রবিবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০১৪

বিপন্ন গণতন্ত্র খাদের কিনারায় বাংলাদেশ


বর্তমান বাংলাদেশের পরিস্থিতি এমন একপর্যায় পৌঁছেছে যেখানে দেশের নাগরিক সমাজ উৎকণ্ঠিত। অনিশ্চিত নৈরাজ্যের দিকে অগ্রসর দেশের ও গণতন্ত্র নামের সেই স্বর্ণের হাঁসটা। ১৯৭১ সালে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ন্যূনতম গণতন্ত্রের যে নিয়মতান্ত্রিক চর্চা শুরু হয়েছিল সেটিকে ৫ জানুয়ারির অবৈধ ও জনসম্পৃক্তহীন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র নামক স্বর্ণের হাঁসটাকে কবরস্থ করে দেশকে চরম সংকটের দিকে ধাবিত করছে সরকার। ক্রমাগত রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিপর্যয়ের মুখে দেশের অর্থনীতি এবং ভয়ঙ্করভাবে ভঙ্গুর অবস্থায় দেশের আইন-শৃঙ্খলা। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কের যে দাগ এঁটে দিয়েছেন তা হয়তো কখনো মুছার নয়। আমরা জাতি হিসাবে দীর্ঘদিন সংগ্রাম ও সাধনা করে আস্তে আস্তে গণতন্ত্রের যে পথ চলা শুরু করেছিলাম তা এই সরকার ক্ষমতায় আসার দুই বছরের মধ্যে বিপন্ন হয়ে যেতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ যেমন ২০১৩-এর ফেব্রুয়ারি মাসের মাওলানা সাঈদীর রায়ের পর যে গণআন্দোলন শুরু হয় সে আন্দোলনকে দমন করার জন্য সরকার যেভাবে গণহত্যা শুরু করেছিলো তা হয়তো বাংলার ইতিহাসে শুধুমাত্র স্মরণীয় হয়ে থাকবে না বরং ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিবে।
উদাহরণ : ২৮ ফেব্রুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি উত্তাল ও ভয়ানকতম দিন। যেদিন নিরীহ আন্দোলনকারীদের উপর সরকার নির্মমভাবে গুলী চালিয়ে ইতিহাসকে রক্তাক্ত করেছে। এরপর দেখি ইসলাম বিদ্বেষী ব্লগারদের বিরুদ্ধে  যে গণআন্দোলন ও ইসলামী বিপ্লব শুরু হয় তা দমনের জন্য নৃশংস গণহত্যা চালানো হয় যার মাধ্যমে গণতন্ত্রের সূর্য আস্তে আস্তে ডুবতে থাকে। এর পর দেখি বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বিনা উস্কানিতে পুলিশের নির্বিচারে গুলী। শেষ পর্যন্ত ৫ জানুয়ারির অবৈধ নির্বাচনের মধ্যে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে কবরস্থ করেছে, যা দেশের জন্য একটি ভয়ঙ্করতম পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এবার আসা যাক What is Democracy? বা গণতন্ত্র কী? গণতন্ত্রের ইংরেজি শব্দ Democracy যা Kratia শব্দ  Demos ও যা গ্রীক শব্দ থেকে উৎপন্ন হয়েছে যার অর্থ  Demos অর্থ গণতন্ত্র আর Kratia শব্দের অর্থ শাসক। সুতরাং তাদের শব্দগত অর্থ হচ্ছে গণতন্ত্রের শাসক।
সাধারণ সংজ্ঞা :  সাধারণভাবে গণতন্ত্র বলতে এমন এক ধরনের শাসন ব্যবস্থাকে বুঝায় যেখানে জনগণের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নিজেদেরকে প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শাসন করে।
বিশিষ্ট আইনবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী লিন্ডসের মতে “গণতন্ত্র একাধারে একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক মতবাদ এবং সে হিসাবে এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল স্বাধীনতা ও সাম্য।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের মতে ``Democracy is a government of the people by the people and for the people”অর্থাৎ গণতন্ত্র হলো জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা জনগণের শাসন। গণতন্ত্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যার উপর গণতন্ত্র দাঁড়িয়ে থাকে। যেই চরিত্র বা পিলারগুলো না থাকলে গণতন্ত্র পরিপূর্ণ বা আংশিক ও পূর্ণ হয় না, এই গুরুত্বপূর্ণ পিলারগুলোকে আইনের  রক্ষাকবচ বলা হয়।
যেমন : আইনের অনুশাসন, দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থা, জণগণ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ, বহুদলীয় শাসন ব্যবস্থা, জনগণের ভোটাধিকার, সমঝোতা এবং সামাজিক সাম্য। উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো না থাকলে গণতন্ত্রের নামে একনায়কতন্ত্র অথবা স্বৈরাচারতন্ত্র চালু থাকে। এবার দেখা যাক ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এসব বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ছিল কি না। আইনের শাসন গণতন্ত্রের প্রধান রক্ষাকবচ হলেও বর্তমান সরকারের আমলে বা ইতিহাসে নজিরবিহীনভাবে আইনের শাসনকে পর্যুদস্ত করেছে। আইনের শাসন থাকলে আজকে সাধারণ মানুষ অথবা বিরোধী দলকে পুলিশ আতঙ্কে ভুগতে হত না। শান্তিপূর্ণ মিছিলে বাধাদান বা গুলী চলতো না, দেশে দ্বৈত নীতির উদ্ভব হতো না।
                                                    জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী  :-
এটি গণতন্ত্রের জন্য অন্যতম পিলার। কিন্তু দুভার্গ্য আমাদের এই দেশে জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী লেখা থাকলেও কিন্তু এই দেশে কোন সময় চালু না থাকলেও এই সময়ে তা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে জনগণের আশা আকাক্সক্ষা জলাঞ্জলি দিয়ে ১৫তম সংবিধান সংশোধন যা ছিলো সম্পূর্ণ গণতন্ত্র বিরোধী।
নাগরিক অধিকার : গণতন্ত্রের অন্যতম মূল উপাদান হলো নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ করা। সংবিধান প্রতিটি নাগরিকের জন্য কিছু মৌলিক বা মানবাধিকার নিশ্চিত করে যা ভঙ্গ করলে মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে চিহ্নিত হয়। জাতি হিসেবে আজ আমরা কলঙ্কিত। বিগত সময়ে যেভাবে মানুষ খুন হয়েছে, গুম হয়েছে, তা দেখে আতঙ্কে উৎকণ্ঠিত হতে হয়। সামান্য পরিসংখ্যান দেখলে বুঝা যাবে কিভাবে Human rights violation করা হয়েছে। যা সম্পূর্ণ সংবিধান পরিপন্থী ও গণতন্ত্রবিরোধী। মহাজোট সরকারের ৫ বছরে মানুষ খুন হয়েছে সাড়ে ২২ হাজার। যা ইতিহাসে রেকর্ড সংখ্যক। এরই মধ্যে ১৩ শত রাজনৈতিক হত্যাকা- এবং ৭০০ জন পুলিশের গুলীতে মারা যান। সবচেয়ে বেশি হত্যাকা- হয়েছে ২০১৩তে কি না ৩০০ এর উপর। মানুষের বেঁচে থাকার বা জীবনের অধিকার কেড়ে নিয়ে শুধু গণতন্ত্র বা মানুষ হত্যা হয়নি এটি মূলত মানবতাকে হত্যা করা হয়েছে।
বহুদলীয় শাসন ব্যবস্থা : বহুদলীয় শাসন ব্যবস্থা গণতন্ত্র রক্ষার মূল বা অন্যতম উপাদান হলেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যেখানে বহুদল নির্বাচন বর্জন করেছে সেখানে বহুদলীয় শাসন ব্যবস্থা নেহায়েত হাস্যকর নয় কি?
ভোটাধিকার নিশ্চিত : ভোটাধিকার নিশ্চিত হলো, সাংবিধানিক ও গণতন্ত্রের অন্যতম মূল স্তম্ভ। কিন্তু দুভার্গ্য আমাদের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যেখানে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয় সেখানে কিভাবে ভোটাধিকার নিশ্চিত হয়েছে তা জনগণ জানেও না এবং ১০০ আসনের নির্বাচনে ভোট পড়েছে ১০ শতাংশের একটু বেশি Fair election monitoring Association (FEMA)-এর মতে। এবং ৩৯টি কেন্দ্রে ১টি ভোটও না পড়ে ইতিহাস করেছে এই নির্বাচন। যা শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোটাধিকার হরণ করেননি, মৃত্যু ঘটিয়েছেন গণতন্ত্রের।
এবার আসা যাক কেন আমি এই নির্বাচনকে অবৈধ বলে আখ্যায়িত করেছি। সংবিধানের ৬৫(১) স্পষ্টভাবে বলা আছে, বাংলাদেশের সংসদ সদস্য  জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন। এটা সত্য যে, একটি নির্বাচনের জন্য বহুদলীয় অংশগ্রহণ আবশ্যক করা হয়নি অথবা ২০% অথবা ১৫%-এর নিচে ভোট না পড়লে বাতিল করতে হবে। এই বিধানগুলো অর্ন্তভুক্ত না হলেও ৬৫(১) জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হতে হবে তা বলা হয়েছে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যে নির্বাচনে ৪০টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২৮টি দলই অংশগ্রহণ করেননি। এমনকি ১৪ দলের ১৪টি দলই অংশগ্রহণ করেননি। মাত্র ১২টি দলই নিয়ে নির্বাচন করলেই তা কিভাবে গ্রহণযোগ্য বা বৈধ হবে। এই অবৈধ কারণেই আজকে এই সরকারকে স্বীকৃতি দিতে রাজি নই। এমনকি তারা এই নির্বাচনকে অগণতান্ত্রিক ও প্রহসন বলে আখ্যায়িত করেছেন।
যেমন এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন এই নির্বাচনকে “ট্রাজিককমিক” বলে আখ্যায়িত করেছেন। এমনকি আওয়ামী লীগ মিত্র ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক “দ্যা হিন্দুর” মন্তব্য ছিলো “বাংলাদেশে কেউই বিজয়ী হয়নি”। অন্যদিকে কলকাতার আনন্দ বাজার পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে
“বাংলাদেশের নতুন সরকার অবৈধ” অন্য দিকে যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী পত্রিকা “দ্যা ইকনমিস্ট” বলেছেন “বাংলাদেশের রাজনীতি পচে গেছে” অন্য দিকে হংকং ভিত্তিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষক সংগঠন এক বিবৃতিতে বলেন, “৫ জানুয়ারির নির্বাচন-এর প্রতিশ্রুত, সহিংসতা, কারচুপি ও প্রহসন পুরোপুরি পূর্ণ করেছে। এখন দেখার সময় বাংলাদেশ কতটুকু ডুবে”।
নিউইয়র্ক ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা Human rights watch -এর বিবৃতিতে বলেন, “আওয়ামী লীগ নিজেকে দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক দল দাবি করলেও যেভাবে সমালোচকদের উপর নিপীড়ন চালাচ্ছে তাতে গণতন্ত্রের বিন্দুমাত্র নেই”। তারা আরও বলেন, “গণগ্রেফতার ও ভিন্নমত দমন বন্ধ করে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর আহ্বান জানান।”
উপরোক্ত তথ্যগুলো থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এই নির্বাচনকে তারা শুধুমাত্র বর্জন করেননি। তারা এই নির্বাচনকে চরমভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। দেশের সুশীল সমাজও এই নির্বাচনকে প্রহসন ও সম্পূর্ণ সরকারি নাটক বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই সব আলোচনার  মাধ্যমে বুঝা যায়, বাংলাদেশের অবস্থান। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিশ্বে বন্ধুবিহীন ও একাকিত্ব হয়ে পড়েছে। আর যখন সম্পূর্ণ একাকিত্ব হয়ে পড়বে তখন হয়তো বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে। কেননা এখনো বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া অচল। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে প্রতিবেশী ভারত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক,  শ্রম বাজার ও বিনিয়োগ চলে যাচ্ছে ভারতে, নিশ্চয় এ ক্ষেত্রে ভারত লাভবান।
উপরোক্ত আলোচনা ও তথ্য থেকে প্রতীয়মান নয় কি? বাংলাদেশের গণতন্ত্র শুধুই বিপন্ন নয় বরং ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের কবর রচিত করেছে এবং স্বাধীনতাকে করেছে ক্ষুণœ এবং বাংলাদেশকে এক গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে যা থেকে উত্তরণের পথ সহজ নয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads