শনিবার, ৪ জানুয়ারী, ২০১৪

গণতন্ত্র বিসর্জনের নির্বাচন


আমরা কেন সমাজবদ্ধ হলাম, কেন রাষ্ট্র গঠন করলাম এমন প্রশ্ন আজ জনমনে প্রকট হয়ে উঠেছে। মানুষ তো সমাজবদ্ধ হয়েছে মানবিক প্রয়োজনে, রাষ্ট্র গঠন করেছে মানবিক মর্যাদা, ন্যায় ও সুশাসনের মাধ্যমে উন্নত জীবনযাপনের আকাক্সক্ষায়। আর এখন লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য বাংলাদেশের জনগণ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে পছন্দ করেছে। তাই যখনই গণতন্ত্রের ওপর আঘাত এসেছে, জনগণ তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে। দুঃখের বিষয় হলো, ঐতিহ্যবাহী এমন একটি রাষ্ট্রে গণতন্ত্র এখন হুমকির সম্মুখীন। একটি অবাধ ও অর্থবহ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থ বর্তমান সরকার বিভিন্ন বাহিনী দিয়ে বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নির্মমভাবে অবদমনে ব্যস্ত রয়েছে। বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের কারারুদ্ধ করে রাখার পর এখন আবার বিরোধী জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নিজ বাসভবনে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। তাকে কোনো কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হচ্ছে না, দলীয় নেতা-কর্মীদেরও তার সাথে দেখা করতে দেয়া হচ্ছে না। একদল ও এক নেতার অঙ্গুলী হেলনে দেশ শাসনের এমন অগণতান্ত্রিক পরিবেশে জনমনে ক্ষোভের মাত্রা বেড়েই চলেছে। দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক তথা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইলেও সরকার তা প্রত্যাখ্যান করে একদলীয় নির্বাচনের পথেই এগিয়ে গেল। ফলে বিরোধী দল ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আসলে এ নির্বাচনের তো কোনো গুরুত্বই নেই। জনগণের ভোট ছাড়াই ১৫৩টি আসনে সরকারি ঘরানার লোকজন নির্বাচিত হয়ে গেছে, আর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভাগ-বণ্টন হবে বাকি আসনগুলোর। এ কারণে বাংলাদেশের দশম জাতীয় নির্বাচন দেশে-বিদেশে কোথাও গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। তারপরও অর্থহীন এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলের প্রতি সরকার ও সরকার দলীয় নেতা-কর্মীরা যে জুলুম-নির্যাতন ও নিষ্পেষণ চালিয়েছে তাতে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির চরিত্রই দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ ও জাতীয় প্রেস ক্লাব অঙ্গনে ভিন্ন মতের আইনজীবী ও সাংবাদিকদের ওপর ২৯ ডিসেম্বরে ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থকরা যে নৃশংস হামলা চালিয়েছে তাতে জাতি বিস্ময়ে হতবাক হয়েছে। সে দিন সুপ্রিম কোর্ট ও প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণ দৃশ্যত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ফ্যাসিবাদী এই হামলায় আইনজীবী ও সাংবাদিকসহ বেশ কয়েকজন নাগরিক আহত হয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে একজন নারী আইনজীবীকে বেধড়ক লাঠিপেটা করেছে সরকার দলীয় ক্যাডাররা। এ সময়ে পুলিশ ছিল বীভৎস দৃশ্যের দর্শক। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের কথা তারা ভুলে গিয়েছিলেন। এসবই ফ্যাসিবাদী শাসনের আলামত। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে ঢুকে আইনজীবীদের ওপর হামলার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে দেশের প্রবীণ আইনজীবী ও সাবেক এটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের জানাযা হয়ে গেছে। বর্তমান সরকার ও সরকারি দলের আচরণে শুধু সুপ্রিম কোর্টেরই জানাযা হয়নি, দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতিরও জানাযা হতে চলেছে। এমন পরিস্থিতিতে গত ৩ জানুয়ারি এক বিবৃতিতে কলঙ্কময় প্রহসনের নির্বাচন বর্জন এবং ভোটাধিকার রক্ষায় দেশবাসীসহ নেতা-কর্মীদের প্রতিটি জনপদে দুর্বার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া।
বর্তমান সরকারের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, গণতন্ত্রের চর্চা নয় বরং যে কোনোভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকাই তাদের লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে সফল হওয়ার জন্য দমন-পীড়নের পাশাপাশি বিরোধী দলের ইমেজ বিনষ্টের উদ্দেশ্যে সরকার ও সরকারি দল গ্রহণ করছে চাতুর্যপূর্ণ নানা কৌশল। আমরা জানি, বিরোধী দল যখন রাজপথের আন্দোলনে থাকে তখন ভাংচুর ও কিছু জ্বালাও-পোড়াও এর ঘটনাও ঘটে থাকে। এসব কাজে আওয়ামী লীগ বেশ সিদ্ধহস্ত। তবে এবার সরকারে থেকেও আওয়ামী লীগের তৎপরতা কম নয়। বিভিন্ন জায়গায় বাসে পেট্রোল বোমা হামলা, বিচারপতির বাসায় হামলা ও রেল লাইনের ফিশপ্লেট খুলে ফেলার মতো তৎপরতায়ও সরকারি দলের লোকজনের জড়িত থাকার খবর পত্রিকায় মুদ্রিত হয়েছে। প্রথম দিন ১ জানুয়ারিতে বাসে পেট্রোল বোমা দিয়ে আগুন ধরানোর চেষ্টাকালে ছাত্রলীগের ৩ নেতা-কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। মাগুরার পারনান্দুয়ালি কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকা থেকে ১ জানুয়ারি রাত পৌনে ৮টার দিকে তাদের আটক করা হয়। তাদের কাছে পেট্রোলভর্তি দুটি বোতল ও দিয়াশলাই পাওয়া গেছে। নাশকতা সৃষ্টি তাদের উদ্দেশ্য ছিল বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে আটক ৩ ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী। এভাবে নাশকতা সৃষ্টির পর তার দায় বিরোধী দলের ওপর চাপিয়ে দেয়া এখন সরকারি দলের কৌশলে পরিণত হয়েছে। একেই বলা হয় উদোর পি-ি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার অপকৌশল। এমন কৌশল গণতান্ত্রিক রাজনীতির কৌশল হতে পারে না। বর্তমান সরকার দমন-পীড়ন ও অপকৌশলের মাধ্যমে বিরোধী দলকে পরাস্ত করে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে চাইছে। কিন্তু এতে যে তাদের জনসমর্থনের পারদ নিচের দিকে নামছে, তা দেখার মতো চোখ কি তাদের অবশিষ্ট নেই? আর জনসমর্থন হারালে যে ক্ষমতাও হারাতে হয়, সে কথা কি তারা ভুলে গেছেন? সরকারের আচরণ এখন জনমত ও গণতন্ত্রের বিপক্ষে। এমন গণবিরোধী আচরণ থেকে সরে না আসলে সামনে সরকারের জন্য অপেক্ষা করছে বড় পরাজয়। বিষয়টি উপলব্ধি করলেই তাদের মঙ্গল।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads