শনিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০১৪

খালি মাঠে আওয়ামী লীগের গোল এবং ভারতের ভূমিকা


৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের ভাষায় ‘নির্বাচন’ এবং জনগণের ভাষায় ‘মহা তামাশা’ ঘটে গেল বাংলাদেশে। কেমন নির্বাচন হলো সে কথায় পরে আসছি। কিন্তু অন্যদিকে কথা উঠেছে যে, যেমনিই হোকনা কেন, জাল জুয়া চুরি করে হলেও আওয়ামী লীগতো একটি নির্বাচন করে সারল। একটি পার্লামেন্ট বহাল থাকতেই তারা তার ওপর আরেকটি পার্লামেন্ট বসালো। ২৪ তারিখ পর্যন্ত বর্তমান সংসদ সদস্যদের মেয়াদ থাকা সত্ত্বেও আর এক সেট সংসদ সদস্য নিয়ে আসলো। কাল যখন এই লেখাটি ছাপা হবে তখন আপনারা দেখবেন, নতুন মন্ত্রিসভাও গঠিত হলো। এই অবস্থাতে এখন সম্মিলিত বিরোধী দল অর্থাৎ ১৮ দলীয় জোট কি করবে? তারা কি এই সরকারকে মেনে নেবে? মেনে নিয়ে শেখ হাসিনার কথা মতো একাদশ সংশোধনীর ইলেকশন নিয়ে সরকারের সাথে আলোচনা করবে? নাকি আন্দোলন অব্যাহত রাখবে? এই প্রশ্ন কিন্তু করছে তারাই যারা জাতীয়তাবাদী ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী ঘরানার সমর্থক। ব্যক্তিগতভাবে আমি কোনো রাজনৈতিক দল করিনা। তবুও লেখার সুবাদে কিছু কিছু ব্যক্তি আমাকে চেনেন। তারা আমাকেও ফোন করেন এবং জানতে চান যে, এখন আমরা কি করব। আমি আর কি বলব? আমি তাদেরকে নয় ছয় বুঝিয়ে বিদায় করে দেই।
অতীতেও ইউরোপ এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এমনকি পাকিস্তানেও দেখা গেছে যে, নির্বাচনে কারচুপি হলে বা ভোট চুরি হলে, সেই নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার সাথে সাথেই, অথবা দুই চারদিন পরেই সারা দেশব্যাপী উত্তাল গণবিক্ষোভ বা গণআন্দোলন দেখা যায়। প্রায় ক্ষেত্রেই সেই গণআন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয় এবং ২ থেকে ৩ সপ্তাহের মাথায় শাসক গোষ্ঠীর পতন ঘটে। ইউরোপের একাধিক দেশে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এই ধরনের গণবিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানকে অরেঞ্জ রেভ্যুলেশন বা ভেলভেট রেভ্যুলেশন বলা হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রথমে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং পরে প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি যে নির্বাচন দেন সেই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে। জনগণ সেই নির্বাচন মেনে নেয়নি। ফলে নির্বাচনের পর পরই প্রথমে প্রতিবাদ, পরে প্রতিবাদ বিক্ষোভ এবং শেষে ব্যাপক গণআন্দোলন সৃষ্টি হয়। এই গণআন্দোলন প্রায় গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। তবে গণঅভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর পতন ঘটলেও সুযোগটি গ্রহণ করে সেনাবাহিনী। গণআন্দোলনের পিঠে সওয়ার হয়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং জেনারেল জিয়া-উল হক ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তবে ইউরোপ এবং থাইল্যান্ডে সেটা ঘটেনি। সেখানে গণবিপ্লবের পর, ক্ষমতার হাত বদল ঘটেছে এবং বেসামরিক ব্যক্তিদের হাতেই ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটেছে। বাংলাদেশে এটি একটি অবাক ব্যাপার যে, দুই মাস ধরে লাগাতার আন্দোলন হলো। আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে। ফেব্রুয়ারি থেকে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল সেটি দেশ কাঁপানো আন্দোলন হলেও তার উদ্যোক্তা ছিল এককভাবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু বিগত দুই মাস ধরে যে লাগাতার সফল আন্দোলন হলো অর্থাৎ যে লাগাতার সফল অবরোধ এবং হরতাল হলো সেই আন্দোলনের পর সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামানো সম্ভব হলো না। অথচ ফেব্রুয়ারি থেকে ধরলে এই আন্দোলনে প্রায় ৪ শত ব্যক্তি প্রাণ দিয়েছেন। আর বিগত দুই মাস ধরলে প্রায় ১৫০ ব্যক্তি প্রাণ দিয়েছেন। এমনকি নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর প্রায় ১ মাসেরও কম সময়ের আন্দোলনে কম করে হলেও ১২৫ ব্যক্তি প্রাণ দিয়েছেন। এতো বিপুল আত্মত্যাগ, এতো বিপুল রক্তপাত এবং এতো বিরাট রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরেও সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হলো না কেন, সে বিষয়টি আন্দোলনের উদ্যোক্তা এবং নেতৃবৃন্দকে ঠা-া মাথায় বিবেচনা করতে হবে। অথচ অতীতে দেখা গেছে যে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ৫ ব্যক্তি প্রাণ দেয়ার পর সরকারের তক্তা উলটে গেছে। পরবর্তীতে যে আন্দোলন হয়েছে সেসব আন্দোলনে, এমনকি ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানেও ৪ শতাধিক ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটেনি। তারপরেও আইয়ুব খানের মতো দোর্দ- প্রতাপশালী ও মিলিটারী ডিক্টেটরে পতন ঘটেছে। ইয়াজ উদ্দিনের সরকারের পতনের জন্য এতো বড় আন্দোলন তো দূরের কথা, খুব বড় একটি আন্দোলন করতে হয়নি। তারপরেও বিচারপতি কে এম হাসান প্রধান উপদেষ্টার আসনে বসতে পারেননি। এছাড়া প্রধান নির্বাচনি কমিশনার বিচারপতি আব্দুল আজিজও পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তখন কেন এসব ঘটল আর এখন কেন এসব ঘটলো না সেসব বিষয় গভীরভাবে ভাববার সময় হয়েছে।
॥ দুই॥
একটি কারণ অত্যন্ত স্পষ্ট। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পেছনে একটি উঠতি পরাশক্তি প্রকাশ্যে শুধু মাত্র সমর্থন জ্ঞাপন করেনি বরং আওয়ামী লীগের জন্য তারা ঘরে বাইরে সর্বত্র প্রত্যক্ষ ও সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে। এ বিষয়ে ইতঃপূর্বে দেশী এবং বিদেশী মিডিয়ায় আলোচনা হয়েছে। যে বিষয়টি বড় বড় শিরোনামে আসেনি কিন্তু ফলাও করে না হলেও খবরে এসছে সেটি হলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে বৈঠক। এটি ঘটেছিল সেপ্টেম্বরে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন উপলক্ষে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এর ওয়াশিংটন এবং নিইউর্য়ক সফরের সময়। আসলে বাংলাদেশের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফেরত আনার প্রক্রিয়া ভারত শুরু করেছিল সেপ্টম্বের মাসের অনেক আগে থেকেই। তখন চলছিল নীরব কূটনীতি। ভারত তখন যেমন সরাসরি আওয়ামী লীগের পক্ষ নিয়েছিল আমেরিকা কিন্তু তখন কোনো পক্ষ নেয়নি। আমেরিকা চেয়েছিল এমন একটি নির্বাচন যে নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করতে পারবে এবং যে নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ সুবিধা থাকবে। বিএনপি দাবি তুলেছিল যে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। এই দাবির সাথে সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ইস্যুটির অনেক মিল ছিল। বাংলাদেশের রাজনীতির পটভূমিকায় নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীন ছাড়া কোনো দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয়। সেটি প্রমাণিত হয়েছে গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে। যাই হোক, ভারত যেখানে সরকারিভাবে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করছিল সেখানে আমেরিকা কোনো দলকে নয় বরং একটি নীতিভিত্তিক অবস্থান গ্রহণ করেছিল। এই জায়গায় বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত এবং আমেরিকার মধ্যে মতভিন্নতা দেখা দেয়। এছাড়াও দেখা যায় যে, বঙ্গোপসাগরের কর্তৃত্ব নিয়ে ভারত এবং আমেরিকার মধ্যে প্রকাশ্যে না হলেও পর্দার অন্তরালে মতবিরোধ কাজ করতে থাকে। বাহ্যিকভাবে এটি বঙ্গোপসাগর কেন্দ্রিক হলেও এর সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য ছিল ভারত মহাসাগর। অথচ বিশ্বের উদীয়মান পরাশক্তি গণচীনকে মোকাবিলা করার জন্য ভারত এবং আমেরিকা নীরবে জোট বেঁধে কাজ করছে। ভারতের সাথে অনেক প্রশ্নে মত দ্বৈধতা হলেও বৃহত্তর স্বার্থে চীনকে মোকাবিলার লক্ষ্যে আমেরিকা ভারতকে রুষ্ট করতে চাচ্ছিল না।
বাংলাদেশ প্রশ্নে এই সুযোগটি গ্রহণ করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমহোন সিং। সেপ্টেম্বেরে তিনি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য আমেরিকায় যান। সেখানে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাথে যে বৈঠক করেন সে বৈঠকে তিনি বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। বাংলাদেশের নির্বাচনের ইস্যুতে ভারত যে অবস্থান গ্রহণ করেছে সেই অবস্থান সমর্থন করার জন্য তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রতি অনুরোধ জানান। যতদূর জানা যায় যে, ভারতীয় অনুরোধ মার্কিন প্রেসিডেন্ট পুরোপুরি রক্ষা করেননি। কিন্তু তাই বলে তিনি ভারতীয় অনুরোধ পুরোপুরি প্রত্যাখ্যানও করেননি। ড. মনমোহন সিং এর অনুরোধের প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট বারাক ওমাবা এই বিষয়ে একটি সুরাহা করার জন্য দিল্লীস্থ মার্কিন দূতাবাসকে নির্দেশ দেন। কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায় এবং পত্র-পত্রিকাতেও প্রকাশ পায় যে, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের নির্বাচন প্রশ্নে আমেরিকা এবং ভারত পূর্ণ ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। তাদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েই যায়। এর মধ্যে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্র দূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা দিল্লী ছুটে যান সেখানে তার বৈঠক ব্যর্থ হয়। তখন তিনি পরবর্তী নির্দেশ গ্রহণের জন্য ওয়াশিংটন যান। কিন্তু তার পরেও মার্কিন ভারত মতানৈক্য রয়েই যায়।
॥ তিন ॥
কিন্তু আওয়ামী লীগ যে বিশেষ সুবিধা পেয়েছে সেটি বিএনপি বা ১৮ দলীয় জোট পায়নি। ভারত আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট গণতন্ত্র, অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচন এবং সব দলের অংশ গ্রহণের বিষয়টিতে শুধুমাত্র লিপ সার্ভিস প্রদান করে। তারা এ বিষয়ে সরাসরি অথবা শক্ত কোনো অবস্থান গ্রহণ করেননি। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভারতের হেভিওয়েট পলিটিশিয়ান এবং আমলারা প্রত্যক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব সালমান খুরশিদ, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এবং বর্তমানে নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিব শংকর মেনন এবং বর্তমান পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সেন। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায় যে, একতরফা ও একদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল। কিন্তু ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ঢাকায় তিন দিনের জন্য যে সফরে আসেন সেই সফরেই নাকি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী স্ট্র্যাটেজি চূড়ান্ত করা হয়। ভারত কোনো অবস্থাতেই এবার ক্ষমতায় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে দেখতে রাজি ছিল না। তাই আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের পরামর্শ ছিল, ছলে-বলে-কৌশলে, যেভাবেই হোক আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে জিততেই হবে। এ ব্যপারে ভারত সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতা করবে। আমেরিকা ভারতকে নাকি এই ধরনের প্রত্যক্ষ ভূমিকা থেকে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়।
পরের খবর সকলেরই জানা। বিরোধী দলকে দমন করার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার চরম চ-নীতি গ্রহণ করে। গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়। ১৫৩ জনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনে পাশ করিয়ে সংখ্যাগুরু ভোটারদের ভোটাধিকার হরণ করা হয়। জনগণ নির্বাচন থেকে সম্পূর্ণ মুখ ফেরায়। অনেক কেন্দ্রে কোনো ভোটার যায়নি। ভোটের বাক্স খালি থাকে। কিন্তু ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের কর্মী বাহিনী ঢুকিয়ে ভোটের বাক্স পূরণ করা হয়। ভোটার উপস্থিতি যেখানে ছিল ১০ শতাংশের কম সেটিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ৪০ শতাংশ করা হয়।
এই নির্বাচন থেকে বিরোধী দলকে যে শিক্ষাটি গ্রহণ করতে হবে সেটি হলো এই যে, ভারত সব সময় আওয়ামী লীগকেই সমর্থন করবে। ভারতের প্রত্যক্ষ মদদপুষ্ট আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করতে হলে জনগণকে সাথে নিয়ে গণঅভ্যুত্থান ঘটানো ছাড়া বিরোধী দলের সামনে এখন আর কোনো পথ খোলা নেই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads