বুধবার, ২২ জানুয়ারী, ২০১৪

গুম-খুন ও ঢালাও নির্যাতন বন্ধ করতে হবে


৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের পর আশা করা হয়েছিল, জনগণকে ভোটকেন্দ্রে টেনে আনতে না পারার ব্যর্থতার কারণে হলেও সরকার হয়তো দমন-নির্যাতন এবং গুম ও খুনের অভিযানে লাগাম টেনে ধরবে। অন্যদিকে গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ভয়ংকর এ অভিযান বিগত মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে কল্পনার সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও হত্যাকান্ডের শিকার হচ্ছেন বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা। গুমও করা হচ্ছে অনেককে। ক’দিন পর তাদের লাশ পাওয়া যাচ্ছে এখানে-সেখানে। আপত্তি ও উদ্বেগের কারণ হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব গুম ও হত্যাকা-ের জন্য পুলিশ ও র‌্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম জড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে জনমনে শুধু ভীতি-আতঙ্কই ছড়াচ্ছে না, জীবনের নিরাপত্তার জন্য সরকারের ওপর মানুষের আস্থাও কমে যাচ্ছে। গুম ও খুনের বিষয়টি নতুন করে ভীতি-আতঙ্ক ছড়িয়েছে সাম্প্রতিক কিছু অবিশ্বাস্য ঘটনার কারণে। যেমন সংবাদপত্রের রিপোর্টে জানা গেছে, গত ১৮ জানুয়ারি একদিনেই দেশের বিভিন্নস্থানে ১৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে বেশি আলোচিত হয়েছে নীলফামারী সদর উপজেলার লক্ষ্মীচাপ ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম রব্বানীর হত্যাকা-। গত ১৪ ডিসেম্বর নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গিয়ে প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও নতুন সরকারের সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তার গাড়ি বহরের ওপর হামলার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় বিএনপির ওই নেতা গোলাম রব্বানীকে প্রধান আসামী করা হয়েছিল। কয়েকদিন আগে পুলিশ তাকে পঞ্চগড় থেকে গ্রেফতার করেছিল। সেই থেকে তার কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে সদর উপজেলার পলাশবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের পার্শ্ববর্তী একটি বাঁশঝাড়ে তার ক্ষত-বিক্ষত লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। তাকে নিষ্ঠুরভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর দু’দিন পরই ছাত্রদল নেতা আতিকুর রহমানের লাশ পাওয়া গেছে সৈয়দপুর উপজেলার ধলাগাছ নাড়িয়া এলাকায় বাইপাস সড়কের নিচে। আতিকও নূরের মামলার আসামী ছিলেন। ঠিক কার নির্দেশে কারা এই হত্যাকা- ঘটিয়েছে তা নিয়ে এলাকাবাসীর মনে কোনো সন্দেহ নেই।
নীলফামারীর এ দুটি হত্যাকা- সাম্প্রতিক সময়ের উদাহরণ মাত্র। সেদিনই আরও ১৭ জনের মৃত্যু ঘটেছে। এসবের মধ্যে কয়েকটি সংঘটিত হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। সাতক্ষীরার ভোমরা ইউনিয়নের শিবির কর্মী ছোটনসহ কেউ কেউ যৌথবাহিনীর প্রকাশ্য অভিযানেও মারা গেছেন। এর পরপর আলোড়ন তুলেছে ১৮ জানুয়ারির অন্য তিনটি মৃত্যুর ঘটনা। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, দু’দিন আগে সীতাকু-ের মিরসরাই উপজেলার মিঠাছড়া এলাকা থেকে র‌্যাব-এর পরিচয় দিয়ে ১০/১২ জনের একটি সশস্ত্র দল ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা মোশাররফ হোসেনকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছিল। ২০ জানুয়ারি তার গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া গেছে সীতাকু-ের টেরিয়াল এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে। অভিযোগ উঠেছে, র‌্যাবই তাকে হত্যা করেছে। নরসিংদীর রায়পুরা এলাকাতেও দু’জন যুবকের লাশ পাওয়া গেছে, র‌্যাব যাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল। খবরে বলা হয়েছে, এই দু’জনের সঙ্গে র‌্যাবের হাতে আটক অন্য একজনের খোঁজ এখনও পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ মাত্র দু’দিনের মধ্যে সব মিলিয়ে অন্তত ২২ জনের মৃত্যু ঘটেছে, অভিযোগ অনুযায়ী যাদের বেশিরভাগই মারা গেছেন র‌্যাব ও পুলিশের হাতে। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন উঠেছে মেহেরপুর জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল তারিক মুহাম্মদ সাইফুল ইসলামের হত্যাকা-ে। ২০ জানুয়ারি দুপুর আড়াইটার দিকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছিল। তার লাশ পাওয়া গেছে রাত দেড়টার দিকে। পুলিশ দাবি করেছে, তারিক মুহাম্মদ নাকি বোমাবাজির মতো কথিত অপরাধের দোষ স্বীকার করেছিলেন। দলের অন্য বোমাবাজ-সন্ত্রাসীদের আস্তানা দেখিয়ে দেয়ার জন্য তাকে নিয়ে শ্মশানঘাট এলাকায় গেলে পুলিশ প্রতিরোধের মুখে পড়ে। উভয় পক্ষের গোলাগুলিতেই নাকি  প্রাণ হারিয়েছেন এই জামায়াত নেতা!
এভাবেই রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের পাশাপাশি গুম ও হত্যার ব্যাপারেও সরকার সমান তালে এগিয়ে চলেছে। ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানসহ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতারা পৃথক পৃথক বিবৃতিতে অভিযোগ করেছেন, যৌথবাহিনী তালিকা করে এবং বেছে বেছে জামায়াত ও শিবিরের নেতা-কর্মীদের হত্যা করছে। একই অভিযোগ করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন ও ১৮ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াও। ২০ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসমাবেশে নির্বাচনের আগে ও পরে যৌথবাহিনীর নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতন ও হত্যাকা-ের তীব্র সমালোচনা করে খালেদা জিয়া বলেছেন, এই অভিযানের ব্যাপারে জনগণের মনে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
এদিকে গুম ও হত্যাকা-ের কারণে অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যখন বিরোধী দলের নেতা-কর্মী মাত্রকেই গুম হওয়ার ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত থাকতে হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি বিপদে রয়েছেন সাতক্ষীরা, মেহেরপুর ও গাইবান্ধার নেতা-কর্মীরা। আমরা মনে করি, ঘটনাপ্রবাহে সরকারের জন্য দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। কারণ, প্রতিটি ঘটনায় বিশেষ করে র‌্যাবের অংশগ্রহণ সম্পর্কে জানা যাচ্ছে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়। উদ্বেগ ও আপত্তির কারণ হলো, এলিট বাহিনী হিসেবে পরিকল্পিত র‌্যাবের কর্মকা- দেখে-শুনে মনে হচ্ছে যেন দু’একদিন পরপর ক্রসফায়ার ও এনকাউন্টার ধরনের বাহারী নামে হত্যা করাটাই এ বাহিনীর প্রধান কাজ হয়ে উঠেছে! বলাবাহুল্য, সামনে র‌্যাবকে রাখা হলেও পেছনে আসলে রয়েছে সরকারি দল ও তার অঙ্গ সংগঠনের ক্যাডাররা।। সরকারই র‌্যাবকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হত্যার কাজে ব্যবহার করছে। এমন অবস্থা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। আমরা মনে করি, গুম ও গুপ্তহত্যা গণতন্ত্রসম্মত কোনো পন্থা হতে পারে না। সরকারের উচিত অবিলম্বে এই জঘন্য কর্মকা- বন্ধ করা। সরকারকে প্রতিটি হত্যাকা-ের নিরপেক্ষ তদন্তেরও ব্যবস্থা করতে হবে। কাউকে আদালতে সোপর্দ না করে গুলী করার বিধান আইনে নেই বলেই এসব বিষয়ে জবাবদিহিতা আদায় করা এবং প্রমাণ পাওয়া গেলে যতো অভিজাত বাহিনীর সদস্যই হোক, তাকে শাস্তি দেয়া দরকার।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads