শুক্রবার, ১০ জানুয়ারী, ২০১৪

দশম সংসদ এবং সংবিধানের যথেচ্ছ ব্যাখ্যা


এ যেন সেই ‘এলেন, খেলেন এবং চলে গেলেন’-এর মতো ব্যাপার-স্যাপার। ‘নিয়ম’ এবং ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’ রক্ষার দোহাই দিয়ে দশম সংসদ নির্বাচনের নামে যে ‘তেলেসমাতি’ কাজকারবার ক্ষমতাসীনরা করেছেন এবং এখনো করে চলেছেন, তার মূল্যায়ন করতে গেলে এর চাইতে কম কিছু বলা যায় না। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, দশম জাতীয় সংসদ নিয়ে বাড়াবাড়ি শুধু নয়, তাড়াহুড়োও অনেক বেশিই করা হচ্ছে। নির্বাচন আসলে কেমন হয়েছে তা নিয়ে দেশের ভেতরে যেমন বিদেশেও তেমনি এখনো জোর নিন্দা-সমালোচনা চলছে। কিন্তু সবকিছু উপেক্ষা করে এরই মধ্যে ক্ষমতাসীনরা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ঝড়ের বেগে এগোতে শুরু করেছেন। সে পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নির্বাচনের মাত্র তিনদিন পর গত ৯ জানুয়ারি শপথ নিয়েছেন ‘নবনির্বাচিত’ ২৮৪ জন সংসদ সদস্য। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে রাজনীতির বিতর্কিত রহস্যপুরুষ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ শপথ নেননি। বলা হয়েছে, তিনি নাকি যে কোনোদিন শপথ নেয়ার কাজটুকু সেরে নেবেন। যশোরের দুটিসহ মোট দশটি আসনে নির্বাচন স্থগিত রখেছে নির্বাচন কমিশন। সে কারণে নিজেদের ‘নির্বাচিত’ তিনশ এমপির চেহারা দেখার ও পরিচিতি সম্পর্কে জানার জন্য জনগণকে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। এদিকে দশম সংসদ নির্বাচনের নামে ৫ জানুয়ারি প্রহসনের পাশাপাশি যে প্রাণঘাতী কর্মকা- চালানো হয়েছে তার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে জনগণ। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল শুধু নয়, পেশাজীবী বিভিন্ন সংগঠনও তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে এই নির্বাচন বাতিল করার এবং সব দলের অংশগ্রহণে নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে বলেছেন, দেশের সবস্থানে ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের অনুপস্থিতিতেই প্রমাণিত হয়েছে জনগণ একদলীয় এ নির্বাচনকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রশাসন এবং আইন-শৃংখলা বাহিনীগুলোকে দলীয়ভাবে ব্যবহার করে আয়োজিত এ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করা হলেও জনগণ তাদের ‘না’ বলে দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতাসীনদের পরাজয় নিশ্চিত হয়েছে। একই কারণে জনগণের প্রত্যাখ্যাত সরকারও এখন অবৈধ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেছেন, জনগণ সরকারের আয়োজিত প্রহসনের নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করেছে, সরকারকে জানিয়েছে ধিক্কার। এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদও একই ধরনের বক্তব্য রেখেছেন। নির্বাচনের দিন সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের নেতারাও নির্বাচনটিকে শতাব্দীর সবচেয়ে বড় কলঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বলেছেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছে। এই নির্বাচনকে অবশ্যই বাতিল করতে হবে বলেও তারা দাবি জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করার পাশাপাশি সেদিন থেকেই একযোগে নতুন পর্যায়ে শুরু হয়েছে আন্দোলন। ১৮ দলীয় জোটের ডাকে দ্বিতীয় দফায় ৪৮ ঘণ্টার হরতাল পালিত হয়েছে সারাদেশে, চলছে অবরোধও। দু’দিনের বিরতি দিয়ে ১২ জানুয়ারি থেকে আবার শুরু হচ্ছে অবরোধ। হরতাল-অবরোধে জনগণ সাড়া দিয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। সবার মুখে এক কথা, সরকার নির্বাচনের নামে জনগণের সঙ্গে তামাশা করেছে। ধ্বংস করেছে গণতন্ত্রকেও।
সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার দোহাই দিয়ে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের নামে সব মিলিয়ে ক্ষমতাসীনরা যা করেছেন দেশে-বিদেশে তার প্রতিক্রিয়া মোটেই ভালো হয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থা বিএনপি ও অন্য দলগুলোকে নিয়ে নতুন করে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের  আহ্বান জানিয়েছে। এমনকি ক্ষমতাসীনদের একমাত্র ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারত থেকেও একই ধরনের প্রতিক্রিয়ার খবর এসেছে। বড় কথা, মনমোহন সিং-এর সরকার এখনো নির্বাচনে বিজয় অর্জনের জন্য শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানায়নি। অভিনন্দন আসেনি অন্য কোনো দেশের সরকারের পক্ষ থেকেও। এসবের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়েছে, দেশের ভেতরে তো বটেই, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও কোনো রাষ্ট্র বা সংস্থা নির্বাচনটিকে গ্রহণ করেনি। এমন প্রতিক্রিয়া সরকারের জন্য শুধু নয়, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্যও শুভ হতে পারে না। বাংলাদেশ আসলে সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কথাটা ক্ষমতাসীনরাও যে বোঝেননি তা নয়। বুঝেছিলেন তারা আগে থেকেই। কিন্তু মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জেদ পূরণের উদ্দেশ্যেই তারা ভোটারবিহীন এ নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন। জেদও প্রধানমন্ত্রী বুঝে-শুনেই করেছিলেন। কারণ, সব জরিপ ও অনুসন্ধানেই জানা গিয়েছিল, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ কোনো নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তার পক্ষে ক্ষমতায় ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া, প্রধানমন্ত্রী নিজে অন্তত জানেন, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও তিনি জেতেননি। সেবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছিল শেখ হাসিনার ‘আন্দোলনের ফসল’ হিসেবে পরিচিত জেনারেল মইন ও ফখরুদ্দিনদের অবৈধ ও অসাংবিধানিক সরকার। ক্ষমতায় আসার পর থেকে একমাত্র ভারতের ইচ্ছা ও দাবি পূরণ এবং স্বার্থ উদ্ধার করে দেয়ার বাইরে দেশ ও জনগণের জন্য সরকার এমন কোনো কাজই করেনি, যার কারণে ভোটার জনগণ আওয়ামী লীগকে আবারও ক্ষমতায় আনবে। পাশাপাশি রয়েছে রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে সর্বাত্মক দলীয়করণ। প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগ এবং আইন-শৃংখলা বাহিনী পর্যন্ত এমন কোনো একটি ক্ষেত্রের কথা বলা যাবে না, যেখানে দলবাজি না করা হয়েছে। দুর্নীতিতেও অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছেন ক্ষমতাসীনরা। পদ্মা সেতু ও শেয়ারবাজারের মতো বহুল আলোচিত বিষয়গুলোকে এক পাশে রেখে ক্ষমতাসীনদের ব্যক্তিগত অর্থ-সম্পদের বিবরণীকে উদাহরণ বানালেও যে কাউকে চমকে যেতে ও স্তম্ভিত হতে হবে। কারণ, মাত্র পাঁচ বছরেই কারো কারো অর্থ-সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে পাঁচ হাজার গুণ পর্যন্ত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও পিছিয়ে থাকেননি। তারও অর্থ-সম্পদ বেড়েছে ১৩৯ শতাংশ। সরকার সবচেয়ে বেশি নিন্দিত হয়েছে ফ্যাসিস্ট দমন-নির্যাতন ও হত্যাকা-ের জন্য। বিরোধী দলকে দেশের কোথাও বাধাহীনভাবে কোনো মিছিল-সমাবেশ করতে দেয়া হয়নি। তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে পুলিশ, র‌্যাব এবং বিজিবি। সঙ্গে থেকেছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা। নির্বাচনপূর্ব কয়েকদিনেও পুরো দেশকে মৃত্যুপুরি বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। যৌথ অভিযানের নামে সরকার বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছে, কোনো অভিযোগ ছাড়াই শত শতজনকে গ্রেফতার করেছে। মেরেও ফেলা হয়েছে অনেককে। এভাবে সব মিলিয়েই দেশে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল সরকার। কিন্তু তা সত্ত্বেও জনগণকে ভোটকেন্দ্রের ধারেকাছে নেয়া সম্ভব হয়নি। জনগণ বরং বিরোধী দলের ডাকেই সাড়া দিয়েছে, তামাশার নির্বাচন বর্জন করেছে।
এসবের কোনো কিছুতেই ক্ষমতাসীনদের মধ্যে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেনি। এজন্যই নির্বাচন নামের প্রহসন শেষ হতে না হতেই তারা ‘নবনির্বাচিত’ সংসদ সদস্যদের শপথ পাঠ করানোর জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিলেন। আওয়ামী স্পীকার শিরিন শারমিন চৌধুরীও লাফিয়ে এসেছেন। প্রথমে কপালে হাত ঠেকিয়ে ‘সালাম’ দিয়েছেন এবং তারপর সামনের দিকে অর্ধেকের মতো ঝুঁকে ‘কুর্ণিশ’ করেছেন। উদ্দেশ্য প্রধানমন্ত্রী হলেও উপস্থিত সকলেই মাননীয় স্পীকারের বিনয়ে মুগ্ধ হয়ে গেছেন। এরপর এসেছে শপথবাক্য পাঠ করানোর পালা। তিনটি পৃথক পর্বে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং স্বতন্ত্রসহ অন্যদের শপথবাক্য পাঠ করিয়েছেন স্পীকার। ঘটনাপ্রবাহে আপত্তি ও প্রশ্ন উঠেছে সংবিধানের আলোকে। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পূর্ববর্তী সংসদকে বহাল রেখে নতুন সংসদের নির্বাচন এবং নির্বাচিত সদস্যদের শপথ পড়ানোটা সংবিধানসম্মত নয় বরং সংবিধানের লঙ্ঘন। কারণ, সংবিধানের ১২৩(ক) অনুচ্ছেদের নির্দেশনা হলো, সংসদ ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হলেও নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা বিদ্যমান সংসদ মেয়াদ পূরণ করার বা বিলুপ্ত হওয়ার আগে দায়িত্বভার নিতে পারবেন না। অর্থাৎ তারা শপথবাক্য পাঠ করতে পারবেন না। অনুচ্ছেদটির নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা দেয়ার দরকার পড়ে না। কারণ, ‘নবনির্বাচিত’রা শপথ নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা এমপি হিসেবে সব দায়িত্ব, ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা পেয়ে যাবেন। ওদিকে আবার পুরনোরাও একই অবস্থানে থাকবেন। অর্থাৎ একই দেশে একই সময়ে দুই দল সংসদ সদস্য থাকবেন, যা স্বাভাবিক অবস্থায় কল্পনা করা যায় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ক্ষমতাসীনরা সংবিধানেরই অন্য এক অনুচ্ছেদ ১৪৮(২)(ক) অনুযায়ী শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন নির্বাচিতদের নাম সংবলিত গেজেট প্রকাশ করার তিনদিনের মধ্যে এমপিদের শপথ নিতে হবে। সে হিসেবে শপথ নেয়াটা দরকারও হয়ে পড়েছিল। কারণ, নির্বাচন কমিশন গেজেট প্রকাশ করেছে ৮ জানুয়ারি। পরের তৃতীয়দিন যেহেতু ছুটিরদিন শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) সেহেতু গেজেট প্রকাশের পর দ্বিতীয় দিনেই (৯ জানুয়ারি) শপথ নিয়েছেন ‘নবনির্বাচিত’রা।
এর ফলে সব মিলিয়েই এক বিচিত্র পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষমতাসীন নেতাদের মধ্যে কেউ বলেছেন, নতুন এমপিরা শপথবাক্য পাঠ করার সঙ্গে সঙ্গে নবম সংসদের বিলুপ্তি ঘটেছে এবং বেগম খালেদা জিয়া এখন আর বিরোধী দলের নেত্রী নন। ক্ষমতাসীন নেতাদেরই কেউ কেউ আবার ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত নবম সংসদ বহাল থাকবে বলে জানিয়েছেন। এটা সত্য হলে এই মুহূর্তের বাংলাদেশে দুটি সংসদ যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছেন দুই দল সংসদ সদস্যও। অন্যদিকে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা কিন্তু বিলুপ্তি সংক্রান্ত অভিমত বা সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। তারা মনে করেন, জাতীয় সংসদ ছেলে খেলার মতো কোনো বিষয় নয় যে, সংসদ সচিবালয় বা অন্য কোনো ব্যক্তির দেয়া ঘোষণাতেই তার বিলুপ্তি ঘটবে। কিন্তু সঠিক এবং অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত হলেও বিশেষজ্ঞসহ রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো আপত্তি বা ব্যাখ্যাকেই বিবেচনায় নেয়া হয়নি। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি তৎপরতা দেখিয়েছে নির্বাচন কমিশন। প্রায় দশ কোটি ভোটারের মধ্যে এক কোটিরও কম ভোটারের ভোটে ‘নির্বাচিত’দের নামসহ গেজেট প্রকাশের ক্ষেত্রেও কমিশন যথারীতি ‘অথর্ব’ ও ‘মেরুদ-হীন’ সেবাদাসের ভূমিকাই পালন করেছে। বলা দরকার, অতীতে আর কখনো আর কোনো কমিশন এত অল্প সময়ের মধ্যে গেজেট প্রকাশ করেনি। সে কারণে বলা যায়, ১৫৩ জনকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ ঘোষণার পাশাপাশি গেজেট প্রকাশের সময়ের দিক থেকেও কমিশন রেকর্ডই স্থাপন করেছে বটে! ওদিকে সংবিধান লংঘনের ক্ষেত্রে সরকারও যথেষ্টই দেখিয়েছে। কারণ, বিদ্যমান সংসদকে ‘ভঙ্গ’ করার বা ভেঙে দেয়ার ব্যাপারে সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদের (১) উপ-অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতিকেই শুধু ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি তেমন কোনো নির্দেশ বা ঘোষণা দেয়ার আগেই একদিকে ‘নবনির্বাচিত’দের শপথ পড়ানোর মধ্য দিয়ে এক দেশে দুটি সংসদ এবং দুই দল এমপি সৃষ্টি করা হয়েছে, অন্যদিকে এসেছে বিদ্যমান নবম সংসদের বিলুপ্তি ঘটানোর প্রশ্নসাপেক্ষ ঘোষণা। বিষয়টি নিয়ে ‘মহামান্য’ রাষ্ট্রপতি কিছু বলুন আর না-ই বলুন, ক্ষমতাসীনরা কিন্তু সংবিধান লঙ্ঘন করেই থেমে যাননি, একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতিকেও চরমভাবে অসম্মানিত করেছেন।
এভাবে পর্যালোচনায় দেখা যাবে, সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে বিরোধী দলকে বাইরে ঠেলে দিয়ে নির্বাচন নামের হাস্যকর অনুষ্ঠান আয়োজন করা থেকে ‘নবনির্বাচিত’ সংসদ সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করানো এবং নবম সংসদের বিলুপ্তি ঘটানো পর্যন্ত কর্মকা-ের কোনো পর্যায়েই সংবিধানের নির্দেশনা অনুসরণ করা হয়নি বরং ইচ্ছাকৃতভাবে সংবিধান লংঘন করেছেন ক্ষমতাসীনরা। আপত্তি ও প্রতিবাদের কারণ হলো, ক্ষমতাসীনদের মধ্যে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটানোর ব্যাপারে ন্যূনতম সদিচ্ছা থাকলেও সংবিধানের ভিত্তিতেই তারা বিরোধী দলের জন্য নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারতেন। কারণ, ১২৩-এর একই অনুচ্ছেদে সংসদ বিলুপ্তির পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অুষ্ঠানের নির্দেশনা রয়েছে। সেটা অনুসরণ করা হলে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যেতো। বিশেষ করে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর মধ্যস্থতায় বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচনে আনা সম্ভবও হতো। কিন্তু সহজবোধ্য কারণে সংবিধান ও গণতন্ত্রসম্মত সে পথটিতে যাননি ক্ষমতাসীনরা। আগেও বলা হয়েছে, কারণটি হলো, তারা জানতেন, মোটামুটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলেও নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি ঘটতো এবং তারা আবারও ক্ষমতায় আসতে পারতেন না। এজন্যই মারমুখী হয়ে ওঠার পাশাপাশি সময়ে সময়ে তারা উস্কানিমূলক এমন কৌশলও অবলম্বন করেছেন যাতে ইচ্ছা থাকলেও বিরোধী দলের পক্ষে নির্বাচনে অংশ নেয়া সম্ভব না হয়। বাস্তবে ক্ষমতাসীনদের এ কূটিল কৌশলই সফল হয়েছে। একতরফা নির্বাচন আয়োজনের পরপর রাতারাতি তারা সংসদ সদস্য হিসেবে শপথও নিয়ে ফেলেছেন। এখন প্রস্তুতি চলছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই নতুন সরকার গঠনের। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামীকাল ১২ জানুয়ারি নতুন মন্ত্রীরা শপথ নেবেন।
বলা দরকার, সংবিধানের যথেচ্ছ ব্যাখ্যার আড়ালে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের বৈধ হিসেবে দাবি করতেই পারেন, কিন্তু সংবিধানের সঠিক ব্যাখ্যার আলোকে তো বটেই, জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখেও পুরো বিষয়টি অসাংবিধানিক এমনকি অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত হবে। কারো কাছেই তারা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারবেন না। এতে অবশ্য কিছুই যায়-আসে না তাদের। কারণ, গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটানোর এবং দেশকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য এতসব কা- তারা করেননি, করছেনও না। তাদের লক্ষ্য জাতির ওপর বাকশালের মতো একদলীয় শাসন চাপানো। শুধু তা-ই নয়, কোনো এক বিশেষজন আবার ভারতের পেটে ঢুকে যাওয়া স্বাধীন রাষ্ট্র সিকিমের ‘মীর জাফর’ হিসেবে নিন্দিত এককালের জনপ্রিয় নেতা লেন্দুপ দর্জির ভূমিকা পালনের জন্যও উঠে-পড়ে লেগে আছেন। লেন্দুপ দর্জির মতো তিনিও চাচ্ছেন সংসদের মাধ্যমেই ভারতের হাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা তুলে দিতে। ওই বিশেষজনের পরিকল্পনা সফল হলে টান পড়তে পারে দেশের সমগ্র অস্তিত্ব নিয়ে। তবে আশার কথা হলো, বর্তমান বাংলাদেশে একদিকে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল রয়েছে অন্যদিকে জনগণও যে যথেষ্ট সচেতন তার প্রমাণ পাওয়া গেছে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে। ক্ষমতাসীনরা এবং তাদের হুকুমে নির্বাচন কমিশন অসত্য বললেও প্রমাণিত সত্য হলো, এই নির্বাচনে ভোট পড়েছে বড়জোর পাঁচ থেকে সাত শতাংশ। এর মধ্য দিয়ে জনগণের দেয়া মেসেজ বা বার্তার মূলকথা হলো, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে তারা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। সুতরাং নির্বাচনকে তো বটেই, তথাকথিত দশম সংসদকেও অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। সেই সাথে ১৮ দলীয় জোটের দাবি অনুযায়ী নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার গঠনের বিধানও সংবিধানে যুক্ত করতে হবে। সুষ্ঠু ও গণতন্ত্রসম্মত এই পথে পা বাড়ানোর পরিবর্তে আবারও পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় যাওয়ার এবং একদলীয় সংসদকে দিয়ে একদলীয় শাসন চাপানোর চেষ্টা করলে ঘটতে পারে গণঅভ্যুত্থান- যার পরিণতি ক্ষমতাসীনদের জন্য অবশ্যই শুভ হবে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads