শনিবার, ৪ জানুয়ারী, ২০১৪

গণতন্ত্রের পোস্টমর্টেম


এ দেশ আমাদের সবার। আমাদের সবার, এর অর্থ কী? দেশের ৪০ শতাংশ লোকের নাকি ৬০ শতাংশ লোকের? ৪৯ শতাংশ নাকি ৫১ শতাংশ লোকের; কোনো লোক যদি নীতিহীন না হন, তা হলে বলবেন, এ দেশ অবশ্যই ১০০ শতাংশ লোকের কিন্তু পরিচালিত হবে ৫১ শতাংশ বা ততোধিক লোকের নির্বাচিত দল দিয়ে। আমি মনে করি, এই বিষয় সম্পর্কেও কোনো জ্ঞানী ব্যক্তি দ্বিমত পোষণ করতে পারবেন না। যদি তাই হয়, তাহলে নির্বাচনটি হবে কোন পদ্ধতিতে? দেশের বর্তমান জনগোষ্ঠীর ৪৯ শতাংশ লোক যে দলটিকে সমর্থন দিচ্ছেন নাকি ৫১ শতাংশ লোক যে দলটিকে সমর্থন দিচ্ছেন তাদের দাবি করা পদ্ধতিতে? কোনো অসভ্য, বর্বর, স্বার্থপর, বেঈমান, বেহায়া, জ্ঞানপাপী না হলে অবশ্যই বলবেন, দেশের ৫১ শতাংশ লোক যে দলটিকে সমর্থন দেবে সেই দলের দাবি করা পদ্ধতিতে। তা না হলে সেটি গণতন্ত্র হবে না, হবে স্বৈরতন্ত্র। বর্তমান সরকারের অধীনে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পাঁচটিতেই বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন এবং প্রত্যেকে কমপক্ষে প্রদত্ত ভোটের ৫১ শতাংশ পেয়েছেন। অর্থাৎ পাঁচটি শহরের কমপক্ষে ৫১ শতাংশ লোক বিএনপিকে সমর্থন দিয়েছে। অর্থাৎ বর্তমান সময়ে বিএনপির দাবি করা পদ্ধতিতে নির্বাচন হওয়া উচিত। তা না হলে স্বৈরতন্ত্র হবে এবং এটি হবে আওয়ামী লীগের চৌর্য প্রবৃত্তির পরিচায়ক এবং জোর করে ক্ষমতায় যাওয়া ও থাকার জঘন্য স্বভাবের নগ্ন মনোবৃত্তি।

পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়েছে বলে এটি মনে করার কোনো অবকাশ নেই যে, জনগণ বিএনপির ভালো কাজের জন্য তাদের বিজয়ী করেছেন বা তাদের ভালোবেসে তাদের বিজয়ী করেছেন। প্রধানমন্ত্রী যদি জ্ঞানপাপী না হন তা হলে তিনি বুঝতে পারবেন যে, তার দলকে ঘৃণা করে তাদের ভোটটি বিএনপিকে দিয়েছেন এবং এত মারাত্মকভাবে ঘৃণা করেছেন যে তার ঘাঁটিতেও তার প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এটি বোঝা উচিত। না বুঝলে বুঝতে হবে তিনি জ্ঞানপাপী। চুরি করে ছাড়া ক্ষমতায় আসার কোনো উপায় নেই, তাই চুরির কলাকৌশল সঠিকভাবে প্রয়োগ করে ক্ষমতায় আসতে চান। সেটি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মানায় না। যদি সেটি করেন তা হলে জাতির জনকের কপালে একটি কলঙ্কের তিলক এঁকে দেবেন। গত নির্বাচনের সময় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী জনকণ্ঠে একটি লেখায় মন্দের ভালো তত্ত্ব দিয়েছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ মন্দের ভালো। আমার মনে হয় তিনি ঠিক বলেননি। কারণ এটি অনেক বিষয়ে হিসাব-নিকাশ করে বলতে হবে। প্রথমত, কাদের সময় কতটি এবং কত টাকার উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে, যোগাযোগব্যবস্থা এবং ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে, কারা কত টাকা মেরে খেয়েছে? রাজপুত্র, রাজপুত্রী থেকে তৃণমূল পর্যন্ত, কারা কতজনের ওপর অন্যায় অত্যাচার করেছে? কারা কতটা সন্ত্রাস, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি করেছে প্রভৃতি বিষয়ে হিসাব-নিকাশ করে বলতে হবে।

অফিস আদালতে কিছু জ্ঞানপাপীর কথা শুনি, যেকোনোভাবে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে হবে। মানে? মানেটা কী দাঁড়ায়? চুরি করে আসবে? এরা গণতন্ত্রের কথা শুধু মুখে বলবে কাজে খাটাবে না? তা হলে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের সাথে তাদের পার্থক্যটা কোথায়?

আওয়ামী লীগ কথায় কথায় বলে এরা মাঠ থেকে উঠে এসেছে। মাঠ থেকে তাদের সংগঠনের জন্ম। তাদের সংগঠনের জন্মলগ্ন, স্থান সব কিছু হালাল। তারা ১০০ শতাংশ খাঁটি গণতান্ত্রিক দল, এটাই তারা বোঝাতে চান। সত্যি কি তাই? তা হলে এখন কেন গণতন্ত্রের তোয়াক্কা না করে ক্ষমতায় থাকার জন্য নিজেদের উদ্ভাবিত পথে নির্বাচন করছে?

সব দল এবং নেতা, নেত্রী ও কর্মীকে মনে রাখতে হবে, ব্যক্তির থেকে দল বড় আর দলের থেকে দেশ বড়। সে কথা ভেবে আওয়ামী লীগকে সব দুরভিসন্ধি থেকে সরে এসে নিরপেক্ষ নির্বাচনের ঘোষণা দিতে হবে। এ ঘোষণা দিয়ে সেই হিসেবে ব্যবস্থা নিলে দেশের সঙ্ঘাতময় পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে মানুষ মুক্তি পাবে। এর আগে বিরোধী দলকে থামতে বললে তারা থামবে বলে মনে হয় না। আন্দোলনকারী পক্ষ তাদের দাবি আদায়ের ন্যূনতম নিশ্চয়তা না পেলে আন্দোলন থামায় না। এটি আন্দোলনের ধর্ম। সুতরাং মনে হয় আগে তাদের দাবি মানতে হবে। পরে তারা থামবে।

বিএনপিকেও অনেক পরিশুদ্ধ হতে হবে। অন্য দলকে একত্রে নিয়ে আন্দোলন করার ক্ষেত্রে এবং রাষ্ট্র পরিচালনা করার ক্ষেত্রে দলের স্বকীয়তা যেমন নষ্ট করা যাবে না, ঠিক তেমনি দেশের মানুষের মতামতের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো কাজ করা যাবে না। ক্ষমতায় এলে কাউকে মাথায় উঠতে দেয়া যাবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা আনতে হবে। সঠিক বিচারের মাধ্যমে তাদের রায় দিতে হবে। সঠিক বিচারের নাম করে প্রকৃত অপরাধীদের ছাড়া যাবে না।

জামায়াতকে মনে রাখতে হবে, তাদের বর্তমান সমস্যা অস্তিত্বের সঙ্কট। সেই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে এসে সুষ্ঠু রাজনীতির ধারায় ফিরে আসাই তাদের এখন মূল লড়াই, সে লড়াইয়ের জন্য তাদের বিএনপির সাথে থাকা প্রয়োজন। না হলে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। আবার বিএনপির ওপর চাপ প্রয়োগ করে বিভিন্ন অযৌক্তিক দাবি আদায় করলে, বিএনপিকে জনগণের কাছে খারাপ হিসেবে প্রতীয়মান করলে, জনগণ বিএনপিকে ত্যাগ করবে, তখন বিএনপির অস্তিত্বও থাকবে না। আওয়ামী লীগ জামায়াতকে বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য সব প্রচেষ্টা চালাবে। যেমনটি এত দিন চালিয়ে এসেছে। সুতরাং জামায়াতকে সব সময় মনে রাখতে হবে, ’৭১-এর ভূমিকার জন্য দেশ ও জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে স্বাধীনতার শক্তির পক্ষের শক্তির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে সেইভাবে দেশ গড়ার কাজে অংশগ্রহণ করতে হবে। সাথে সাথে দেশের মানুষের চাওয়া-পাওয়া অনুযায়ী বিএনপিকে কাজ করানোর ব্যাপারে সচেতন করাতে হবে। এরশাদকে ভয় দেখিয়ে সব সময় আওয়ামী লীগের পক্ষে রাখা হয় এবং বর্তমানে তাকে চিকিৎসার কথা বলে গ্রেফতার করে সিএমএইচে আটকে রাখা হয়েছে। কোনো দলকে ভাঙা বা বগলদাবায় রাখার জন্য এমন কূটকৌশল করা আর বিষ্ঠা খাওয়া সমান কথা। এটা জঘন্য মানসিকতার পরিচায়ক।

বিএনপি গত পাঁচ বছরে জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে খুব কম সময় আন্দোলন করেছে। তারেক রহমানের মুক্তি এবং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার দাবিতে আন্দোলন করে তাদের গত পাঁচ বছর সময় কেটেছে। এমন রাজনীতি করার থেকে সে দলের অফিসের বাতি নিভিয়ে বসে থাকাই ভালো। এমন রাজনীতি যেন ভবিষ্যতে কোনো দল এ দেশে না করে। সেটি জাতির জন্য খুব দুঃখজনক।

পরিশেষে বলা যায়, আমাদের দেশের ক্ষমতায় পর্যায়ক্রমে আসা দুটি দলের ত্রুটির শেষ নেই। আগের শত শত ত্রুটি, ভুল, ভ্রান্তি রয়েছে। সেগুলো নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করলে এ লেখা শেষ হবে না। সুতরাং সেই আলোচনায় না গিয়ে দুটি দলকে পরিশুদ্ধ হতে হবে। না হলে এ দেশ কোনো দিন এগিয়ে যেতে পারবে না। মারামারি কাটাকাটি হানাহানির পরিবেশ বারবার ফিরে আসবে। আমাদের রাজনীতিবিদদের নির্মোহ হতে হবে। সব ধরনের লোভ, মোহ, প্রলোভনকে নাবলে ন্যায়নীতিকে আঁকড়ে ধরতে হবে। না হলে এ অবস্থা চলতে থাকবে। বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সামরিক শাসন এলে গণতন্ত্রে আবার একটি ছেদ পড়বে। যদিও গত পাঁচ বছরে কতটা সময় গণতন্ত্রের চর্চা হয়েছে সেটা গবেষণার বিষয়। তবুও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা ছেড়ে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। বিরোধীদলীয় জোটকে সব সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি ক্ষমতাসীন দলকে সর্বদা সঠিকভাবে কার্যকর রাখতে হবে তত দিন, যত দিন না পরস্পরের প্রতি পরস্পরের আস্থা বিশ্বাস ফিরে আসে। কখনো এটিকে সংখ্যাগরিষ্ঠের সুযোগ নিয়ে সংসদে বিল পাস করে রোহিত করা যাবে না। এ ব্যবস্থা তত দিন পর্যন্ত চালু রাখতে হবে যত দিন না বিরোধী দল বলবে, ‘এবার এটি বন্ধ করে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন করা যেতে পারে।দেশের উন্নতি, দেশের মানুষের মঙ্গলের চিন্তা করে সব দলীয় সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে আমাদের সত্য, সুন্দর, নীতি ও নৈতিকতার পথ ধরে এগোতে হবে এবং তার জন্য একজোট হয়ে খারাপ দলগুলোকে প্রতিনিয়ত ভালো করার জন্য ভেতর এবং বাইরে থেকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। না হলে আমাদের দেশ কখনো এগোতে পারবে না। সেই তিমিরেই পড়ে রবে। সেটা হতে পারে না। আমাদের দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। আসুন দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য আমরা সবাই একজোট হই। সব বিভেদ ভুলে একটি পতাকার তলে আসি। সেটি উন্নয়নের পতাকা, মানুষের বেঁচে ওঠার পতাকা।


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads