বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০১৪

ভারতের প্রতিবেশী সম্পর্ক


ভারত পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। গণতন্ত্রচর্চাকারী বিশ্বের বৃহত্তম দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এটিকে। সামরিক ক্ষেত্রে বিশ্বের যেসব দেশ বেশি ব্যয় করে তার মধ্যে ৭ নম্বরে রয়েছে ভারত, যদিও অর্থনীতির আকার হিসেবে নবম স্থানে দেশটির অবস্থান। বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির এই দেশটিতে আবার পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মানুষের আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটে দেশটিতে। প্রাচীন সভ্যতার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসও রয়েছে এই ভূখণ্ড ঘিরে।
আকার-আয়তন, প্রভাব বিস্তার ইত্যাদি বিবেচনায় ভারত হওয়ার কথা বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশের একটি। বাস্তবে সেই প্রভাব প্রতিবেশীদের সাথে আঞ্চলিক জটিল সম্পর্কের আবর্তে পড়ে উপমহাদেশ গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সেভাবে যেতে পারছে না। এ রকম একটি বহু সংস্কৃতি ও সম্ভাবনার দেশের নাগরিক ও প্রতিবেশী হওয়ার মধ্যে যে গৌরব ও আনন্দ থাকার কথা, বাস্তবে তা থাকছে না। গণতন্ত্রচর্চার ক্ষেত্রে ভারতকে বিশ্বে সাধারণভাবে প্রশংসার দাবিদার হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু গণতন্ত্রচর্চার আড়ালে যে তীব্র বৈষম্য রয়েছে তা দেশটির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চলকে মাওবাদ বিস্তারের জন্য উর্বর ভূমিতে রূপান্তর করছে। দেশটির ধনী-দরিদ্র প্রায় সব রাজ্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, কিন্তু এর অংশ গরিব মানুষ পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। যার ফলে দারিদ্র্য আরো গভীরতর হচ্ছে। বাঁচিয়ে রাখার জন্য নামমাত্র দামে খাদ্য দেয়ার প্রকল্প নিতে হচ্ছে সরকারকে। অন্য দিকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা নিয়ে দারিদ্র্য দূর করার পরিবর্তে পুলিশি ব্যবস্থা নিয়ে গরিবের সংগ্রামকে দমন করতে হচ্ছে। অথচ একই দেশের কিছু কিছু রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক অবস্থা অনেক উন্নত দেশের সাথে তুলনা করার মতো। ভারতের এই অভ্যন্তরীণ বৈষম্য ও টানাপড়েনের মূল কারণ দূর করার পরিবর্তে এর সাথে প্রতিবেশী দেশগুলোর যোগসূত্র আবিষ্কারের একটি প্রবণতা দেশটির প্রশাসন ও একশ্রেণীর গণমাধ্যমের প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। এতে প্রতিবেশী দেশ ও জনগণের ব্যাপারে একধরনের বিদ্বেষ ও ভুল ধারণা তৈরি হয় সাধারণ ভারতীয়দের মধ্যে। আর এই প্রবণতা এবং ভারতের প্রতিষ্ঠাতাদের যে ডকট্রিন রয়েছে, তার মিলিত প্রভাবে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে ভারতের এক অস্বস্তিকর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের চার পাশের দেশগুলোর সাথে নয়াদিল্লির বর্তমান সম্পর্ক দেখলে বিষয়টি বোঝা যাবে।
উপমহাদেশের ইতিহাসের একই উত্তরাধিকারের অংশ হলো ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। নেপালের সাথেও ভারতের রয়েছে অভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মিলবন্ধন। শ্রীলঙ্কার সাথেও ভারতের যোগসূত্র ও প্রাচীন ইতিহাসের বিশেষ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ভুটানের নিজস্ব পাহাড়ি সংস্কৃতি এর স্বাতন্ত্র্য তৈরি করলেও এর ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা নেপালের মতোই ভারতের ওপর একধরনের নির্ভরতা সৃষ্টি করেছে। চীন ও ভারত দুই বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ হওয়ার পাশাপাশি তারা দুই প্রাচীন সভ্যতার উত্তরাধিকারও বটে। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে বৈরিতা সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলোকে আচ্ছন্ন করে রাখছে। সার্বিকভাবে নানা বাস্তবতা এশিয়ার এই অঞ্চলে সহযোগিতার একটি বিরাট ক্ষেত্র তৈরি করতে পারত। কিন্তু বাস্তবে কেন হচ্ছে না তা নিয়ে প্রশ্ন অনেকের।
প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের মতোই হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলো নেপাল। ভূমিবেষ্টিত দেশ হিসেবে নেপালকে সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে হয় ভারতীয় ভূখণ্ড পেরিয়ে। চীনের সাথে পর্বতসঙ্কুল রাস্তায় সড়ক যোগাযোগ তৈরির সুযোগকে বাস্তবায়ন সেভাবে করতে না পারায় বাইরের যোগাযোগের জন্য নেপালকে বরাবরই দ্বারস্থ থাকতে হয়েছে ভারতের। ভারতের ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা নেপালের অর্থনীতির বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করেন। দেশটির নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা করে বৈদেশিক সম্পর্ক রচনার সুযোগ ভারতের নানা প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য চুক্তির কারণে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। রাজতন্ত্রের অবসান ঘটানোর সাথেও রাজা বিরেন্দ্রর অন্য দেশের সাথে মুক্ত অর্থনৈতিক সম্পর্ক রচনার প্রচেষ্টা সক্রিয় ছিল বলে মনে করা হয়। রাজতন্ত্র অবসানের পর এখন যে রাজনৈতিক অচলাবস্থা চলছে তার পেছনেও নয়াদিল্লির কলকাঠি সক্রিয় রয়েছে বলে মনে করা হয়। দেশটির প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল ও সুশীলসমাজের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করে নয়াদিল্লির একধরনের রাডার নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে নেপালে। সে নিয়ন্ত্রণ থেকে বের হওয়ার চেষ্টা নিয়ে মাওবাদীরা এখন ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়েছে। নেপালের জনগণের সাথে ভারতীয়দের কোনো বিরোধ থাকার কারণ নেই। এর পরও দেশটির সম্ভাবনার লক্ষ্যে পৌঁছতে পদে পদে বাদসাধার কারণে ভারতকে নেপালের বেশির ভাগ মানুষ কল্যাণকামী ভাবতে পারে না।
শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যা খুব উল্লেখযোগ্য না হলেও দেশটির সম্ভাবনা ছিল প্রবল। প্রায় শতভাগ শিক্ষিত এবং কম বৈষম্যমূলক সামাজিক ব্যবস্থার কারণে একধরনের স্থিতিশীল অর্থনৈতিক বিকাশ শ্রীলঙ্কাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদের বীজ সেই সংহতি ও সম্ভাবনাকে তীব্রভাবে ব্যাহত করে। শ্রীলঙ্কার বেশির ভাগ মানুষ বিশ্বাস করে এই সঙ্কটের কলকাঠি নেড়েছে বৃহৎ প্রতিবেশী দেশটি। এ ইস্যুটি নিয়ে বেশি খেলতে গিয়ে তা রাজিব গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শ্রীলঙ্কা শেষ পর্যন্ত অন্য কটি প্রতিবেশী দেশের সহায়তায় তামিল সঙ্কট থেকে উত্তরণের একটি পর্যায়ে এসেছে। কিন্তু সামনে এগোনোর ক্ষেত্রে সহযোগিতা তারা ভারতের পক্ষ থেকে পাচ্ছে বলে মনে করে না।
পাকিস্তানের সাথে ভারতের সঙ্ঘাত স্বাধীনতা অর্জনের সূচনালগ্ন থেকেই। কাশ্মির, জুনাগড় ও হায়দরাবাদকে ভারতের অঙ্গীভূত করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ বিরোধ ও সঙ্ঘাতের শুরু। এরপর নানা ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে অনেকবার যুদ্ধ হয়েছে। এই সঙ্ঘাতকে সামনে রেখে দুই দেশই পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হয়েছে। পাকিস্তানে সামাজিকভাবে যে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে তার পেছনে মূল ইন্ধন ভারতই দিয়ে থাকে বলে বেশির ভাগ পাকিস্তানির ধারণা। আবার ভারতে কাশ্মিরের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতার তৎপরতা ও সন্ত্রাসী ঘটনার পেছনে পাকিস্তানের হাত রয়েছে বলে ভারতে ব্যাপক প্রচারণা রয়েছে।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সময় দুই দেশের মধ্যে যে অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছিল তা আরো বেড়ে যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের সর্বাত্মক সমর্থনে। বেলুচিস্তানসহ পাকিস্তানে এখনকার সামাজিক ও ধর্মীয় সঙ্ঘাতের জন্য ভারতের গোপন গোয়েন্দা সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এ অবিশ্বাসকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারতে কারগিল এবং মুম্বাই হামলার মতো ঘটনার সাথে পাকিস্তানকে সম্পৃক্ত করার বিষয় উত্তেজনা বৃদ্ধি করেছে। এখন পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নœতাবাদীদের গোপন সমর্থন জোগানোর পাশাপাশি দেশটির রাজনীতি ও সুশীলসমাজে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ভারত করছে বলে উল্লেখ করা হচ্ছে, যা বৈরিতাকে আরো বাড়িয়ে চলেছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সর্বাত্মক সমর্থনের কারণে দেশটির সাথে নিরবচ্ছিন্ন বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকবে বলে প্রত্যাশা ছিল অনেকের। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশকে একটি আশ্রিত ও নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রে পরিণত করার মতো মানসিকতা দিল্লির বিভিন্ন নীতিতে প্রকাশ হয়ে পড়লে বাংলাদেশের জনমত দেশটির প্রতি বৈরী হয়ে ওঠে। বিশেষত অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন প্রশ্নে সমঝোতায় না এসে একতরফা পানি প্রত্যাহার, পাল্টা সুযোগ না দিয়ে একতরফা বাজার দখল প্রচেষ্টা, চুক্তি ভেঙে আঙ্গরপোতা দহগ্রাম যাওয়ার তিন বিঘা করিডোর হস্তান্তর না করা, সীমান্ত হত্যা ইত্যাদি ইস্যু অবিশ্বাসকে বাড়িয়ে দেয়। অন্য দিকে ভারত মনে করে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বাংলাদেশে নিরাপদে আশ্রয় পাচ্ছে। এ নিয়ে একধরনের টানাপড়েন সৃষ্টি হয়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় এলে রাডার নিয়ন্ত্রণেরনতুন তত্ত্ব হাজির হয়। ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান শঙ্কর চৌধুরীর এই তত্ত্বে বলা হয়, বাংলাদেশকে দিল্লির রাডারের নিয়ন্ত্রণ থেকে কোনোভাবেই বের হতে দেয়া যাবে না। এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশে ইসলামি মূল্যবোধ ও বিশ্বাসভিত্তিক রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি নির্মূলের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা এখানে নজিরবিহীন হানাহানির পরিবেশ সৃষ্টি করে। এতে বাংলাদেশ বিগত কয়েক দশকে অর্থনৈতিকভাবে যে অগ্রগতি অর্জন করে, তা ব্যাহত হয়। অন্য দিকে রাষ্ট্রের সর্বপর্যায়ে দ্বিধাবিভক্তির সৃষ্টি হয়। এ জন্য বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ দায়ী করে বৃহৎ প্রতিবেশী দেশটিকে।
ভারতের অন্য প্রতিবেশী দেশের মধ্যে মিয়ানমারের সাথে দিল্লির অনেক পুরনো সম্পর্ক যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে বিরোধও। সামরিক শাসনের একটি বড় সময়ব্যাপী ভারতের সাথে মিয়ানমারের সম্পর্ক স্বচ্ছন্দ ছিল না। মনিপুর সীমান্তে রয়েছে দুই দেশের ভূখণ্ডগত বিরোধ। বাংলাদেশের মতো মিয়ানমারের বিরুদ্ধেও দিল্লির অভিযোগ রয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় দেয়ার ব্যাপারে। সাম্প্রতিক কালে অবশ্য বর্মি সরকারের সাথে দিল্লির সম্পর্ক কিছুটা উন্নত হয়েছে।
দ্বীপমালার ছোট দেশ মালদ্বীপে ভারতের সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ভারতের অনেক দূর এগিয়েছিল নাশিদ কামালের শাসনামলে। দেশটির দুটি দ্বীপে রাডার ঘাঁটি স্থাপন করে ভারত। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এবার নাশিদকে নতুন করে ক্ষমতায় আনার জন্য চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার কারণে মালদ্বীপে ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা এগোতে পারছে না।
চীনের সাথে ভারতের রয়েছে বহুমুখী বিরোধ। ১৯৬২ সালে এ নিয়ে যুদ্ধ হয়েছে দুই দেশের মধ্যে। সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীনের সাথে ভারতের ব্যবধান অনেক। দুই দেশের মধ্যে আকসাই, চীন, তিব্বত ও অরুণাচল নিয়ে রয়েছে সীমান্ত বিরোধ। এ নিয়ে লাদাখে সাম্প্রতিককালে একাধিকবার উত্তেজনাও দেখা গিয়েছিল। চীন ঐতিহাসিকভাবে অরুণাচলকে তার ভূখণ্ডের অংশ বলে মনে করে। অন্য দিকে লাদাখের চীনা নিয়ন্ত্রিত অংশকে ভারত তাদের ভূখণ্ড বলে মনে করে। তিব্বতকেও ভারতের অংশ বলে দাবি করে দিল্লি। এই দাবি-পাল্টা-দাবি নিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক নানা ধরনের সহযোগিতা চুক্তির পরও স্বাভাবিক হয়নি।
বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সাথে প্রতিবেশীদের যে সম্পর্ক দেখা যায় তেমনটা প্রত্যক্ষ করা যায় না ভারতের ক্ষেত্রে। উত্তর আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রতিবেশী হলো কানাডা ও মেক্সিকো। যুক্তরাষ্ট্রের মতো এত বিশাল পরাশক্তির কখনো এই দুই দেশের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি প্রয়োগের ঘটনা শতাব্দীকালে দেখা যায় না। দুই প্রতিবেশী দেশই আমেরিকায় যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করে তার চেয়ে বেশি পণ্য রফতানি করে বছরের পর বছর। যুক্তরাষ্ট্রে মেক্সিকানদের অভিবাসীর সংখ্যা বিপুল। অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন নিয়ে সুসম অংশীদারিত্ব চুক্তি রয়েছে দুই দেশের মধ্যে। কানাডার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল বাজার হলো যুক্তরাষ্ট্র। শুধু ২০১৩ সালের ১১ মাসে যুক্তরাষ্ট্র্রের সাথে কানাডার ৩১ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ছিল। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মেক্সিকোর বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ছিল ৫ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে বেশি। এর বাইরে ল্যাটিন আমেরিকার অন্য দেশগুলোর সাথেও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি।
ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির প্রতিবেশীদের ক্ষেত্রে অনেকটা একই প্রবণতা লক্ষ করা যায়। অথচ ভারতের প্রতিবেশীদের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সম্পর্ক একেবারেই উল্টো। সার্কের প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্রের ভারতের সাথে রয়েছে বিপুল বাণিজ্যঘাটতি। ভারত এসব দেশের বাজারে আগ্রাসীভাবে প্রবেশের সুযোগ পেলেও দেশটির রক্ষণশীল নীতি ও নানা ধরনের অশুল্কগত বাধার কারণে সার্কের অন্য দেশের পণ্য ভারতে সেভাবে রফতানি হতে পারে না।
ভারতের প্রতিবেশীদের সাথে এই টানাপড়েনের সম্পর্কের একটি মৌলিক কারণ হলো দেশটির প্রতিষ্ঠাকালীন ডকট্রিন। নেহরু ডকট্রিন হিসেবে পরিচিত এই ইন্ডিয়ান ডকট্রিনে বলা হয়েছে, ‘ভারত অবশ্যই তার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করবে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজেকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলবে ভারত। এখানকার ছোট জাতিরাষ্ট্রগুলোর বিলোপ ঘটবে। এগুলো সাংস্কৃতিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে থাকবে, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন থাকবে না।’ (India will inevitably exercise an important influence. India will also develop as the centre of economic and political activity in the Indian Ocean area. The small national state is doomed. It may survive as a culturally autonomous area but not as an independent political unit.) কাশ্মিরে দখলদারিত্ব বজায় রাখা, হায়দরাবাদ ও সিকিমকে ভারতীয় ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া আর নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপকে ভারতের রাডারভুক্ত করে নেয়ার চলমান প্রচেষ্টার সাথে এই ডকট্রিনের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বিগত ২৯ ডিসেম্বরের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার জন্য বাসার বাইরে পুলিশের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার পর কিছু বক্তব্য রেখেছেন। সেখানে তিনি সিকিমের পতনের কথা তুলে ধরে লেন্দুপ দর্জির প্রসঙ্গ নিয়ে আসেন। সিকিম ও হায়দরাবাদের প্রসঙ্গ এখন অনেকেই নিয়ে আসছেন বাংলাদেশের এখনকার অবস্থার সাথে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাযুজ্য দেখে। ভারতের খ্যাতনামা ইংরেজি দৈনিক হিন্দু পত্রিকায় বাংলাদেশের সরকার বিরোধী আন্দোলন দমনে ভারতীয় বাহিনীর অংশগ্রহণের অভিযোগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর কয়েকটি অনলাইন পত্রিকায় এ সংক্রান্ত কিছু দলিলপত্র প্রকাশ করা হয়েছে। এসব দলিলের সত্যাসত্য যাচাই করা কঠিন। তবে এখন এমন এক ধরনের ধূম্রজাল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যার সাথে সিকিম হায়দরাবাদের মিল পাওয়া যায়।
ভারতের দণিাংশে মুসলমান অধ্যুষিত এক রাজ্যের নাম ছিল হায়দরাবাদ। সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ১৭২১ সালে মোগল সুবাদার কামারুদ্দীন খান হায়দরাবাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং নিজাম-উল-মূলক উপাধি নিয়ে রাজ্য শাসন করতে থাকেন। ১৯৪৭ সালে ১৫ আগস্ট ভারত বিভক্তির সময় স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত ভারত হায়দরাবাদে নানা রকম অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করলে সর্বশেষ নিজাম তা কঠোর হাতে দমন করেন। এরপর ১৯৪৮ সালের জুলাই মাসে জওয়াহের লাল নেহরু ঘোষণা করেন, ‘যখন প্রয়োজন মনে করব তখন হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান শুরু করা হবে।একপর্যায়ে ভারত হায়দরাবাদের ব্যাপারে বেশ কিছু পরিকল্পনা নেয়, যার অংশ হিসেবে সেখানে কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকদের সক্রিয় করা হয়। কলুষিত করা হয় রাজনীতিকে। শিাঙ্গন, সাংস্কৃতিক জগৎ, বুদ্ধিজীবী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনুগত লোক তৈরি করা হয়। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অনুগত দালাল সৃষ্টি করা হয় এবং উগ্রপন্থীদের দিয়ে নানা রকম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটানো হয়। কংগ্রেসের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু মহাসভা, আরএসএস ও আর্যসমাজ এতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ১৯৪৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তেলেঙ্গানায় কমিউনিস্ট বিদ্রোহ দমনের অজুহাতে অপারেশন পোলোনামে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী হায়দরাবাদে আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণ শুরুর আগেই স্বাধীন হায়দরাবাদের সেনাপ্রধান আল ইদরুসকে কিনে নেয় দিল্লি। আল ইদরুস দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত অরতি রেখে সেনাবাহিনীকে অপ্রস্তুত অবস্থায় নিয়ে ঠেকায়। এরপর ভারত হায়দরাবাদে শুরু করে চতুর্মুখী সামরিক আক্রমণ। প্রথমে ট্যাংক এবং এরপর বিমান আক্রমণে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে একাত্ম হয়ে উগ্র সংগঠনগুলো হায়দরাবাদে নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। বিমান হামলায় শহর-বন্দর-গ্রাম গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। এই ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর উদ্দেশ্য ছিল হায়দরাবাদের শেষ নিজামকে মতাচ্যুত করা। অনেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গিয়েও ব্যর্থ হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর ভারতীয় বাহিনী রাজধানীর পতন ঘটায় আর হায়দরাবাদ ভারতের অংশে পরিণত হয়। এরপর হায়দরাবাদকে অন্ধ্র, কর্নাটক ও মহারাষ্ট্র এই তিন রাজ্যে বিভক্ত করা হয়।
সিকিম ছিল হিমালয়ের কোলঘেঁষা এক স্বাধীন দেশ। ১৯৭১ সালে দেশটি জাতিসঙ্ঘের সদস্যপদ লাভ করে। একই বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সিকিমকে ভারতের অঙ্গীভূত করার সিদ্ধান্ত নেন বলে উল্লেখ করেন ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক কর্মকর্তা অশোক রায়না তার ইনসাইড রবইয়ে। সিকিম দখলের ব্যাপারে এতে তিনি উল্লেখ করেছেন, নয়াদিল্লি ১৯৭১ সালে সিকিম দখলের পরিকল্পনা করে। এরপর র দুই বছর ধরে তা বাস্তবায়নের জন্য সিকিমের ভেতরে ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে থাকে। এ লক্ষ্যে সিকিমে বসবাসরত নেপালি বংশোদ্ভূত হিন্দুদের মধ্যে নানাভাবে বৌদ্ধ রাজার বিরুদ্ধে অসন্তোষ তৈরি করা হয়। রাজার বিরুদ্ধে এলিট শ্রেণীকে সংগঠিত ও উত্তেজিত করা হয়। গ্যাংটক টাইমসের সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী সিডি রায় সে সময়টাকে ঠিক এভাবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ভাবতে থাকি রাজার দ্বারা নিষ্পেষিত হওয়ার চেয়ে ভারতের অংশ হয়ে থাকাই ভালো।এর পর যখন ভারতীয় বাহিনী সিকিমে প্রবেশ করে তখন সেখানকার মানুষ উল্লসিত হয়। তারা বুঝতে পারেনি যে স্বাধীনতা তাদের চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছে। চীন এ ব্যাপারে গভীরভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করে। কিন্তু ভেতরে শক্ত প্রতিবাদ না থাকায় দেশটির পক্ষে সিকিমের জন্য কিছুই করা সম্ভব হয়নি। লেন্দুপ দর্জির দল সিকিম কংগ্রেসের সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের ব্যবস্থা করা হয়। আর সেই সংসদেই দর্জি ভারতের সাথে সিকিমের একীভূত হওয়ার প্রস্তাব পাস করেন। পরের বার লেন্দুপের দল তেমন কোনো আসনই রাজ্য বিধানসভায় পায়নি। কিন্তু তত দিনে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads