপির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের শক্ত অবস্থানের ফলে সরকার কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। একতরফা নির্বাচন করতে গিয়ে তারা শুধু জনগণ থেকেই নয়, গোটাদুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। একতরফা নির্বাচন তাদের করুণ পরিণতি ডেকে আনবেÑ এতে কোনো সন্দেহ নেই। এরই মধ্যে ভারতের সুর বদলে গেছে। ভারতের পত্রপত্রিকাগুলো বাংলাদেশের একতরফা নির্বাচনের কুফল নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। তাতে ভারতের প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে। তারা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে ভিন্ন মূল্যায়ন করতে শুরু করেছে। ফলে হাসিনার সরকার ঊভয় দিক দিয়ে এক মারাত্মক চাপে পড়তে যাচ্ছে। রাজপথে বিরোধী দলের শক্ত অবস্থান বজায় থাকলে, সরকার মাথা নত করতে বাধ্য হবে এবং চূড়ান্ত হাসি বিরোধী দলের নেতাকর্মীরাই হাসবেন। 


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads