বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৪

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন : কে জিতল কে হারল?


ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন

গত ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে একটি ভোটারশূন্য, প্রার্থীবিহীন, সহিংস ও ভোট কারচুপির দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। ৫ জানুয়ারি যা ঘটেছে তাকে নির্বাচন না বলে আওয়ামী লীগের মনোনীত একদলীয় সংসদ প্রতিষ্ঠার নাটক বললে অত্যুক্তি হবে না। এই নির্বাচনী নাটকে দেশের জনগণ, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জোট সরকার, বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী দল, নির্বাচন কমিশনসহ সব মহলেরই পরাজয় ঘটেছে। গত ২১ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে লন্ডনভিত্তিক প্রভাবশালী সাময়িকী দি ইকোনমিস্ট অগ্রিম মন্তব্য করেছিল, ‘বাংলাদেশে দশম নির্বাচনে সরকারি দল জিতবে আর হারবে বাংলাদেশ (The Ruling party will win in Bangladesh election, the Bangladesh will loose)৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দেখা গেল, শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রকৃতপে সব মহল বিশেষ করে গণতন্ত্র পরাজিত হয়েছে। 

যেকোনো নির্বাচনে বা খেলায় কে হেরেছে, কে জিতেছে তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবে সবারই কৌতূহল থাকে। কিন্তু দশম নির্বাচনের পর এ নিয়ে কারো কোনো কৌতূহল দেখা যায়নি। দেশে-বিদেশে এ নির্বাচন নিয়ে যেরূপ বিরূপ সমালোচনা হয়েছে, তা অতীতে কোনো নির্বাচনে এমনটি হয়নি। সরকারের দাবি, প্রধানমন্ত্রীর কথা মোতাবেক একটি নিয়ম রার নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। নবম সংসদের মেয়াদকাল অতিক্রম করার আগে প্রশ্নবিদ্ধ শপথ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দশম সংসদকে কার্যকর করে নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের মাধ্যমে তারা সফল হয়েছেন। বিরোধী দলের দাবি, বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে জনগণ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন বর্জন করেছে। দেশের ৯৫ শতাংশ ভোটার ভোট কেন্দ্রে যায়নি। ১৫৩টি আসনে সরকারদলীয় প্রার্থী ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নেননি। তাই বিরোধী দলের আন্দোলন সফল হয়েছে। আসলে কোন পক্ষ সফল হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। সময়ই বলে দেবে আসলে কী হয়েছে। একটি খেলায় প্রতিপ খেলোয়াড়ের অনুপস্থিতে ওয়াকওভারপেয়ে ট্রফি জিতে খেলার সমাপ্তি ঘটানো সম্ভব। কিন্তু একটি জাতীয় নির্বাচনে ৫ জানুয়ারির মতো ওয়াকওভারপেয়ে সংসদ গঠনের পর দেশের যে সঙ্কট বিদ্যমান ছিল, তা আরো ঘনীভূত হয়েছে।

বিরোধী দল ও জনগণের বর্জনের মধ্য দিয়ে যে নির্বাচনী নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে, তাতে অতীতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের সব রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে। ৩০০ আসনের সংসদে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৫৩ আসনে ভোট ছাড়া সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে সর্বকালের রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। অবশিষ্ট ১৪৭ আসনে জোটের অংশীদারদের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে পাতানো প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখানো হয়েছে। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীরা নিজ দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের সাথে পাতানো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। বিরোধী দল হিসেবে দশম সংসদে যে দলকে স্থান করে দেয়া হয়েছে, তাদের প্রার্থীদের নির্বাচিত করার জন্য আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নির্বাচনী প্রচারণা এবং সিল মারার দায়িত্ব পালন করেছে। এ নির্বাচনে প্রার্থীসংখ্যা ছিল অতীতের সব নির্বাচনের সর্বনিম্ন রেকর্ড। সর্বমোট ৫৪০ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৫৩ জন ভোট ছাড়া নির্বাচিত হওয়ার পর ১৪৭ আসনে মাত্র ৩৯০ জন প্রার্থীর মধ্যে পাতানো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে।

দশম সংসদের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর বিরোধী দলের দাবির পাশাপাশি দেশের সুশীলসমাজসহ ৯০ শতাংশ জনগণ এবং জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তফসিল বাতিল করে সমঝোতার মাধ্যমে সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য মতামত প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সব দাবি ও মতামতকে উপো করে সংবিধানের দোহাই দিয়ে বা নিয়ম রক্ষার্থে যে নির্বাচনটি একতরফাভাবে অনুষ্ঠান করা হয়েছে, তাতে দেশের জনগণ ও বিশ্বসমাজ বিস্মিত ও হতাশ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের মাঠখালিবলে যে মন্তব্য করেছিলেন, তার বাস্তব চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে নির্বাচনের দিনে ভোটারশূন্য ভোটকেন্দ্রগুলোতে। নির্বাচন কমিশন ভোটার উপস্থিতি সম্পর্কে সারা দিন নীরবতা পালন করেন। অথচ বিগত নির্বাচনগুলোতে নির্বাচনের দিনে নির্বাচন কমিশন সারা দেশে ভোটার উপস্থিতির তথ্য প্রতি ঘণ্টায় সাংবাদিকদের অবহিত করেছেন। ভোটগ্রহণের দুই দিন পর পত্রিকায় দেখা গেল, ১৩৯টি আসনে ভোটার উপস্থিতি ৪০ দশমিক ৫৬ শতাংশ দেখানো হয়েছে। এ তথ্য কারো কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। যেসব এলাকায় নির্বাচন হয়েছে, সেসব এলাকার মানুষের মুখে একই কথা- এত ভোট এলো কোত্থেকে?’

অতীতে সব নির্বাচনে দেশী ও বিদেশী হাজার হাজার পর্যবেক নির্বাচন পর্যবেণ করেছেন। কিন্তু এ দশম সংসদ নির্বাচনে পূর্বঘোষণা দিয়েই দেশী ও বিদেশী পর্যবেক ভোট পর্যবেণ করবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছিল। ভারত ও নেপাল থেকে চারজন এবং দেশীয় সংস্থা ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্স (ফেমা) ও মানবাধিকার কমিশনের প থেকে কিছুসংখ্যক পর্যবেক নির্বাচন পর্যবেণ করেছেন। মানবাধিকার কমিশনের পর্যবেণ প্রতিবেদনে জানা যায়, ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটার ছিল খুবই স্বল্পসংখ্যক। সারা দেশে ১০ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছে বলে প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, আতঙ্ক, উদ্বেগ, প্রতিরোধ, ভোট জালিয়াতি, হামলা ও বোমাবাজির মধ্য দিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ হয়েছে। ফেমার প্রধান মুনিরা খান জানান, নির্বাচনে সব মিলিয়ে ১০ শতাংশেরও কম ভোট পড়েছে। বেসরকারি টিভি চ্যানেল-২৪-এ এক আলোচনায় তিনি এ কথা বলেন। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় দশম নির্বাচনকে সহিংস, ভোটারশূন্য ও বিতর্কিত বলে মন্তব্য করেছে। ভোটার নেই, পর্যবেকেরও দেখা নেই’- এমন শিরোনামে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। আন্তর্জাতিক মিডিয়া আলজাজিরা, সিএনএন, এনডিটিভি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ভারতের দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়া, দি হিন্দু, আনন্দবাজার এবং বার্তা সংস্থা রয়টার্স, এএফপিসহ বিশ্বের সব গণমাধ্যম বাংলাদেশের এ নির্বাচনকে ভোটারশূন্য, সহিংস ও বর্জনের নির্বাচন বলে তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। নির্বাচনের পরের দিনে প্রকাশিত বাংলাদেশের সব জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম পর্যালোচনা করলে এটি পরিষ্কার যে, দশম সংসদ নির্বাচন দেশে ও বিদেশে কোনো মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। 

দশম নির্বাচনে আরো যে কয়েকটি রেকর্ড স্থাপিত হয়েছে, তার মধ্যে আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের শরিক দলসহ সর্বনিম্ন ১২টি দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ, নির্বাচনের দিনে কারচুপি ও ভোটকেন্দ্র দখল করে সিল মারার অভিযোগে প্রায় অর্ধশত প্রার্থীর নির্বাচন বর্জন, ৪৩৬টি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত, আটটি আসনের ভোট বন্ধ ও ৬০টি কেন্দ্রে শূন্য ভোটারের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে যে পরিমাণ সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ভোটের দিনে সহিংসতায় মৃত্যু হয়েছে ২২-২৫ জন। যে নির্বাচনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ভোটার উপস্থিতি ছিল না, সে রকম একটি পাতানো নির্বাচনে এত সহিংসতা কোনো মানদণ্ডেই গ্রহণযোগ্য নয়। নির্বাচনকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সহিংসতা রোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় দেশের ভাবমূর্তি খর্ব হয়েছে। 

৫ জানুয়ারি নির্বাচনে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ভোটারের সর্বনিম্ন উপস্থিতি, এটি নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। ১৫৩টি আসনের চার কোটি ৮০ লাখ ২৭ হাজার ৩৯ জন ভোটার এ নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। অবশিষ্ট ১৪৭ আসনের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি সম্পর্কে ফেমা ও মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদন এবং দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমে উপস্থাপিত ১০-১২ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি সম্পর্কে কারো কোনো সন্দেহ নেই। এ হিসাবে ১৫৩ আসনে শূন্য (০) শতাংশ এবং ১৪৭ আসনের ১০-১২ শতাংশের গড় অর্থাৎ মোট ৩০০ আসনে মোট ভোটারের কম-বেশি ৫ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে কেন্দ্রে উপস্থিত হয়েছিলেন। প্রকৃতপে সারা দেশে মোট ভোটারের ৯৫ শতাংশ ভোটার নির্বাচন বয়কট করেছেন। নির্বাচন কমিশনের তথ্য মোতাবেক আটটি স্থগিত আসন বাদে ১৩৯ আসনে ৪০ দশমিক ৫৬ শতাংশ ভোট পড়েছে। দেশের ৩০০ আসনের মোট ৯ কোটি ১৯ লাখ ৬৫ হাজর ৯৭৭ ভোটারের মধ্যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ইসি প্রদত্ত তথ্য মোতাবেক এক কোটি ৬৫ লাখ ৩৫ হাজর ৯৪৪ জন ভোটার ভোট দিয়েছেন। এ হিসাবে দেশের মোট ভোটারের মধ্যে ১৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ ভোটারকে এ নির্বাচনে উপস্থিত দেখানো হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের দেখানো ১৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ বা প্রকৃত গড়ে ৫ শতাংশ উপস্থিতি ধরা হোক না কেন, মোটকথা ৫ জানুয়ারির নির্বাচন জনগণ বর্জন করেছে। এর মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। ভোটার উপস্থিতির দিক থেকে এ নির্বাচন সর্বনিম্ন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে এবং গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় গণতন্ত্র ন্যক্কারজনকভাবে পরাস্ত হয়েছে। 

নৈতিকতার বিবেচনায়ও ৫ জানুয়ারি নির্বাচন সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযেগ্য। ভোট ছাড়া নির্বাচিত ১৫৩ সংসদ সদস্যকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, তারা কে কত ভোট বা কত শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন? নিঃসন্দেহে তারা কোনো উত্তর দিতে পারবেন না। অবশিষ্ট ১৪৭ জন যে ভোটারবিহীন নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, তাদের প্রাপ্ত ভোটের কত শতাংশ প্রকৃত ভোটার ভোট দিয়েছেন এবং কত ভাগ সিল মারা হয়েছে- তারাও সদুত্তর দিতে পারবেন না। দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও এ নির্বাচনের প্রার্থী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা: এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং সরকার কর্তৃক নিয়োজিত বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদসহ দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ কে কোথায় ভোট দিয়েছেন, তার কি উত্তর কেউ দিতে পারবেন? এ ধরনের একটি তামাশার নির্বাচন নৈতিকভাবে কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। 

গত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মহাজোটের শরিক দল জাতীয় পার্টিকে নিয়ে যে নগ্ন নাটকের অবতারণা করা হয়েছে, তা গণতন্ত্রের জন্য একটি কলঙ্কজনক ঘটনা। এরশাদ নির্বাচন বর্জন করার ঘোষণা দেয়ার পর রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে তাকে ও তার দলকে যেভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানো হয়েছে, তাও নজিরবিহীন। পরে সরকার এরশাদকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত, জাতীয় পার্টি থেকে কয়েজনকে মন্ত্রীর পদ প্রদান এবং বেগম রওশন এরশাদকে বিরোধী দলের নেতা নিয়োজিত করে একটি অদ্ভুত চরিত্রের সংসদ ও সরকার গঠনের মাধ্যমে বিশ্বে নতুন নজির সৃষ্টি করেছে। প্রকৃতপে প্রধান বিরোধী দলকে বাইরে রেখে একটি অর্থহীন ও অকার্যকর একদলীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ ধরনের অস্বাভাবিক অবস্থা বেশি দিন স্থায়ী হতে পারে না। 

দশম নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন একটি প্রহসনের নির্বাচন হবে বলে আন্তর্জাতিক সব মহল নির্বাচনের আগে থেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। জাতিসঙ্ঘ, যুক্তরাজ্য, কমনওয়েলথ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন দশম সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক পাঠাবে না বলে আগাম জানিয়ে দিয়েছিল। প্রহসনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরপরই জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব বান কি মুন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহল এ নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য বলে আখ্যায়িত করে সব দলের অংশগ্রহণে অতি দ্রুত অপর একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জোর তাগিদ দিয়েছে। দশম নির্বাচন যে আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতে ব্যর্থ হয়েছে, তার আর ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না। 

সংবিধান মোতাবেক দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বর্তমান নির্বাচন কমিশন তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি থেকে শুরু করে নির্বাচন শেষ হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করেছে। তাদের প্রণীত নির্বাচনী আচরণবিধি তারা স্বাধীন ও নিরপেভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেনি। আরপিও প্রণয়ন এবং নির্বাচনী এলাকা পুনর্নির্ধারণকালে আওয়ামী সরকারের নির্দেশে কমিশন কাজ করেছে। সরকারের ইচ্ছামাফিক নির্বাচন কমিশন মনোনয়নপত্র গ্রহণ ও বাতিল করে ১৫৩টি আসনে ভোট ছাড়া সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের নির্বাচনের ব্যবস্থা করে দিয়ে কমিশন এক কলঙ্কের ইতিহাস রচনা করেছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মনোনয়ন প্রত্যাহারের আবেদন অগ্রাহ্য এবং জাতীয় পার্টির জন্য নির্ধারিত লাঙ্গল মার্কা বরাদ্দ না করার তার চিঠি আমলে না এনে নির্বাচন কমিশন সরকারের নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছে। এর ফলে কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ হিসেবে পরিচিত হয়েছে। নির্বাচনের দিনে সারা দেশে কত শতাংশ ভোট পড়েছে, সে সম্পর্কে নীরব থেকে ভোট কারচুপির সুযোগ করে দিয়েও নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। দশম জাতীয় সংসদের এ ধরনের একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন, ভোটারশূন্য, প্রার্থীবিহীন ও ভোট কারচুপির নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নির্বাচন কমিশনও চরমভাবে ব্যর্থ ও পরাজিত হয়েছে। 

ভোটারশূন্য, প্রার্থীবিহীন ও পাতানো নির্বাচনে প্রতিষ্ঠিত সংসদ ও সরকার জনগণের এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। সরকার ও সংসদ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। দেশের গণতন্ত্র, অর্থনীতি, উন্নয়ন ও শান্তিশৃঙ্খলা আজ কঠিন পরীার সম্মুখীন। জাতীয় ঐক্য সংহতি বর্তমানে হুমকির মুখে। ইতোমধ্যে দেশে বিনিয়োগ, ব্যবসায় ও বাণিজ্যে স্থবিরতা বিরাজ করছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ খাত পোশাক শিল্প বিপর্যস্ত এবং বিদেশে জনশক্তি রফতানি বাজার সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সামনে যে বহুমাত্রিক সঙ্কট, তাকে মোকাবেলা করতে হলে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সৃষ্টি ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। আর তা অর্জন করতে হলে সময়পেণ না করে অতি দ্রুত জাতীয় সংলাপের মাধ্যমে একটি সমঝোতায় উপনীত হওয়া জরুরি। জাতীয় ঐক্য ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের লক্ষ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি অবহেলা বা মতার দম্ভে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। এ লক্ষ্যে সরকার যত দ্রুত উপলব্ধি করবে এবং বাস্তব পদপে গ্রহণ করবে, জাতির জন্য ততই মঙ্গল। 


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads