মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারী, ২০১৪

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সরকার


ক্ষমতাসীনেরা কখনোই চান না গণমাধ্যম সঠিক পথে চলুক। সত্য ধারণ না করার মানসিকতা এর প্রধান কারণ। মতাসীনেরা সব সময় চাটুকারদের প্রচ্ছন্ন ছায়ায় থাকেন। সত্য প্রকাশিত হলে নিজেদের দোষ-ত্রুটির দিকে না তাকিয়ে প্তি হন সংবাদকর্মীর ওপর। নির্যাতিত হন সংবাদকর্মী বা সত্য প্রকাশকারী। চাটুকারেরা মতাসীনদের প্ররোচিতও করে। ব্যক্তি থেকে নির্যাতন যখন রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত গড়ায় তখন গণমাধ্যম হয় হুমকির সম্মুখীন।

বর্তমান মহাজোটীয় সরকার স্বাধীন গণমাধ্যমের সহায়ক, তাদের কাজকর্মে তেমনটি বলা যায় না। তাদের পূর্বসূরিরাও স্বাধীন গণমাধ্যমে বিশ্বাসী ছিল না। ১৯৭৫ সালের শুরুতে চারটি পত্রিকা রেখে সব পত্রিকা বন্ধের নির্দেশ তারই বহিঃপ্রকাশ। বর্তমান মতাসীন সরকার চান গণমাধ্যম তাদের দোষ-ত্রুটি নয়, তাদের গুণকীর্তন করুক। সরকারের গুণকীর্তনের বাইরের যে কাউকেই তারা শত্রহিসেবে গণ্য করে। বর্তমান সরকারের সময় ১৯ জন সাংবাদিক নিহত, প্রায় ২০০ জন সাংবাদিক আহত কিংবা তাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রদান এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সংবাদপত্র বন্ধ করা হয়েছে।

নিজ বাসভবনে সাগর-রুনি অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় হত্যার শিকার হন। এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কী কারণ তা আজো উদ্ঘাটন হয়নি। পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী খুনিচক্র তাদের ব্যবহৃত ল্যাপটপটি নিয়ে যায়। এতেই সন্দেহ জাগে দেশের সচেতন মানুষের মধ্যে। খুনিচক্র বাসার মূল্যবান জিনিসপত্র না নিয়ে শুধু ল্যাপটপ নিল কেন? প্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান সময়ে সাংবাদিকেরা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি ল্যাপটপে সংরণ করেন। নিশ্চয় ল্যাপটপে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যা নেয়ার জন্যই তাদের হত্যা করা হয়।

সরকারের ঘোষিত ২৪ ঘণ্টা থেকে ২৪ মাস পার হলেও প্রকৃত হত্যাকারী গ্রেফতার হয়নি। তাহলে সবার মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক সরকার কি এ ক্ষেত্রে আন্তরিক? গোপন কিছু ফাঁস হওয়ার ভয়ে সরকার নিশ্চুপ! সত্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে সাংবাদিকদের হত্যা করা কি স্বাধীন গণমাধ্যমের পরিচায়ক? নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সাংবাদিক শ্রেণী সোচ্চার। আন্দোলনরত সাংবাদিকদের এক অংশের নেতৃত্বে ছিলেন একজন সাংবাদিক নেতা। তার ভূমিকা শুরু থেকেই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। তাকেই তথ্য উপদেষ্টা নিয়োগে সাংবাদিকদের প্রতি সরকারের নীতি কী তা সরকার পরিষ্কার করেছে।

মহাজোট সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন একজন অসহিষ্ণু ব্যক্তি। তার দায়িত্ব গ্রহণের পর অনেকেই আশান্বিত হয়েছিল। কারণ জাসদের খসড়া ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচির এর ৪ ও ৫ ধারা এরূপ; ৪. সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা; ৫. বেতার টিভির স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা। কিন্তু তার কাজকর্ম কি জাসদ ঘোষণাপত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ? তিনি কি স্বাধীন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা করতে সম হয়েছেন? তার কাজকর্ম কি রাষ্ট্রের বেতার-টিভির স্বায়ত্তশাসনের পে হয়েছে? দেশের সচেতন জনগণ অন্তত তেমনটি প্রত্য করছে না। তার হাত দিয়েই বন্ধ হয়েছে দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি। বন্ধ আছে জনপ্রিয় সংবাদপত্র আমার দেশ। গ্রেফতার করে রিমান্ডের নামে নির্যাতন করা হচ্ছে সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে। বন্ধ গণমাধ্যম এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অপরাধ কী?

সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের অপরাধ তিনি তার পত্রিকায় বিচারকের স্কাইপ সংলাপ ছেপেছেন। তিনি রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ করেছেন। স্কাইপ সংলাপ তো আগেই একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তথ্য সূত্র উল্লেখ করে প্রকাশিত তথ্য লেখা কি প্রিন্টিং অ্যাক্টে অপরাধ? এমন তো কোনো কথা প্রিন্টিং অ্যাক্টে নেই। তাহলে নিশ্চয় ওই অপরাধে তাকে গ্রেফতার বা নির্যাতন করা হচ্ছে না। তার অপরাধ তিনি সত্য প্রকাশ করেছেন। সরকারের গুণকীর্তন নয়, সমালোচনা করেছেন। এসব কর্মকাণ্ড কি জাসদ ঘোষণাপত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ

দেশে কী ঘটছে তা জানার অধিকার সবার আছে। সেটা কারো ভালো লাগুক আর নাই লাগুক। ঘটনার বিবরণ তুলে ধরাই তো গণমাধ্যমের কাজ। দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি নিষ্ঠার সাথে সেই কাজটিই করেছে। তাহলে অনেকটা নিশ্চয়তার সাথে বলা যায় ৫ মের ঘটনার জন্য চ্যানেল দুটি বন্ধ করা হয়নি। বেশ কিছু দিন থেকে চ্যানেল দুটিতে বিরোধী দলের সংবাদ বেশি প্রচারিত হচ্ছিল। সরকারের গুণকীর্তন না করে সমালোচনা করছিল। বিরোধী দলের নেতাকর্মী ছাড়াও সচেতন মানুষ চ্যানেল দুটির ওপর আস্থাশীল হয়ে পড়ছিল। এ অবস্থা চলতে থাকলে অধিকসংখ্যক মানুষ সরকারের জনবিরোধী কর্মকাণ্ড জেনে যাবে এই ভয়ে সরকার ভীত ছিল। তা ছাড়া বিরোধী দলের কর্মকাণ্ড যেন মানুষ জানতে না পারে সে উদ্দেশ্যও ছিল। এসব কর্মকাণ্ড কি সরকারের স্বাধীন গণমাধ্যম চর্চার মানসিকতার পরিচায়ক?

পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী পুলিশ অপর একটি পত্রিকার সম্পাদকের বাসা তল্লাশি করেছে। তাকে গ্রেফতারের জন্য গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে। যত দিন সরকারের সমালোচনা করেনি তত দিন তো তার বাড়ি তল্লাশি কিংবা গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়নি। এটি কারো বুঝতে অসুবিধা হয় না যত দিন সরকারের নেতিবাচক বিষয়াদি জাতির সামনে তুলে ধরেনি, তত দিন ছিল ভালো। সরকারের ইতিবাচক বিষয় তুলে ধরলে পত্রিকা ও তার সম্পাদক ভালো, আর নেতিবাচক বিষয়াদি তুলে ধরলেই সরকারি হস্তপে। এটা কি বর্তমান সরকারের স্বাধীন গণমাধ্যম মানসিকতার পরিচায়ক?

স্বাধীন গণমাধ্যমের সুযোগে হলুদ সাংবাদিকতা হয় না এমনটি নয়। সম্প্রতি বেশ কিছু প্রচার মাধ্যমে হরতাল-অবরোধের ধ্বংসাত্মক চিত্র বা প্রতিবেদন প্রচার করতে দেখা যায়। এর উদ্দেশ্যও জনগণ বোঝে। কার বা কাদের নির্দেশে এগুলো প্রচারিত হচ্ছে তা বুঝতে কারো অসুবিধা হয় না; কিন্তু কী কারণে দেশে হরতাল-অবরোধ হচ্ছে, প্রাণ ও সম্পদহানি হচ্ছে, কার বা কাদের নির্দেশে পুলিশ নিরীহ মিছিলকারীদের ওপর গুলি চালাচ্ছে, তা তো তেমন প্রচারিত হতে দেখা যায় না। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে কয়েকটি প্রচারমাধ্যমের ভূমিকা জনগণ দেখেছে; কিন্তু কার একগুঁয়েমিতে দেশের বারোটা বাজছে সে বিষয়ে কি কোনো ভূমিকা প্রচারমাধ্যমের থাকা উচিত নয়? প্রচারমাধ্যমের ভূমিকা কি টকশোর ভেতরেই সীমাবদ্ধ?

দেশের হাতেগোনা কয়েকটি দৈনিক পত্রিকার সংবাদকে জনগণ এখনো বিশ্বাস করে। প্রাগ্র্রসর পাঠক শ্রেণী ওইসব পত্রিকা পড়ে এবং তাদের মতামত দেয়। দেশের ক্রান্তিকালে তারাও কি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য দায়িত্ব পালন করছে? জনপ্রিয় একটি দৈনিকের খবরে হরহামেশা দেখা যায় উদ্দেশ্য গোপন করে খবর পরিবেশন। সচেতন পাঠক শ্রেণী বোঝে এটি সুকৌশল প্রচারণা; কিন্তু তাদের খবরে তো এমন শব্দচয়ন দেখা যায় না গণমাধ্যমের ভাষায় দায়িত্বশীলতা। সংবাদ পরিবেশনের এই অপকৌশল জাতিকে ঐক্যবদ্ধ নয় দ্বিধাবিভক্ত করবে। ১৪ দলীয় জোট মহাজোট এবং বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোট এটি সবাই জানে। সুকৌশলে অপপ্রচার চালানো কি অপসাংবাদিকতা নয়? তাদের বিরুদ্ধে তো সরকারকে কোনো পদপে নিতে দেখা যায় না। 

সরকারের ভাঙা বাক্সখ্যাত বিটিভির দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। দেশের মানুষ কি বিটিভির সংবাদ কিংবা প্রতিবেদনকে নিরপে বলে মনে করে? সরকারের বিপে যায় এমন কোনো খবর বা প্রতিবেদন কি বিটিভিতে প্রচার করা হয়? দেশের মানুষ সব সময়ই বিটিভিতে সরকারের গুণকীর্তনই দেখে থাকে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত জাসদ সভাপতি পার্টির ঘোষণাপত্রের এই ত্রেটিতে নিশ্চুপ কেন? এ দিকে বিটিভির স্বায়ত্তশাসন তো প্রতিষ্ঠিত হয়নিই বরং আরো হরণ করা হয়েছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়নি। বরং জনপ্রিয় সংবাদপত্র আমার দেশ বন্ধ হয়েছে। দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি বন্ধে জাতি সরকারের উল্টো কাজটিই দেখেছে। 

গণতন্ত্রকে সুসংহত ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে গণমাধ্যমকে তার নিজস্ব পথে চলতে দিতে হবে। গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার মানসিকতা কারো জন্যই শুভ হয় না। সরকার যদি গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হয় তাহলে অচিরেই আমার দেশ, দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি চালুর পদপে নিয়ে তা প্রমাণ করবে। নির্যাতন ও হয়রানি বন্ধ হবে সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর থেকে। 


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads