শনিবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৪

সংখ্যালঘু ট্রাম্পকার্ড


আবহমান কাল থেকে বাংলাদেশ সাম্য, শান্তি, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতির এবং পরস্পর একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীলতার দেশ। এখানে কখনোই ধর্মীয় কারণে কোন দাঙ্গা হয়নি। এ জনপদের মুসলমানরা ধর্মীয় কারণে অথবা ধর্মীয় বিদ্বেষ নিয়ে অন্য ধর্মাবলম্বীদের উপর আক্রমণ করেনি। বরং আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে অসংখ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে প্রায়ই মুসলমানরা হামলার শিকার হয়। তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়, হত্যা করা হয়, মুসলমানদের জীবন্ত দগ্ধ করা হয়। একই অবস্থা আরাকানে। সেখানে মুসলমানদের বাড়িঘর দোকানপাট গুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, নিরীহ মুসলমানদের হত্যা করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। এমনকি রোহিঙ্গা মুসলমানদের সকল প্রকার রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। তাদের কোন প্রকার রাষ্ট্রীয় এবং মানবিক অধিকার নেই, কেড়ে নেয়া হয়েছে তাদের নাগরিকত্ব। এর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। শতকরা আশি ভাগ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশে। মুসলমানরা সংখ্যাগুরু কিন্তু তাই বলে এখানে অন্য ধর্মাবলম্বীদের উপর কোন প্রকার নিপীড়ন কিংবা রাষ্ট্রে তাদের আলাদা চোখে দেখা হয় না এবং ইসলাম এটা সমর্থন করে না বরং অন্য ধর্মাবলম্বীরা সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা সমভাবেই ভোগ করে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সচিব, জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন পদে তারা কর্মরত। বরং দেখা যায় কোন কোন ক্ষেত্রে তারা মুসলমানদের মধ্যে যারা ধর্মীয় অনুশাসন পালন করে তাদের চেয়ে বেশি সুবিধা ভোগ করে। বাংলাদেশে বরং রাষ্ট্রের বড় বড় পদে তারা নিয়োজিত আছে। তারা যেমন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায় তেমনি মিডিয়াও তাদের প্রতি সব সময় আনুকূল্য প্রদর্শন করে আসছে। বাংলাদেশে একই সময়ে যখন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের লোকজনের বাড়িঘর গুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, গণ গ্রেফতার করা হচ্ছে, প্রতিদিন শত শত মিথ্যা মামলা দেয়া হচ্ছে, বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছেÑ একই সময়ে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার যেভাবে ফলোআপ হচ্ছে কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের ওপর যৌথবাহিনীর হামলা, মামলা, জুলুম নির্যাতন কিছুই মিডিয়ায় আসছে না। কিন্তু সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ব্যাপারে রিপোর্ট কোন কিছুই বাদ যাচ্ছে না, মিডিয়া প্রতিটি ঘটনাই প্রকাশ এবং প্রচার করছে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে। আওয়ামী লীগ এ দেশের সংখ্যালঘুদেরকে নিজেদের ভোট ব্যাংক বলে মনে করে। তাদের ওপর যত জুলুম নির্যাতনই করা হোক না কেন তারা তাদের পক্ষেই থাকবে এমনই মনে করে আওয়ামী লীগ। ৫ জানুয়ারীর তামাশা এবং প্রহসনকে জনগণ এভাবে প্রত্যাখ্যান করবে আওয়ামী লীগ ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবতে পারে নি। তারা মনে করেছে আর কেউ ভোট কেন্দ্রে না যাক অন্তত আওয়ামী লীগের যে ১৫-২০% ভোটার আছে তারা তো কমপক্ষে ভোট দেয়ার জন্য ভোট কেন্দ্রে যাবে অথবা তাদের গোপন পরিকল্পনা যা, যশোরের অফিল উদ্দিনের বক্তব্যে প্রকাশ পেয়েছেÑ ‘কোন ভোটার দরকার নাই, প্রতি কেন্দ্রে একশত কর্মী সারাদিন ভোট দিবে’। কিন্তু বিধি বাম, সারাদিন ভোট কেন্দ্রগুলো ভোটারের শূন্যতায় খাঁ-খাঁ করেছে। টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকরা এক কেন্দ্র থেকে অন্য কেন্দ্রে ছুটে বেড়িয়েছে। কিন্তু কোথাও তারা ভোটদানরত মানুষের লাইন বা সারিবদ্ধ ভোটারের ছবি তুলতে পারে নি। ৩৬টি ভোট কেন্দ্রে একজন ভোটারও ভোট দিতে যায় নি। অনেক কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৩-৪টি করে। কিন্তু দিনশেষে বিশ্ববিখ্যাত স্বাধীন শক্তিশালী চরম দলীয় আনুগত্যশীল নির্বাচন কমিশন তাকে ২০০-৩০০ দিয়ে গুণ করে প্রচার করেছে। এর সমালোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে সর্বত্র। ভারত ব্যতীত কোন দেশ এ নির্বাচনকে স্বীকৃতি দেয়নি। বরং দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মহল এ তামাসার নির্বাচনী নাটকের ফলাফল বাতিল করে সর্বজনগ্রাহ্য সব দলের অংশগ্রহণে একটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। জনমতকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা এবং আন্তর্জাতিক মহলের করুণা অর্জনের জন্য সংখ্যালঘু নির্যাতনের ট্রাম্পকার্ড ছেড়েছে আওয়ামী লীগ। এ যাবৎ যতটি ঘটনা ঘটেছে তার সাথে প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে আওয়ামী লীগের এবং তাদের অঙ্গ সংগঠন সমূহের নেতা-কর্মীদের। কয়েকটি বিষয় পর্যালোচনা করলেই এর সত্যতা মিলবে। ২০১২ সালে রামুতে বৌদ্ধ বিহারসহ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এর কাজে নেতৃত্ব দেয় সেখানকার স্থানীয় মৎস্যজীবীলীগের নেতা।  ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে উত্তম কুমার বড়ুয়া নামে এক যুবক কর্তৃক পবিত্র কুরআন শরীফ অবমাননাকে কেন্দ্র করে রামু ও উখিয়ায় বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা চালানো হয়। এ ঘটনা নিয়ে সরকারি দল কোনো তদন্ত ছাড়াই বিরোধী দলকে দোষারোপ করে। অথচ ঘটনার মাত্র কয়েক দিন পর ৬ অক্টোবর দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় মূল তথ্য প্রকাশ করে। ঘটনার মূল নায়ক উত্তম কুমার বড়ুয়ার সঙ্গে মোবাইলে তর্ক করা এবং হুমকি দেয়ার পর তার বিরুদ্ধে মিছিলের আয়োজন করেছিলেন উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সেই মিছিলে প্রধানত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই অংশ নিয়েছিলেন। লোক বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মিছিলটি মারমুখী হয়ে উঠেছিল। ওই মিছিলের লোকজনই রামু উপজেলা সদরে বৌদ্ধবিহার ও বৌদ্ধ বসতিতে হামলা চালিয়েছে। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগও তারাই করেছে। দ্বিতীয় দিন তথা ৩০ সেপ্টেম্বরও আওয়ামী লীগের নেতারাই কোর্টবাজার স্টেশনে মিছিল করেছেন। মিছিলে ও সহিংস কর্মকা-ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নেতাদের নামও এসেছে সংবাদপত্রের খবরে। যার বেশ কয়েকটি ছবি দৈনিক আমার দেশ, নয়া দিগন্ত এবং দৈনিক সংগ্রামে ছাপা হয়েছে। কিন্তু সরকার রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য একতরফাভাবে বিরোধী দল বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীকে অভিযুক্ত করে অপপ্রচার চালিয়েছে এবং বিএনপি জামায়াতের নেতাদের নামে মামলা দিয়ে তাদের হয়রানি করেছে যে হয়রানি এখনো বন্ধ হয়নি।
গত ১০ মার্চ ২০১৩ দৈনিক আমার দেশের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয় চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলায় নেতৃত্ব দেয় আ.লীগের বিদ্রোহী গ্রুপ; যেখানে পুলিশের ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। এদিকে এ ঘটনার সাথে জড়িয়ে অনেক সাধারণ মানুষকে মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে টাকা কামাচ্ছে সরকারদলীয় নেতা কর্মীরা। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা, হয় গত সপ্তাহে বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর পুলিশের গুলীর পর আওয়ামী লীগ নেতাদের উস্কানি ও অংশগ্রহণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মন্দিরে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয়। আর এই নাশকতার জন্য পরিকল্পিতভাবে বেছে নেয়া হয় বাঁশখালীর দরিদ্র সংখ্যালঘু পরিবার ও তাদের ব্যবসা প্রতষ্ঠানগুলোকে। সে হামলায় দয়াল হরিনাথ শীল নামের এক বৃদ্ধ মারা যান।
২০১৩ সালের নবেম্বর মাসে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর নির্দেশে এবং তার দলীয় ক্যাডাররা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা করে ব্যাপক লুটতরাজ করে। এ সময় তারা অন্তত ২৫টি বাড়ি এবং মন্দির ভাংচুর লুটপাট এবং বহু মানুষকে হতাহত করে। ঘটনার পরপরই সরকার এবং সরকার সমর্থক মিডিয়াগুলো প্রথমে জামায়াত ও বিএনপি নেতাদের ওপর দোষ চাপিয়ে সরকারের অপপ্রচারের পালে হাওয়া দিতে থাকে। কিন্তু সত্য কখনো গোপন থাকে না। এরপর ওখানকার হিন্দু সম্প্রদায় মুখ খুলতে শুরু করে তারা বলেন হামলার জন্য দায়ী স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী (সাবেক) শামসুল হক টুকু। এ সংক্রান্তু একটি প্রতিবেদন ছাপে দৈনিক কালের কন্ঠ। ঘটনার কয়েকদিন পর বিডি নিউজ ২৪.কম একটি নিউজ করে “সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকারীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদের গ্রেফতার করছে না” বিডি নিউজ তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে “পাবনার সাঁথিয়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর প্রশ্রয় ছিল- এমন অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)। পুরানা পল্টনের প্রগতি সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করেছে সিপিবি-বাসদ। সেই সঙ্গে তারা প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও দাবি জানান। সিপিবি-বাসদের নেতারা বলেন, ওই ঘটনার পর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সেখানে পরিদর্শনে যান। এটি তার নির্বাচনী এলাকা। নিজেদের প্রতিনিধিকে দেখে আশ্বস্ত হওয়া তো দূরের কথা, তার সঙ্গে হামলাকারীদের অনেককে দেখে মানুষ আতঙ্কে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে।
সাঁথিয়ায় ওই হামলার পর সিপিবি-বাসদ প্রতিনিধিদল সরেজমিনে ওই এলাকা পরিদর্শন করে। সংবাদ সম্মেলনে তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বলেন, “পুলিশ সক্রিয় হলে এ ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো। হামলাকারীদের বেশির ভাগই ছিল কিশোর ও তরুণ।”
পাবনায় সংখ্যালঘুদের ওপর যারা হামলা করেছে তাদের বেশ কয়েকটি ছবি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা গেছে হামলাকারীরাই আবার শামসুল হক টুকুর সাথে মিছিল সমাবেশ করছে। ঘটনার কয়েকদিন পর হামলাকারীদের অন্যতম হোতা  শামসুল হক টুকুর বেয়াই তসলিম উদ্দিনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। যদিও সরকারের চাটুকার অধিকাংশ মিডিয়া এ নিউজটি প্রকাশ করেনি। ৫ই জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনের আগে শামসুল হক টুকু বলেছেন যে সব হিন্দুরা ভোট দিতে যাবে না, তাদের খতনা করিয়ে দেয়া হবে। সাংবাদিক সম্মেলন করে এ তথ্য দিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা, সাবেক তথ্যমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাঈদ।
একইভাবে বরিশালের চরকাউয়া এলাকায় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা করেছে ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা। এ সংক্রান্ত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দৈনিক কালের কন্ঠ। ঐ রিপোর্টে বলা হয়, বরিশাল ব্রজমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ২০-২৫ জন নেতাকর্মী নৌকা যোগে কীর্তনখোলা নদী পার হয়ে রাতের আঁধারে চরকাউয়ার হিন্দু পাড়ায় হামলা চালায়। তাদের এ হামলা এবং পরবর্তীতে পালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করে স্থানীয় কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা।
মূলত কাজী রকীব উদ্দিনের প্রহসনের নির্বাচনী নাটকের কয়েকদিন আগ থেকে এবং এর পরে হঠাৎ করে সারাদেশ থেকে সংখ্যালঘু নির্যাতনের সংবাদ আসতে থাকে। সরকারের প্রহসনের নির্বাচন, এবং এ প্রহসনকে বৈধতা দেয়ার জন্য বিরোধীদলের উপর যৌথবাহিনী নামক নব্য রক্ষীবাহিনীর নির্যাতন সব কিছুকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য সংখ্যালঘু নির্যাতনের সংবাদ সর্বত্র অগ্রাধিকার পায়। নির্বাচন পরবর্তী সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে কয়টি ঘটনা মিডিয়ায় প্রচারিত হয় তার মধ্যে সবচেয়ে বড় সংবাদটি হচ্ছে যশোরের মালোপাড়ার। এ বিষয়ে সকলেই দেখেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ওয়াহাবের নির্দেশে তার অনুগত ক্যাডারবাহিনী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট এবং তাদের উপর নির্যাতন করে। এ বিষয়ে ইংরেজী দৈনিক নিউ এজের সম্পাদক নুরুল কবীর একুশে টিভির একটি টকশোতে মিডিয়ার কর্তাব্যক্তিদের উদ্দেশ্য করে অত্যন্ত স্পস্ট ভাষায় বলেছেন, ‘‘আপনারা যারা মিডিয়ায় আছেন তারা যদি এ সত্য প্রচার না করেন তবে আপনারাও সংখ্যালঘু নির্যাতনের অপরাধে অপরাধী হবেন’’
গত ৭ ডিসেম্বর ২০১৩, বগুড়ায় যুবলীগ নেতৃবৃন্দের অত্যাচারের ভয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এলাকা ছাড়ছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায়। এর আগে ৪ ডিসেম্বর ২০১৩ প্রথম আলোর এক সংবাদে বলা হয় বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার গ-গ্রামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর এক যুবলীগ নেতার নির্যাতন বন্ধের দাবিতে জেলা শহরে বিক্ষোভ মিছিল করেছে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। তারা বগুড়া পৌরসভার ১৩ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি আবদুর রউফের অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেয়। এভাবে দেখা যাবে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনায় আওয়ামী লীগ অথবা তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতা কর্মীরা জড়িত। আর তাই সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে আওয়ামী লীগ হৈ চৈ চিৎকার করলেও তারা কোন একটি ঘটনার বিচার করে নাই।  ৫ জানুয়ারির আগে-পরে সংখ্যালঘুদের ওপর যে হামলা হয়েছে-সে ধরনের কয়েকটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, যে জামায়াত করেছে এটা শ্লোগান এর সাথে সরকারি দলের নেতা কর্মীরা জড়িত তাই সরকার এর দায় এড়াতে পারে না। একইভাবে হিন্দু বৌদ্ধ খৃস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারেও বলেছেন যে, এ হামলা এবং নির্যাতনের সাথে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জড়িত। এ বিষয়ে দৈনিক ইনকিলাবে একটি মন্তব্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘সংখ্যালঘু ট্রাম্পকার্ড ছেড়েছে আওয়ামী লীগ’  দৈনিক মানব জমিনও একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে তারা তথ্য প্রমাণসহ রিপোর্ট করেছে যে, সংখ্যালঘু নির্যাতনের সাথে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। আওয়ামী লীগ মূলত তাদের প্রতিটি রাজনৈতিক দুর্যোগে সংখ্যালঘুদের নিয়ে ব্লেইম গেম খেলে। এটি আমরা দেখেছি ১৯৯১ সালে, ২০০১ সালে এবং এ সরকারের আমলে বার বার। ১৯৯০ এ স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর জাতীয় নির্বাচনের আগে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন ‘আওয়ামী লীগ দুই শতাধিক আসন পাবে, বিএনপি পাবে সর্বোচ্চ ১০টি’ কিন্তু নির্বাচনের পর দেখা গেল বিএনপি পেয়েছে ১৪০টি, আর আওয়ামী লীগ পেয়েছে ৮৭টি তখন জামায়াতের সমর্থন এবং সহযোগিতায় বিএনপি সরকার গঠন করেছিল। এ সময় বেশ কিছু যায়গায়  সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে এবং তা নিয়ে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ময়দান উত্তপ্ত করার চেষ্টা করে। একইভাবে ২০০১ সালে চার দলীয় জোট সরকার গঠন করার পর আওয়ামী লীগ এবং তাদের দলীয় আনুগত্যশীল মিডিয়াগুলো সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে মাঠ গরম করে কিন্তু তখন সরকার ত্বরিত পদক্ষেপ নেয়ায় আওয়ামী লীগ এ ষড়যন্ত্র নিয়ে বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। এবারের ঘটনায় শুরু থেকেই সরকার বিএনপি-জামায়াতকে ঘায়েল করার জন্য সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার জন্য বিএনপি এবং জামায়াতকে দায়ী করে একতরফা প্রপাগা-া চালাতে থাকে। সরকারের টার্গেট হচ্ছে জনগণ যেন ৫ জানুয়ারীর তামাসার কথা ভুলে যায়-তাদের দৃষ্টি অন্য দিকে আকৃষ্ট হয়। আন্তর্জাতিক মহল যেন ভাবে এ দেশে সংখ্যালঘুদের জান-মালের নিরাপত্তার জন্য আওয়ামী লীগেরই ক্ষমতায় থাকা দরকার। কিন্তু এবারে তারা একচেটিয়া প্রচার প্রপাগা-া চালালেও বেশ কয়েকটি মিডিয়া এবং নির্যাতিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় স্পষ্ট ভাষায়ই বলেছে এর সাথে বিএনপি জামায়াত নয়Ñ আওয়ামী লীগই জড়িত। তাই তাদের এ অপপ্রচার হালে পানি পায়নি। তাই বলে সরকারের অপপ্রচার এবং ষড়যন্ত্র থেমে নেই। প্রকৃত অপরাধী গ্রেফতারের পরিবর্তে সারা দেশে যৌথবাহিনী নামিয়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের পাইকারী হারে গ্রেফতার করে তাদেরকে সংখ্যালঘু নির্যাতনের মামলায় জড়িত করা হচ্ছে। প্রতিবারই সংখ্যালঘু নির্যাতনের পর এর দায়ভার জামায়াতের উপর চাপিয়ে জামায়াতে ইসলামীকে ঘায়েল করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু কোন একটি ঘটনায় আজ পর্যন্ত জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয় নি। এবারের ঘটনার পর জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল বিবৃতি দিয়ে সরকার এবং আন্তর্জাতিক মহলকে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন যে, ‘‘জাতিসংঘের অধীনে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করে এর সুষ্ঠু বিচারের ব্যবস্থা করার। তিনি তার বিবৃতিতে বলেছেন ‘জামায়াত, সংখ্যালঘুদের মর্যাদা, সম্মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সবসময় সোচ্চার ভূমিকা পালন করে আসছে, এখনো করছে। আমরা সরকারকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে চাই, জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাসে ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপর হামলা ও জ্বালাও, পোড়াওয়ের ঘটনার সাথে কোন ধরনের সম্পৃক্ততার নজীর নেই। আমরা সরকারের প্রতি ইতোমধ্যেই আহ্বান জানিয়েছি যে, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার সাথে সম্পৃক্তদের চিহ্নিত করে তাদের বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। আমাদের আহ্বান সত্ত্বেও সরকার তাতে সাড়া না দিয়ে এবং অব্যাহতভাবে দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে হামলা, ভাংচুর ও ধ্বংসাত্মক কর্মকা- পরিচালনা করায় জাতির সামনে প্রতীয়মান হয়েছে, এ সরকারের নিকট থেকে কোন ধরনের প্রতিকার পাওয়া সম্ভব নয়। তাই আমরা বাধ্য হয়ে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠন করে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকারীদের চিহ্নিত করার আহ্বান জানিয়েছি। আমাদের বক্তব্য ৯ জানুয়ারি বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রচারিত হয়েছে।
সরকারের দলীয় ক্যাডাররা যেসব যায়গায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, মন্দির-গীর্জাসহ ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা, ভাংচুর করতে গিয়ে হাতে নাতে ধরা পড়েছে, তাদের দায় দায়িত্ব স্বীকার করে এই সন্ত্রাসী ও মানবতাবিরোধী ঘৃণ্য কর্মকা-ের জন্য অনুতপ্ত হয়ে অবিলম্বে সরকারের পদত্যাগ করা উচিৎ বলে আমরা মনে করি।
আমরা বিভিন্ন গণমাধ্যমের নিকট আহ্বান জানাতে চাই, আপনারা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পেশাগত নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সঠিক এবং যথার্থ তথ্য জাতির সামনে তুলে ধরুন। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি, উপাসনালয়ে হামলা, ভাংচুর বন্ধের জন্য সরকারের  প্রতি আহ্বান জানানো সত্ত্বেও সরকার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় আমরা বাধ্য হয়ে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করছি” এর বাইরেও তিনি বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন যা পাঠকদের জ্ঞাতার্থে তুলে ধরছি তিনি বলেছেন
ক. যেহেতু সরকার সরাসরি সংখ্যালঘুদের উপর হামলার সাথে সম্পৃক্ত তাই এ সরকারের নিকট থেকে নিরপেক্ষ আচরণ আশা করা যায় না। ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী পরিষদের সদস্যগণ দলীয় সন্ত্রাসীদের আড়াল করে বক্তব্য রেখে তাদের সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রমাণ রেখেছেন। তাই এ স্পর্শকাতর বিষয়ে আমরা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারকে বাধ্য করতে আহ্বান জানাচ্ছি।
খ. সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা, ভাংচুর ও উপাসনালয়ে অগ্নিসংযোগের সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিভিন্ন স্থানে পুজা উদযাপন কমিটিসহ ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ থেকে আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মহামান্য হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়েছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ফেনী, বরিশাল, সাতক্ষীরা, যশোর, মাগুরা, পাবনা, বগুড়া, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাদেরকে চিহ্নিত করে মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং যারা হাতে নাতে ধরা পড়েছে, বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণে এবং প্রশাসন যাতে সকল ধরনের চাপ, ভয়-ভীতি ও দলীয় প্রভাব মুক্ত হয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন তা নিশ্চিত করতে সরকারকে বাধ্য করার জন্য আমরা জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
গ. যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের অবিলম্বে উপযুক্ত ক্ষতিপুরণ প্রদান, বিধ্বস্ত বাড়ীঘর ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ এবং আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে আমরা সরকারকে বাধ্য করার জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
ঘ. সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় উপাসনালয়সহ সকল ধর্মীয় উপাসনালয়ে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন এবং যাবতীয় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা আশা করি জাতিসংঘ, দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহ এ জালেম, স্বৈরাচারী, অবৈধ ও গণপ্রত্যাখ্যাত সরকারের নির্দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর পরিচালিত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও কার্যকর ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসবেন।”
একই ভাবে ১৮ দলীয় জোটের পক্ষে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন যে, “সরকার তাদের সীমাহীন ব্যর্থতা ঢাকতে এবং একদলীয় প্রহসনের তামাসার নির্বাচনের সমালোচনা আড়াল করতে ও সারা দেশে বিরোধী দলের  ওপর সরকারি বাহিনীর দমন পীড়ন থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য সরকার এবং সরকার দলীয় ক্যাডাররাই সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটাচ্ছে’’। আওয়ামী লীগ মূলত তাদের অবৈধ ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করা এবং বিরোধী দলের ওপর তারা যে দমন পীড়ন চালাচ্ছে তা আরো দীর্ঘায়িত করার জন্য এবারে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ট্রাম্পকার্ড ছেড়েছে। কিন্তু এবারে তাদের ট্রাম্পকার্ড বুমেরাং হয়ে তাদের দিকেই ফিরে যাচ্ছে। নির্যাতিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় দেখছে কারা তাদের ওপর হামলা করছে, কারা তাদের বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছে, কারা লুটপাট করছে। তারা এ ব্যাপারে মিডিয়ার সামনে কথাও বলেছে। তাই এবারের সংখ্যালঘু ট্রাম্পকার্ডটি আওয়ামী লীগের জন্য বরং শাঁখের করাত হয়েছে। যদিও সরকারের নির্দেশে পেটোয়া বাহিনী বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের পাইকারীহারে গ্রেফতার করে তাদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। কিন্তু এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, জুুুলুম নির্যাতন করে, অপপ্রচার চালিয়ে, প্রপাগা-ার রাজনীতি দিয়ে সাময়িক সুবিধা হাসিল করতে পারলেও কোন স্বৈর শাসকেরই শেষ রক্ষা হয় না। আওয়ামী লীগেরও শেষ রক্ষা হবে না। জনতার তুমুল আন্দোলনে এবং গণ অভ্যুত্থানে অবৈধ নির্বাচনী তামাসার মাধ্যমে যে স্বৈর শাসকের জন্ম হয়েছে তাদেরও বিদায় নিতে হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads