বুধবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৪

এবার বৈধতার সঙ্কট


গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরের সর্বোত্তম ও গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা হলো নির্বাচন। সেই নির্বাচনকে হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ। এ জন্য দরকার সব দলের সমান অংশগ্রহণ। দরকার একটি গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া, যেখানে নির্বাচন কমিশন শাসন বিভাগের প্রভাবমুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে নির্বাচনকার্য পরিচালনা করতে পারবে। বাংলাদেশে গত ৫ জানুয়ারি বিরোধী জোটের অংশগ্রহণ ছাড়াই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনে স্বল্পসংখ্যক ভোটারের অংশগ্রহণ, ১৫৩ জন প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া, প্রধান বিরোধী দলসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল অংশ না নেয়া, জাল ভোট প্রদানসহ নানা কারণে ইতোমধ্যেই নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। 

নির্বাচনের উদ্দেশ্য হলো একাধিক বিকল্প থেকে উত্তম বিকল্পটি বাছাই করা। গণতন্ত্রে নির্বাচন মানে হলো সর্বোত্তম জনপ্রতিনিধি বাছাইয়ের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা হস্তান্তর। এরূপ প্রক্রিয়ায় সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়, যার চূড়ান্ত অর্জন হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা। অনেক সন্দেহ আর উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে নির্বাচন হলো। আমরা নির্বাচন দেখলাম। হয়তো সরকারও গঠন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীসহ তার মন্ত্রিসভাও শপথ নিয়েছে; কিন্তু পাঁচ তারিখ নিয়মরক্ষার আর একগুঁয়েমির যে নির্বাচন হলো, এতে কি আদৌ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আর গণতান্ত্রিক ধারবাহিকতা রক্ষা হবে? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কি শক্তিশালী হবে নাকি আরো ভেঙে পড়বে? সাংবিধানিক প্রাধান্য কি বজায় থাকবে নাকি সংবিধানের ওপর চালানো হবে খড়গ? রাজনৈতিক সঙ্কটের কি অবসান হবে? অবাধে কি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে? এসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য হয়তো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।

নির্বাচনে কারচুপি কিংবা নির্বাচনকে প্রভাবিত করার ফলাফল কখনোই ভালো ছিল না। সত্তরের নির্বাচনের ফলাফলকে নস্যাৎ করার জন্য নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তান সরকার বাঙালি জাতির ওপর যে গণহত্যা চালায় তার ফলাফল হিসেবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। ২০০৭-এ বিএনপি নির্বাচনকে প্রভাবিত করা চেষ্টা করেছিল। তার পর ফলাফল দুই বছরের অগণতান্ত্রিক সরকার। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো এত খারাপ অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘ ৪২ বছর পরও ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ঐকমত্যের ভিত্তিতে কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা তৈরি করা যায়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু মীমাংসিত হওয়ার পরও সংবিধানের মূলনীতির দোহাই দিয়ে সেটার কবর রচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশে দীর্ঘ ৪২ বছরে যে রাজনৈতিক সঙ্কট ও সামরিক হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে, সেখানেও প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে কাজ করেছে নির্বাচনব্যবস্থার জটিলতা, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা, নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতা, নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা। 

সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নামে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে এমন নির্বাচন এর আগে হয়নি। তবে এর নিকটবর্তী দুটি ইতিহাস পাওয়া যায়। একটি ৩ মার্চ ১৯৮৮ সালের চতুর্থ সংসদ নির্বাচন আর অন্যটি ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তবে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে এবারের নির্বাচন। এবার দেশে মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল ৯ কোটি ১৯ লাখ ৬৫ হাজার ৯৭৭ জন। নির্বাচন হওয়ার আগেই ভোটাধিকার হারিয়েছে চার কোটি ৮০ লাখ ২৭ হাজার ৩৯ জন ভোটার। আর ভোট দেয়ার কথা ছিল চার কোটি ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৮ জন; কিন্তু নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, মোট ভোট দিয়েছে মাত্র এক কোটি ৬৫ লাখ ৩০ হাজার ৭৭৫ জন। এর মধ্যে আবার বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত  ছবিতে জাল ভোটের সংখ্যাও হয়তো হবে অর্ধেক কিংবা তারও বেশি। এর আগে কোনো নির্বাচনে এত ভোটার ভোটদান থেকে বঞ্চিত হয়নি কিংবা বিরত থাকেনি।

একটি তুলনামূলক আলোচনা প্রয়োজন। ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দল ছিল ৮টি সেখানে ১৯৯৬-তে ছিল ৪১টি আর এবার মাত্র ১২টি। প্রার্থীর সংখ্যার দিক থেকে ১৯৮৮-তে ছিল ১১৯২ জন, ১৯৯৬-তে ছিল ১৪০১ জন আর এবার মাত্র ৩৯০ জন। ১৯৮৮-তে মোট ভোট পড়েছিল ৫১.৮১ শতাংশ, ১৯৯৬-তে ২১ শতাংশ; কিন্তু এবার ভোট হওয়ার আগেই দেশের ৫২.২২ শতাংশ মানুষ ভোটের অধিকার হারায়। নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী বাকি ভোটের মাত্র ৩৯.৮১ শতাংশ ভোট পড়েছে; কিন্তু গণমাধ্যমে প্রচারিত খবর ও বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে প্রদত্ত ভোটের হার ১৫ শতাংশের বেশি হবে না। নির্বাচন কমিশনের হিসাবেও যদি ধরা হয়, তা হলেও দেশের ৮২.০৩ শতাংশ মানুষ ভোট দেয়া থেকে বিরত থেকেছে কিংবা ভোটের অধিকার হারিয়েছে। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে সম্ভবত সর্বকালের সব রেকর্ড ভেঙেছে এবার। ৮৮-তে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৮ জন, ৯৬-তে ৪৯ জন আর এবার ১৫৩ জন নির্বাচিত হয়। 

পৃথিবীর কোথাও এমন নির্বাচনের নজির আছে কি না জানা নেই। ভোটের দিন দেখা গেল অধিকাংশ কেন্দ্রেই ভোটারদের লম্বা কোনো লাইন নেই। ভোটারদের মধ্যে কোনো উৎসাহ নেই। দেশের বিভিন্ন স্থানে ৪৬ কেন্দ্রে একজন ভোটারও উপস্থিত হননি। কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে এমনও খবর বের হয়েছে, এক ঘণ্টায় মাত্র একটি ভোট পড়েছে। কিছু কিছু পত্রিকায় এমন ছবি ছাপানো হয়েছে যেখানে পোলিং এজেন্টরাই ভোট দিচ্ছে আবার কিছু কেন্দ্রে পোলিং এজেন্টদের সামনেই সরকারি লোকেরা জাল ভোট দিচ্ছে। ৮৮ আর ৯৬ এর পরে মানুষ আরেকবার দেখলো নির্বাচনের এমন চিত্র। আর যাই হোক এমন নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার দিয়ে রাষ্ট্র চালানো কঠিন।

অতীতে অনুষ্ঠিত  দুটি নির্বাচন দেশ গঠন, রাষ্ট্রপরিচালনা, সঙ্কটের সমাধানে তেমন ভূমিকা রাখেনি। তবে ৯৬-এর ফেব্রুয়ারির সরকার তুলনামূলক ব্যতিক্রম ছিল। তারা একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার উপহার দিয়ে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ায়; কিন্তু ৮৮ সরকার রাষ্ট্রপরিচালনার ব্যর্থতার দায় নিয়ে সংসদের ৭টি অধিবেশন শেষে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা ছাড়ে। ৯৬-এর সংসদের মেয়াদ ছিল মাত্র ১২ দিন। এখন দেখার বিষয় এই সরকার কিংবা সংসদ কত দিন টিকে। 

যেভাবে এই নির্বাচন হলো তা ভবিষ্যতে তিন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হবে। প্রথমত; বৈধতার সঙ্কট, দ্বিতীয়ত; অংশগ্রহণের সঙ্কট, তৃতীয়ত; এর ফলে যে সংসদটি গঠিত হবে সেটি হবে একটি রাবার স্ট্যাম্প সংসদ। এই নির্বাচনের আসলে এক দিকে যেমন বৈধতার সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে তেমনিভাবে অংশগ্রহণের সঙ্কটও সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতিতে শাসন কর্তৃপক্ষের বৈধতার অভাব রাজনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। একটি কর্তৃপক্ষ বৈধ কি না তা প্রধানত নির্ভর করে ওই কর্তৃপক্ষ জনগণ বা অন্য কোনো বৈধ সংস্থা কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত কি না অর্থাৎ জনগণের সম্মতির ওপর নির্ভরশীল কি না এবং ওই কর্তৃপক্ষ জনগণের কল্যাণের লক্ষ্যে কাজ করছে কি না তার ওপর। সাংবিধানিক দিক থেকে এর বৈধতা থাকলেও প্রকৃত প্রস্তাবে নৈতিকতা এবং জনসমর্থনের দিক থেকে এর অবস্থান নেই বললেই চলে। তা ছাড়া রাজনৈতিক অংশগ্রহণের দিক থেকে বিশ্লেষণ করলেও এর ভিত্তি টিকে না। রাজনৈতিক অংশগ্রহণ প্রধানত নির্ভর করে জনগণের অংশগ্রহণের ইচ্ছার ওপর এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণমূলক চরিত্রের ওপর। যখন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে না, তখন অংশগ্রহণের সঙ্কট দেখা যায়। যেখানে দেশের ৮২.০৩ শতাংশ তাদের ইচ্ছা প্রকাশের সুযোগই পায় না; তখন নির্দ্বিধায় বলা যায় যে এ সরকারব্যবস্থায় অংশগ্রহণের সঙ্কট দেখা দেবে।

দেশী-বিদেশী বিভিন্নপর্যায় থেকে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার নির্বাচন সম্পর্কে বলেছেন, অপারেশন সাকসেসফুল, বাট পেশেন্ট ইজ ডেড। জাতিসঙ্ঘসহ উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোও এতে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছে। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব বান কি মুন এক বিবৃতিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের প্রত্যাশার প্রতি সাড়া দিয়ে শিগগিরই অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও অর্থবহ সংলাপ শুরুর তাগিদ দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র পুনর্নির্বাচনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা প্রকাশের সুযোগ আছে বলে মতামত দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া যত দ্রুত সম্ভব একটি নতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছেন। নির্বাচনের আগে দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হওয়ায় তারা হতাশা প্রকাশ করেছে। জাপান, জনগণের আশা-আকাক্সা পূরণ হয় এমন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে অনুরোধ জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক মহল এই নির্বাচনকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান না করলেও, এটি যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ নয় তা তাদের কথায় স্পষ্ট। 

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসন বিভাগের তথা সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে শক্তিশালী ও সার্বভৌম সংসদের কোনো বিকল্প নেই; কিন্তু স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের জনগণ সেই অর্থে কোনো সার্বভৌম সংসদ দেখতে পায়নি। এই নির্বাচনের মাধ্যমে যে একটি রাবার স্ট্যাম্প টাইপের সংসদ হচ্ছে তা বলতে দ্বিধা নেই, যা শতভাগ শাসন বিভাগের অনুগত থাকবে। কারণ নির্বাচনী প্রচারণার সময় দেখা গেছে জাতীয় পার্টির এক প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যানারে লেখা যা নৌকা তাই লাঙ্গল। তাহলে তো যা সরকারি দল তাই বিরোধী দল। আর ছোট যে দলগুলো রয়েছে তারা তো নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগেই একীভূত হয়ে গেছে। বিরোধী দলবিহীন কিংবা সরকার দল কর্তৃক সৃষ্ট গৃহপালিত বিরোধী দল দিয়ে আর যাই হোক সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। 

সুতরাং গণতন্ত্রের স্বার্থে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ টিকিয়ে রাখার স্বার্থে, জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জন্য সরকারকে নতুন করে ভাবতে হবে। নতুন করে আলোচনা শুরু করতে হবে। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে এমন একটি ব্যবস্থা বের করতে হবে।

যদি সমঝোতা না হয়, তাহলে জবাবদিহিহীন সরকারের দুর্নীতি বৃদ্ধি পেতে পারে আরো বহুগুণে। রাজনৈতিক সঙ্ঘাতের কারণে ভেঙে পড়তে পারে রাষ্ট্রব্যবস্থা। ভেঙে পড়বে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো। প্রকৃতপক্ষে অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার পাশাপাশি রাষ্ট্রকাঠামোকে শাক্তিশালী করা সম্ভব। রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে না দিয়ে, খুব দ্রুত একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এটাই  কাম্য। 


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads