শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১৪

আওয়ামী গণতন্ত্রের ইতিহাসে জানুয়ারি


যদি প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশের জন্য খ্রিস্টীয় বছরের কোন কোন মাস বিশেষভাবে স্মরণীয় বা উল্লেখযোগ্য তাহলে পাঠকরা সম্ভবত ফেব্রুয়ারি, মার্চ এবং ডিসেম্বরের কথা বলবেন। এটাই সঙ্গত। কারণ, ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের জন্য, মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধ আরম্ভের জন্য এবং ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছে। আওয়ামী লীগ যারা করেন তারা হয়তো আগস্টকেও এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করবেন। কারণ, ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসেরই ১৫ তারিখে তাদের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হয়েছিলেন। এসবই ঠিক আছে, কিন্তু সাধারণ মানুষের অজান্তে অন্য একটি মাসও বাংলাদেশের স্মরণীয় মাসের তালিকায় ঢুকে পড়েছে। সে মাসের নাম জানুয়ারি। পাঠকরাও লক্ষ্য করতে পারেন। প্রথমে সর্বশেষ কারণটির উল্লেখ করা যাক। মাত্র ক’দিন আগে ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনের নামে যে কর্মকান্ড সম্পন্ন করা হলো তার জন্য জানুয়ারি অবশ্যই বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। একই সঙ্গে ১২ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের কথাটাও স্মরণ করা হবে। কথিত দশম সংসদের প্রথম অধিবেশনও জানুয়ারিতেইÑ ২৯ তারিখে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সুতরাং সব মিলিয়ে দশম সংসদকেন্দ্রিক কলংকের একটি বড় অধ্যায় যুক্ত হয়েছে ইতিহাসে।
জানুয়ারি মাস অন্য দুটি কারণেও স্মরণীয় হয়ে আছে। একটি কারণ দিন সাতেক আগে নীরবে পেরিয়ে যাওয়া ১১ জানুয়ারি যাকে তথাকথিত ১/১১ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে দিনটি গণতন্ত্রবিনাশী ও সংবিধানবিরোধী ভয়ঙ্কর এক অভ্যুত্থানের জন্য কলংকিত হয়ে আছে। সে অভ্যুত্থান ঘটানো হয়েছিল ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি। সেই ১১ জানুয়ারি এবারও অনেকটা নীরবে পেরিয়ে গেলো, ১/১১-এর কুশীলবদের নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য হলো না। দেশপ্রেমিক কোনো কোনো মহলের পক্ষ থেকে অবশ্য নাম ধরে ধরে জেনারেল মইন উ আহমেদ এবং ফখরুদ্দিন আহমদসহ দখলদার সরকারের সকল উপদেষ্টাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবি উঠেছে। তারা রাষ্ট্রদ্রোহিতার এবং অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের অভিযোগে ১/১১-এর প্রধান খলনায়ক এবং সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল (অব.) মইন উ আহমেদকে গ্রেফতার করার দাবি তুলেছেন। জনগণকে তারা এ কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, ফখরুদ্দিন আহমদ ও মইন উ আহমেদের অসাংবিধানিক সরকারকে আওয়ামী লীগ ও তার জোটের সঙ্গীরাই ‘নিয়ে’ এসেছিল। তারাই ১/১১ ঘটিয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্যও যে পূরণ হয়েছে অর্থাৎ আওয়ামী লীগ যে ক্ষমতায় যেতে পেরেছে, সে কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন দেশপ্রেমিক মহলগুলো। কিন্তু এটুকুই সব। আলোড়ন তোলার এবং কুশীলবদের মনে ভীতি সৃষ্টি করার মতো কোনো বিক্ষোভ মিছিলও কোনো দলকে করতে দেখা যায়নি। ফলে এমন আশাবাদের সৃষ্টি হতে পারেনি যে, ১/১১-এর কুশীলবদের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন গড়ে ওঠার বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়। দলটির পক্ষ থেকে এবারও টু শব্দটি করা হয়নি। এটাই অবশ্য স্বাভাবিক ছিল। কারণ এই অভিযোগ অনেক আগেই সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, উদ্দিন সাহেবরা আসলেও বিশেষ কিছু এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতেই ক্ষমতা দখল করেছিলেন। একথাও গোপন থাকেনি যে, লগি-বৈঠার নৃশংসতা থেকে জরুরি অবস্থা জারি করা পর্যন্ত সবই করা হয়েছিল সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে। ১/১১-কে অনিবার্য করার আসল কারণও লুকিয়ে রাখা যায়নি। চার দলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছরে (২০০১-২০০৬) বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা কোনো ব্যাপারেই জাতির স্বার্থে সামান্য অবদান রাখতে এবং জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেননি। হরতালের আড়ালে ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড চালানোর বাইরে দল হিসেবে আওয়ামী লীগও জনগণের স্বার্থে কোনো ভূমিকা পালন করেনি। নিজেদের এবং বন্ধুরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার জরিপেও দেখা গিয়েছিল, আওয়ামী লীগ অন্তত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে পারবে না। মূলত এই হতাশা থেকেই ২০০৬ সালের অক্টোবরে শুরু হয়েছিল লগি-বৈঠার তান্ডব, যা শেষ পর্যন্ত ১/১১-কে অনিবার্য করেছিল। এটা যে সুপরিকল্পিত এক আয়োজন ছিল সে ব্যাপারে স্বয়ং শেখ হাসিনাও জানান দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ওই সরকারকে তারাই এনেছিলেন সেটা ছিল তাদের ‘আন্দোলনের ফসল’। বহুল আলোচিত ‘রোডম্যাপ’ও ছিল সে পরিকল্পনার অংশ। এর ভিত্তিতেই ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ‘ডিজিটাল’ নির্বাচন হয়েছে, ক্ষমতায় বসানো হয়েছে আওয়ামী লীগকে। এখন চলেছে ‘ঋণ’ পরিশোধ করার পালা। এজন্যই প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দিন আহমদ বিদেশে পাড়ি জমাতে পেরেছেন। দেশের ভেতরে অন্য উপদেষ্টারাও রয়েছেন বহাল তবিয়তে। প্রধান খলনায়ক জেনারেল মইন উ সম্পর্কে তো বলারই অপেক্ষা রাখে না। তিনি এখনও পাচ্ছেন সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। রাজনৈতিক অঙ্গনে বহুল আলোচিত ‘ডিল’ও সেভাবেই হয়েছিল।
লগি-বৈঠার তান্ডব থেকে ‘ডিজিটাল’ নির্বাচন পর্যন্ত সবকিছু যে ‘রোডম্যাপ’ অনুযায়ী ‘সুসম্পন্ন’ করা হয়েছিল, সে সবকিছুর বাস্তবায়নে প্রধান নির্ধারকের ভূমিকা পালন করেছিলেন মইন উ। তাছাড়া ‘খুঁটিও’ এমন এক দেশের রাজধানীতে ‘পোঁতা’ রয়েছে, যে দেশটির ইচ্ছার বাইরে যাওয়ার সাধ্য নেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার! এজন্যই মইন উ’র বিরুদ্ধে চাইলেও আওয়ামী লীগ সরকার কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে না। অথচ ন্যূনতম দেশপ্রেম এবং উদ্দেশ্যের মধ্যে সংবিধান ও গণতন্ত্রের প্রতি সামান্য শ্রদ্ধা থাকলেও জেনারেল মইন উ’কে গ্রেফতার করা এবং বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সরকারের দায়িত্ব ছিল। কারণ, দু’ বছরের বেশি সময় ধরে মইন উ দেশ ও জাতিকে বন্দুকের ভয় দেখিয়ে ইচ্ছাধীন রেখেছিলেন। অস্ত্রের মুখে রাষ্ট্রপতিকে বাধ্য করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন তিনি। ফখরুদ্দিন আহমদকে সামনে রাখলেও বন্দুকের সঙ্গে ক্ষমতার চাবিও সব সময় মইন উ’র হাতেই থেকেছে। প্রকাশিত হয়েছে তার নানা অপকর্মের ফিরিস্তি। দুর্নীতি উচ্ছেদের নামে মইন উ ও তার সহচররা দেশে ‘ব্ল¬্যাকমেইলিং’-এর রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। ক্ষুদে ব্যবসায়ী থেকে বড় ব্যবসায়ী পর্যন্ত কাউকেই রেহাই দেননি তারা। মইন উ’র বিরুদ্ধে নোংরা দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রধান নেতা-নেত্রীদের ‘জেলের ভাত’ খাইয়েছিলেন মইন উ ও তার সঙ্গীরা। দুই নেত্রীকে, বিশেষ করে খালেদা জিয়াকে ‘মইনাস’ করতে চেয়েছিলেন। নেতাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালিয়েছেন। অনেককে দিয়ে জোর করে মিথ্যা বলিয়েছেন। এ উদ্দেশ্যে আরেক সাবেক সেনা প্রধানের মাধ্যমে দুদককে ‘কাজে’ লাগিয়েছেন মইন উ। মামলার পর মামলা চাপিয়ে নেতা-নেত্রীদের ব্যতিব্যস্ত রেখেছেন। রাজনীতিকদের অসম্মানিতও করেছেন তিনি যথেচ্ছভাবে। সবই করেছেন তিনি সামরিক স্বৈরশাসকদের স্টাইলে। সবশেষে পিলখানা হত্যাকান্ডের সময়ও তাকে অত্যন্ত নেতিবাচক ও ক্ষতিকর অবস্থানে দেখা গেছে। বিপন্ন সেনা অফিসারদের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা না করে তিনি গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ‘যমুনা’য় উঠেছিলেন। সেখানেই রাত পর্যন্ত কাটিয়ে এসেছিলেন। অথচ একাধিক সাবেক সেনাপ্রধান এবং সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ঘাতকরা সেনাবাহিনীর সামনে ১০ মিনিটও দাঁড়াতে পারতো না। এত সেনা অফিসারকে হত্যা করতে পারতো না। কিন্তু একশ’ ভাগ নিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও মইন উ সেনাবাহিনীকে অভিযান চালাতে দেননি। মইন উ’র এই ভূমিকার কারণে ঘাতকরা ‘কাজ সেরে’ পালিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছিল। এজন্য রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচনায় তাকেই পিলখানা হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী করা হয়েছে। কিন্তু প্রমাণিত নানা অপরাধের পরও আওয়ামী লীগ সরকারকে প্রথম থেকে মইন উ’র ব্যাপারে ‘অন্য রকম’ মনে হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীও তাৎপর্যপূর্ণ নীরবতা অবলম্বন করেছেন। এর কারণও সম্ভবত উল্লে¬খের অপেক্ষা রাখে না। আসলেও দু’জন দু’জনকে সহযোগিতা করেছেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্য একটি খুবই উল্লেখযোগ্য তারিখ হচ্ছে ২৫ জানুয়ারি। দিনটি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। ১৯৭৫ সালের এই দিনে সংসদের মাত্র ১১ মিনিট স্থায়ী অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছা ও নির্দেশে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। সংশোধনী পাস করার সঙ্গে সঙ্গে শেখ মুজিব রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। সে ছিল এক বিচিত্র অবস্থা। চতুর্থ সংশোধনীর ফলে প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতি বাতিল হয়ে যায়, রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি প্রবর্তিত হয় এবং সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে দেশে একটি মাত্র দল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই সংশোধনীর ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব ২৪ ফেব্রুয়ারি একমাত্র দল বাকশাল গঠন করেন। তার নির্দেশে তাকেই চেয়ারম্যান করে বাকশালের ১১৫ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয় ৬ জুন। রাষ্ট্রপতি এবং বাকশালের চেয়ারম্যান শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সরকার নিয়ন্ত্রিত চারটি দৈনিক ছাড়া দেশের সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ হয়ে যায় ১৬ জুন।
বাকশাল গঠনের পক্ষে বিভিন্ন সময়ে অনেক যুক্তিই দেখানো হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে’ শেখ মুজিব নাকি ‘মহৎ উদ্দেশ্য’ নিয়ে ‘জাতীয় প্ল¬্যাটফর্ম’ হিসেবে বাকশাল গঠন করেছিলেন! এ কথাও বলা হয়েছে যে, বাকশাল গঠনের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছিল জাতীয় সংসদে। অন্যদিকে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস কিন্তু এসব যুক্তিকে সমর্থন করে না। যে ‘বিশেষ পরিস্থিতি’র যুক্তি দেখানো হয় তার জন্য দায়ী ছিল স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বব্যাপী দুর্নীতি, কালোবাজারি ও চোরাচালানসহ প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও অযোগ্যতা, সরকারের রাজনৈতিক নির্যাতন ও হত্যাকান্ড এবং সবশেষে ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। বাকশাল প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদে দেয়া শেখ মুজিবের ভাষণেও এ সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লে¬খ রয়েছে। পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দরকার যখন ছিল ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ ও নতুন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান কিংবা জরুরি ভিত্তিতে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করা, ক্ষমতাদর্পী শেখ মুজিব তখন উল্টো রাজনৈতিক আন্দোলন ও সরকার বিরোধিতার পথ বন্ধ করে দেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এ লক্ষ্যে তিনি প্রথমে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। তারপর পর্যায়ক্রমে এগিয়েছিলেন বাকশালের একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পথে।
সমগ্র এই প্রক্রিয়া ও কর্মকান্ডের একমাত্র উদ্যোক্তা, নির্দেশদাতা, নিয়ন্ত্রক ও লাভবান ব্যক্তি ছিলেন শেখ মুজিব। সর্বময় ক্ষমতাও তার হাতেই কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। ‘জাতীয় প্ল্যাটফর্ম’ বলা হলেও বাকশাল বাস্তবে আওয়ামী লীগেরই নামান্তর মাত্র ছিল (বাকশাল বলতে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বোঝানো হয়েছিল, ‘আওয়ামী লীগ’ নামটিকে বাদ দেয়া হয়নি!)। অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে এর প্রমাণ পাওয়া যাবে যদি আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত দুটি দল ন্যাপ (মোজাফফর) এবং সিপিবির শোচনীয় পরিণতির উল্লে¬খ করা হয়। স্বাধীনতার পর প্রাথমিক দিনগুলো থেকেই দল দুটি সরকারের লেজুড়বৃত্তি করে এসেছে, ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে দল দুটিকে নিয়ে শেখ মুজিব ‘ত্রিদলীয় ঐক্যজোট’ও গঠন করেছিলেন। কিন্তু বাকশালের ১১৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেতৃত্বের অবস্থান পাননি এমনকি কমরেড মনি সিংহ এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মতো দলীয় প্রধানরাও। এই দু’জনকেসহ দুই দলের মাত্র ছয়জনকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেয়া হয়েছিল। তাদের ক্রমিক সংখ্যা ছিল ৭০-এর ঘরে। ওদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামী জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীকে ১৯৭৪ সালের জুন থেকে সন্তোষে গৃহবন্দি রাখা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ বিরোধী অন্য নেতারা ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, কয়েকজন পালিয়ে বিদেশেও চলে গিয়েছিলেন। সুতরাং ‘জাতীয় প্ল্যাটফর্ম’ গঠনের যুক্তিকে রাজনৈতিক অসততা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।
‘সাময়িক কালের’ জন্য গঠন করা হয়েছিল এ ধরনের যুক্তিকেও গ্রহণ করা যায় না। কারণ, সে ধরনের কোনো বিধান চতুর্থ সংশোধনীর কোথাও কিংবা বাকশালের গঠনতন্ত্রে ছিল না। গঠনতন্ত্রের বিভিন্ন ধারা-উপধারা বরং এ কথাই প্রমাণ করেছে, রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য নিয়েই বাকশাল গঠন করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ও কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন এবং সংসদ সদস্যদের মনোনয়ন দেয়া থেকে বাকশাল, রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতিটি বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতা ছিল শুধু শেখ মুজিবের। তিনি এমন একজন চেয়ারম্যান ও রাষ্ট্রপতি ছিলেন, যাকে নির্বাচিত করার কোনো পন্থা বা বিধানেরই উল্লে¬খ ছিল না বাকশালের গঠনতন্ত্রে। ছিল না সংবিধানেও। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল, শেখ মুজিব আজীবন রাষ্ট্রপতি এবং বাকশালের চেয়ারম্যান থাকবেন। একথা অবশ্য ঠিক যে, চতুর্থ সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছিল। কিন্তু অনস্বীকার্য সত্য হলো, ১৯৭৩ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত এবং ব্যাপকভাবে বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সংসদের পক্ষ থেকে এক দলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য জনগণের ম্যান্ডেট চাওয়া হয়নি। সংশোধনী পাস করার পরও গণভোটের আয়োজন করা হয়নি। অথচ এ ধরনের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোতে জনমত যাচাই এবং গণভোট অনুষ্ঠান করা গণতন্ত্রে একটি অবশ্যপালনীয় কর্তব্য যেমনটি পরবর্তীকালে করেছিল খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার। ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট সংসদে শেখ মুজিব প্রবর্তিত প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি বাতিল করে সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন করার উদ্দেশ্যে দ্বাদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। সর্বসম্মতিক্রমে পাস করা সত্ত্বেও এ প্রশ্নে গণভোট আয়োজন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। কিন্তু বাকশাল গঠন এবং চতুর্থ সংশোধনী পাস করার সময় শেখ মুজিব এ ধরনের গণতন্ত্রসম্মত চিন্তাই করেননি। 
প্রসঙ্গক্রমে এখানে পঞ্চম সংসদের সেই অধিবেশনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে, যে অধিবেশনে শেখ মুজিবের চতুর্থ সংশোধনীকে কফিনে ঢোকানো এবং তার পরিবর্তে দ্বাদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। দ্বাদশ সংশোধনীর অর্থ প্রকৃতপক্ষে ছিল শেখ মুজিবের আরো একটি মৃত্যু। কিন্তু তারপরও সংসদে উপস্থিত আওয়ামী লীগের এমপিরা আনন্দে উল্লসিত হয়েছেন, একজন অন্যজনকে জড়িয়ে ধরে নৃত্য করেছেন। শেখ হাসিনাও আওয়ামী এমপিদের সঙ্গে পাল্ল¬া দিয়েছিলেন। টিভি ক্যামেরার সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়েছেন তিনি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের স্টাইলে দুই আঙ্গুলে ইংরেজি অক্ষর ‘ভি’ বানিয়ে বিজয়ের বার্তা জানিয়েছেন জনগণকে। দেশবাসীর প্রত্যাশা ও আকাক্সক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে এই আনন্দ-উল্ল¬াস স্বাভাবিক হলেও শেখ মুজিবের মনোভাব ও চিন্তাধারার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে কিন্তু মানতেই হবে যে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো মুজিব বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে মিলিতভাবে দ্বাদশ সংশোধনী পাস করার জন্য আওয়ামী লীগের অন্তত এত বেশি উল্লসিত হওয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। কেননা, দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাস্তবে শেখ মুজিবের সর্বশেষ ‘কীর্তি’কেই প্রত্যাখ্যান ও বাতিল করা হয়েছিল। অন্যদিকে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ এমপিদের উল্ল¬াস দেখে মনে হচ্ছিল যেন তারা শেখ মুজিবের কোনো চিন্তাধারাকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন!
এটা তাদের পরাজয় বরণ করে নেয়ার গণতন্ত্রসম্মত কৌশল হতে পারে। কিন্তু এভাবেই তারা একের পর এক মরহুম নেতার ‘কীর্তি’ ও চিন্তাধারাকে প্রত্যাখ্যান ও বাতিল করে এসেছেন। বাকশাল গঠনের সিদ্ধান্ত ভুল ও অন্যায় ছিল বলেই মুজিব-উত্তর কোনো বছর ২৫ জানুয়ারির মতো ‘ঐতিহাসিক’ একটি দিবসকে আওয়ামী লীগ কখনো যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য ও সম্মানের সঙ্গে পালন বা উদযাপন করেনি। দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলো দিনটিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দিনটিকে পার করেছে নীরবে। দিনটির স্মরণে দলটি প্রকাশ্যে কখনো কোনো অনুষ্ঠান করেনি, এমনকি শেখ হাসিনার মতো কথায় পটিয়সী নেত্রী কোনো বছর একটি বিবৃতি পর্যন্ত দেননি। মাঝে-মধ্যে দু’চারজন নেতাকে অবশ্য খুবই দুর্বল কণ্ঠে বাকশালের পক্ষে কৈফিয়ৎ দিতে বা ‘জাতীয় প্ল¬্যাটফর্ম’ ধরনের যুক্তি তুলে ধরার কসরত করতে দেখা যায়। কিন্তু কারো পক্ষেই শেখ মুজিবের সর্বশেষ ‘কীর্তি’ বাকশালকে গ্রহণযোগ্য করে তোলা সম্ভব হয়নি। এটা আসলে হওয়ারও কথা নয়।
কিছু কথা অবশ্য স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার। শেখ হাসিনার তুলনায় তার পিতা শেখ মুজিব অনেক বেশি জনপ্রিয় ও ক্ষমতাধর নেতা ছিলেন। ১৯৭৩ সালে ‘অ্যানালগ’ পদ্ধতিতেই তিনি সকল ‘কম্ম’ সম্পন্ন করেছিলেন। ‘ওরে জিতাইয়া দে’, ‘ওরে হারাইয়া দে’ ধরনের নির্দেশ ও ধমকের জোরে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৭টি আসনেই জিতেছিল আওয়ামী লীগ। ওই সংসদেই সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতির ঘাড়ে বাকশালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চাপানো হয়েছিল। সেটা টেকেনি। না টেকার কারণ, জনগণ বাকশালকে গ্রহণই করেনি, প্রত্যাখ্যান করেছিল। দীর্ঘদিন ধরে এরই দায়ভার টানতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। এখনো সে টানাটানির শেষ হয়নি। এর মধ্যেই শেখ হাসিনা আবার আরো একটি ‘কান্ড’ যুক্ত করেছেন। সেটা ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। এখন দেখার বিষয়, সব দলকে বাইরে ঠেলে দিয়ে আয়োজিত একতরফা এবং প্রকারান্তরে একদলীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকারকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কতদূর যেতে পারেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads