বুধবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৪

কূটনীতিকদের হতাশা এবং সরকারের বৈধতা


বিরোধী দলগুলোকে বাইরে রেখে আয়োজিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এবং ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ ও সরকারের বিষয়ে গভীর হতাশা ও সংশয় প্রকাশ করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত ২৫টি দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকরা। দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, গত ১৩ জানুয়ারি বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনের প্রকৃত চিত্র তথা ব্যালট পেপার ছিনতাই, ভোট জালিয়াতি এবং ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের নামমাত্র উপস্থিতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নির্মিত ভিডিও চিত্র দেখানো হয়েছে। ঠিক কত শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন সে বিষয়েও তথ্য-প্রমাণসহ পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন বিএনপির নেতারা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কতটা ন্যক্কারজনকভাবে সরকার সংবিধান লংঘন করেছে তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে জানিয়েছেন, কথিত ‘সর্বদলীয়’ সরকার গঠন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ জনকে নির্বাচিত ঘোষণা করা, দশম সংসদের সদস্য নামধারীদের শপথবাক্য পাঠ করানো এবং ১২ জানুয়ারি মন্ত্রিসভা গঠন ও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের শপথ গ্রহণ পর্যন্ত কোনো কিছুই সংবিধানসম্মত হয়নি। সব বিষয়ে জানার ও শোনার পর কূটনীতিকরা তাদের মূলকথায় অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা বলেছেন, তারা মনে করেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জনগণের মতামতের বিশ্বাসযোগ্য প্রতিফলন ঘটেনি। জনগণ ভোটও দেয়নি। ড্যান মজীনা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে বিএনপির সংলাপ অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে সব দলের অংশগ্রহণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নতুন একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। উল্লেখ্য, সোমবারের ওই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানিসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকদের পাশাপাশি চীন, ভারত, পাকিস্তান, মরক্কো ও সৌদী আরবের কূটনীতিকরাও উপস্থিত ছিলেন।
আমরা মনে করি, অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে আয়োজিত নির্বাচন এবং সে নির্বাচনের ভিত্তিতে গঠিত সংসদ ও সরকারের ব্যাপারে ২৫টি দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকদের এই হতাশা ও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া খুবই আশঙ্কাজনক। এর মধ্য দিয়ে দেশগুলো আসলে একথাই জানিয়ে দিয়েছে যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত নতুন সরকারকে তারা জনগণের নির্বাচিত সরকার বলে মনে করে না। কথাটার অর্থ নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলার দরকার পড়ে না। ধরে নেয়া যায়, ব্যবসা-বাণিজ্য, ঋণ-সাহায্য ও দ্বিপাক্ষিক চুক্তিসহ ™ি^পাক্ষিক নানা বিষয়ে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের সঙ্গে দেশগুলো দূরত্ব বজায় রাখবে। অনেক ক্ষেত্রে পাশও কাটিয়ে চলবে। অর্থাৎ নতুন সরকারকে তারা সত্যিকারের নির্বাচিত সরকারের মর্যাদা দেবে না। বিষয়টিকে অবশ্যই হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ, নির্বাচনের পর এক সপ্তাহেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এক ভারত ও নেপাল ছাড়া অন্য কোনো দেশই নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানায়নি। এর অর্থ, সরকারকে তারা স্বীকৃতি দেয়নিÑ যেমনটি সাধারণত অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। এ প্রসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। দেশটির পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ১৪ জানুয়ারি অর্থাৎ নির্বাচনের নয়দিন পর বলেছেন, অনুষ্ঠিত নির্বাচন ও তার ফলাফল নিয়ে হতাশা ও সংশয় থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখবে। কথাটার মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ অপ্রকাশিত থাকেনি। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, একমাত্র ভারত ছাড়া অন্য কোনো দেশই সরকারকে ‘উষ্ণ’ অভিনন্দন জানায়নি। শুধু তা-ই নয়, বৃটেন তো এরই মধ্যে দুটি প্রকল্প সাহায্য বন্ধ করারও ঘোষণা দিয়েছে। একই ধরনের, এমনকি তার চাইতেও মারাত্মক সিদ্ধান্ত আসতে পারে বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর পক্ষ থেকে। আশঙ্কার কারণ হলো, এই দেশগুলো শুধু যদি জিএসপি সুবিধা বাতিল করে এবং আমদানি কমিয়ে দেয় তাহলেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত একেবারে মুখ থুবড়ে পড়বে।
সমগ্র এ প্রেক্ষাপটেই আমরা মনে করি, প্রতিক্রিয়া ও বিভিন্ন নেতিবাচক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে বিদেশীরা মূলত যে মেসেজ বা বার্তা দিচ্ছেন বা দিতে চাচ্ছেন, সরকারের উচিত তার মর্মার্থ অনুধাবন করা। ক্ষমতাসীনদের একই সঙ্গে অন্তরালের প্রকৃত কারণ সম্পর্কেও বুঝতে হবে। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে বাইরে ঠেলে দিয়ে নির্বাচনের নামে প্রহসন করাটাই আসলে প্রধান কারণ। দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া হয়তো এতটা মারাত্মক ও প্রত্যক্ষ হতো না আগে থেকে তারা যদি নির্বাচনমুখী ঘটনাপ্রবাহে জড়িত না থাকতো এবং সরকার ও বিরোধী দলের বক্তব্য ও ভূমিকা যদি লক্ষ্য না করতো। অন্যদিকে প্রায় সব রাষ্ট্রই নানাভাবে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠানের ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছে। নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য ক্রমাগত তাগিদ দিয়েছে। মূলত এসব দেশের আগ্রহেই জাতিসংঘের মহাসচিব পর্যন্ত উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি শুধু দুই নেত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথাই বলেননি, তাদের কাছে চিঠিও লিখেছিলেন। সবশেষে পাঠিয়েছিলেন তার বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে। কিন্তু সব চেষ্টাকেই ক্ষমতাসীনরা ব্যর্থ করে দিয়েছেন। এরই প্রভাব পড়েছে নির্বাচন এবং নির্বাচনের পর গঠিত সরকারের প্রতি নীতি ও মনোভাবের ওপর, যার পরিণতি হতে পারে অশুভ এবং দীর্ঘমেয়াদী। আমরা মনে করি, ক্ষমতাসীনদের উচিত নিজেদের একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাকে পরিত্যাগ করা এবং দেশের ১৬ কোটি মানুষসহ বিদেশীদের পরামর্শ ও আহ্বানের প্রতি সম্মান দেখানো। এজন্য এখনই প্রথমে দরকার ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এবং তার মাধ্যমে গঠিত দশম সংসদ ও মন্ত্রিসভা বাতিল করা এবং তারপর সংবিধানে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের বিধান যুক্ত করে সে সরকারের অধীনে নতুন করে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা। অশুভ পরিণতি এড়াতে চাইলে এবং দেশকে অযথা বিপদের মুখে ফেলার ইচ্ছা না থাকলে ক্ষমতাসীনদের সামনে এটাই একমাত্র বিকল্প রয়েছে। তাদের উচিত অযথা সময় নষ্ট না করা।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads