রবিবার, ৫ জানুয়ারী, ২০১৪

সত্যের আকাল এখন পৃথিবীতে


সত্যের আকাল এখন পৃথিবীতে, আকাল মানবিক অনুভূতির। সাম্প্রতিক বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা এমন অনেক উদাহরণ লক্ষ্য করবো। বসনিয়া-হার্জেগোভিনার মানবিক বিপর্যয়ের কথাতো এত সহজে কারো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, কাশ্মীরসহ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার মানুষের আর্তনাদ যেন বর্তমান সভ্যতার নায়কদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে পারছে না। সেদিন টিভি টকশোতে সাবেক এক কূটনীতিক বলছিলেন, অন্য সব ক্ষেত্রে সংকটের সুরাহা লক্ষ্য করা গেলেও মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় সংকটের সমাধান দেখা যায় না। বরং নানা ছলনায় সংকট জিইয়ে রাখার প্রবণতাই লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু কী অপরাধে এমন হচ্ছে? ওদের অপরাধ একটাই, আর তাহলো মুসলিম পরিচিতি। আমাদের এই উপমহাদেশের রাজনীতিতেও অনেক লুকোচুরি আছে, প্রহসন আছে, আছে প্রোপাগান্ডার মাতামাতি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রাষ্ট্র বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ ও উগ্রতার দোষে চিহ্নিত করার প্রয়াসও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অথচ সাম্প্রদায়িক ও উগ্রতার নানা ঘটনার পরেও প্রোপাগান্ডার জোরে ভারত নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা কি তাই? ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও উগ্রবাদী তৎপরতার খবর যারা রাখেন, তারা ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্র ও রাজনীতিবিদদের প্রোপাগান্ডার সাথে অনেক ক্ষেত্রেই একমত পোষণ করবেন না।
প্রসঙ্গত এখানে গত আগস্টে ভারতের উত্তর প্রদেশের মুজাফফরনগরে মুসলিম বিরোধী দাঙ্গার কথা উল্লেখ করা যায়। এই দাঙ্গায় অন্তত ৬০ জন নিহত হয় এবং প্রায় ৭০ হাজার মুসলমান প্রাণ রক্ষার্থে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য দাঙ্গা বিপর্যস্ত মুসলমানদের জন্য ত্রাণশিবির খোলা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, সেই ত্রাণশিবিরগুলো রাজ্য সরকার এখন বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। রাষ্ট্রীয় ওলামা কাউন্সিলের সভাপতি মাওলানা আমীর রাশাদী মাদানী ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, রাজ্য সরকার তাদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য সব ধরনের অপকৌশল গ্রহণ করেছে। তবে বুলডোজার দিয়ে ত্রাণশিবির গুঁড়িয়ে দেয়ার ঘটনা অন্যায়-অবিচারের চরম বহিঃপ্রকাশ। তিনি আরও বলেন, বুলডোজার চালানো বন্ধ করুন, মাদরাসা সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করা বন্ধ করুন, ত্রাণশিবিরে কর্মরত এনজিওগুলোকে কাজ করতে দিন এবং আশ্রিতদের উচ্ছেদ বন্ধ করুন। নইলে আমরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হবো। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা এবং মসজিদ ভাঙ্গার সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কোন নতুন বিষয় নয়। পাঠকরা নিশ্চয়ই ১৯৯২ সালে উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় ষোড়শ শতাব্দীতে স্থাপিত বাবরী মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা ভুলে যাননি। ঐ ঘটনার পর সংঘটিত দাঙ্গায় দুই হাজারেরও বেশি মুসলমান নিহত হন। আর গুজরাটে মানব ইতিহাসের ভয়াবহ ও নিষ্ঠুর দাঙ্গার কথা পৃথিবীবাসী কখনও ভুলবে না। মুসলিম বিরোধী ওই দাঙ্গার নায়ক তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবার নির্বাচনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে বেশ এগিয়ে আছেন। নরেন্দ্র মোদীর সাম্প্রদায়িক ও উগ্রবাদী দল বিজেপি বিভিন্ন রাজ্যে জয়লাভ করছে। কই আমরা তো সে ব্যাপারে কোন আশংকা বা বিরূপ মনোভাবের কথা ভারতের মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাজনৈতিক নেতাদের জানাচ্ছি না। এমনকি ভারতে যে সাম্প্রদায়িক ও উগ্রবাদী রাজনীতির বিকাশ ঘটছে, তেমন কোন প্রোপাগান্ডাও আমরা চালাচ্ছি না। কারণ আমরা মনে করি, ওইগুলো ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তাদের ভালমন্দ তারাই দেখবে। ওইসব বিষয়ে বাইরের কেউ নাক গলালে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে অসম্মান করা হয়। ভারতের জন্যও এমন আচরণ কি সঙ্গত নয়? কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, ভারত তেমন সঙ্গত আচরণ করছে না। বরং বাংলাদেশের ব্যাপারে নাক গলাতে তারা বেশ উৎসাহী।
ভারত বাংলাদেশে মৌলবাদ ও উগ্রবাদের উত্থানের ব্যাপারে আগ বাড়িয়ে কথা বলছে অথচ নিজ দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার মুসলিম উদ্বাস্তুদের আশ্রয় শিবিরে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা বিধান করছে না। উত্তর প্রদেশের রাজ্য সরকার বুলডোজার দিয়ে ত্রাণশিবির গুঁঁড়িয়ে দিচ্ছে এবং অবশিষ্ট ত্রাণশিবির বসবাসের অনুপযোগী করে রেখেছে। ফলে শীতের এই মওসুমে ঠা-ায় আশ্রয় শিবিরে ৩৫ শিশুর মৃত্যু ঘটেছে। এমন অমানবিক উদাহরণের পরও ভারত অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র! আর আমরা সাম্প্রদায়িক ও উগ্র! এ কারণেই বলতে হয়, সত্যের ও মানবিকতার আকাল এখন পৃথিবীতে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads