শনিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০১৪

এ কেমন বার্তা!


বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এখন দেশে-বিদেশে যে আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে, তাতে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বিরোধী দলবিহীন ও ভোটারবিহীন এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে না। বিশ্ব সম্প্রদায় সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে দ্রুত একটি নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছে। এ ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম ভারত। ভারতের পত্রিকায় মন্তব্য করা হয়েছে, একমাত্র ভারতের সমর্থনের কারণেই হাসিনা সরকার দশম সংসদ নির্বাচন আয়োজনের সাহস করেছে। তবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করে এখন ভারতীয় পত্র-পত্রিকায়ও ভিন্ন সুর লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকা ‘দি টেলিগ্রাফ’-এ মন্তব্য করা হয়েছে একটি ভুয়া নির্বাচন সত্ত্বেও দিল্লী তার মিত্রের পাশে দাঁড়িয়েছে। শেখ হাসিনার জন্য ভারত ¯্রােতের বিপরীতে সাঁতার কাটছে। তবে ভারতকে এজন্য মূল্য দিতে হবে বলেও পত্রিকাটি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। এদিকে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকা এক সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করেছে, একপক্ষীয় নির্বাচনে মাত্র ২২ শতাংশ ভোটে ক্ষমতাসীন সরকারই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে আবারও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে গণতন্ত্রের মাপকাঠিতে নতুন সরকারের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ কিংবা সরাসরি অবৈধ। লক্ষণীয় বিষয় হলো, ভারতীয় পত্র-পত্রিকায়ও এখন দশম সংসদ নির্বাচনকে ভুয়া এবং নতুন সরকারকে অবৈধ হিসেবে মন্তব্য করা হচ্ছে।
আমরা জানি যে, বিরোধী দলবিহীন ও কারচুপির এই নির্বাচন বিশ্বসম্প্রদায় মেনে নেয়নি। এমন একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারকে ভারতের পত্রিকায়ও অবৈধ সরকার হিসেবে মন্তব্য করা হচ্ছে। অথচ বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এমন একটি সরকারকে দৃঢ়ভাবে হাল ধরার পরামর্শ দিলেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন। টেলিফোনে শিবশঙ্কর মেনন শেখ হাসিনাকে কিছু পরামর্শও দিয়েছেন। এই পরামর্শের মূল সুরটা হলো, শেখ হাসিনা যেন কঠোর হাতে বিরোধী দলের আন্দোলন তথা পরিস্থিতির মোকাবিলা করেন। শিবশঙ্কর মেনন পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে যেন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মূল ¯্রােতে নিয়ে আসা হয় এবং তা করা হলে বাংলাদেশের সমাজে সংখ্যালঘুদের গুরুত্ব ও জোরের জায়গা আরো বাড়বে। পায়ের তলায় লড়াই-এর বাড়তি জায়গাটুকু পাবেন হিন্দু সম্প্রদায়। প্রত্যন্ত গ্রাম-গঞ্জে জামায়াতের একতরফা অত্যাচারের মোকাবিলা তারা নিজেরাই করতে পারবেন সামাজিক শক্তিকরণের মাধ্যমে। শিবশঙ্কর মেনন আরো পরামর্শ দেন, ক্ষমতায় আসার পর কোনোরকম নরম মনোভাব না নিয়ে শক্ত হাতে সবরকম হিংসাত্মক আন্দোলন রুখতে হবে হাসিনাকে।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে একথা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, শিবশঙ্কর মেননের পরামর্শ বেশ ভাল লেগেছে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার। এজন্যই হয়তো গত শুক্রবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত জনসভায় শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘যতটুকু কঠোর হওয়া যায় ঠিক ততটুকুই হবো’। প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে পর্যবেক্ষক মহলে দেখা দিয়েছে হতাশা। বিরোধী দলকে দমন-পীড়নের সব অস্ত্রই তো ব্যবহার করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। আরো কিছু কি বাকী রয়েছে কঠোর হওয়ার? এবার ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননের টেলিফোন বার্তার পর আওয়ামী লীগ সরকার নিপীড়নমূলক আর কি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করে সেটাই এখন দেখার বিষয়। এখন তো বিরোধী দলের কোনো নেতা কোনো জায়গায় বক্তব্য রেখে নিরাপদ থাকতে পারছেন না। বক্তব্য রাখার পরেই তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে এবং রিমান্ডের যাঁতাকলে পিষ্ট করার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এমন আচরণের মাধ্যমে সরকার আসলে নিজেদেরকে অগণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। এখানে বলার বিষয় হলো, বাংলাদেশের জনগণ কখনো অগণতান্ত্রিক কিংবা ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে মেনে নেয়নি, এবারও যে মেনে নেবে না তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, তবে এবার যে বিষয়টি বাংলাদেশের জনগণকে ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত করেছে তা হলো, বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারতের দৃষ্টিকটূভাবে নাক গলানো এবং নির্বাচনপরবর্তী সরকারকে ডিক্টেট করার মানসিকতা। মানুষের মনে এখন প্রশ্ন জেগেছে, বাংলাদেশের সরকার ও রাজনীতি কি শিবশঙ্কর মেননদের নির্দেশনায় পরিচালিত হবে? এমনটি হলে তো আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অহঙ্কারে আঁচ লাগবে। জনগণের গণতান্ত্রিক চেতনায়ও আঘাত হানা হবে। বাংলাদেশের জনগণ কোনো বন্ধু রাষ্ট্রের কাছে এমন অগণতান্ত্রিক ও আগ্রাসী ভূমিকা কামনা করে না। বাংলাদেশের জনগণ ভারতের জনগণের সাথে মৈত্রীর বন্ধনকে দৃঢ় করতে চায়। কিন্তু শিবশঙ্করদের এমন আচরণে তা কতটা সম্ভব হবে? মৈত্রীর বন্ধন দৃঢ় করার প্রথম শর্তই হলো, পরস্পরের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। কারো আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলানোও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, ভারত সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এইসব ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। বরং তারা আধিপত্যবাদী মনোভাব প্রদর্শনের মাধ্যমে আস্থার সংকট সৃষ্টি করছে। এইসব ভূমিকা পরিহার করলেই ভারতের সাথে বাংলাদেশের মৈত্রীর বন্ধন দৃঢ় হতে পারে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সবাই উপলব্ধি করলেই মঙ্গল।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads