শনিবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০১৪

গলাকাটা লাশ


ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

গত দুই মাসে গলাকাটা লাশের হিড়িক পড়েছে। ঝোপজঙ্গল, বনবাদাড়, নদী, খাল, ডোবা এসব জায়গায় অজ্ঞাত পরিচয়ে লাশ পাওয়া যাচ্ছে। এ নিয়ে সরকারের ভেতরে কোনো উদ্বেগ আছে বলে মনে হয় না। পেশিশক্তি, র‌্যাব-পুলিশ-বিজিবি এসবের জোরে সরকার বলেই যাচ্ছে, সারা দেশে শান্তির নহর বইছে। আরো যত প্রয়োজন তত বেশি তারা কঠোর হবে। কঠোর হলে তার পরিণতি কী হবে তার নমুনাও এখনই জনগণ দেখতে পাচ্ছে। এখন সরকার বড় বেশি এলোমেলো হয়ে গেছে। মন্ত্রীদের কে কী বলছেন তার কোনো হিসাব নেই। কেউ বলছেন, আমরা সংলাপে প্রস্তুত। কেউ বলছেন, আগামী পাঁচ বছরে নির্বাচন বা সংলাপের প্রশ্নই ওঠে না। কেউ বলছেন, বিএনপির সাথে সমঝোতা হলেই কেবল মধ্যবর্তী নির্বাচন হতে পারে। আবার কেউ কেউ বলছেন, সমঝোতার শর্ত হলো বিএনপিকে সন্ত্রাস বন্ধ করতে হবে, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে।  কেউ বলছেন বিএনপি-জামায়াত স্বাধীনতাবিরোধী, এদের সাথে সংলাপ সমঝোতা কোনটাই নয়। আজব সব আবদার। আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী এমন সব কথা বলছেন, যার জন্য বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে লজ্জাবোধ হয়। সব কিছুকেই তিনি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে এমন তাচ্ছিল্য করেন যে, কখনো কখনো আমরা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন নাগরিকেরা লজ্জিত হই।
গত ২৩ জানুয়ারি অভয়নগরের সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘গোলাপি রে গোলাপি, ট্রেন তো মিস করলি।দারুণ কথা। বাংলাদেশের একজন আইন মানা নাগরিক হিসেবে অ-আ-ক-খ জানা নাগরিক হিসেবে আমরা লজ্জাবোধ করেছি। জোর জবরদস্তি করে ভোটারবিহীন নির্বাচন করে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করে, নাম ঘোষণার মাধ্যমে সংসদ করে প্রধানমন্ত্রী মনে হয় ধরাকে সরাজ্ঞান করছেন। তা না হলে তিনি দেশের বৃহত্তম বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উদ্দেশে এমন কটূক্তি করতে পারতেন না। আমাদের বড় ভয় হয়, প্রধানমন্ত্রী কখনো আরো কী বেফাঁস কথা বলেন। ইতোমধ্যে তিনি অনেক কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, বিদেশীরা তাকে যত চাপই দিক না কেন, তাতে তার কিছুই আসে-যায় না, তিনি চলবেন তার মতো।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনা এক অধিনায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রেস বিফ্রিংয়ে বলেছেন, বিশ্বপরিস্থিতি যা, তাতে বর্তমান সরকার নিজের খেয়ালখুশিমতো চললে বিপদ অত্যাসন্ন। এতে ব্যক্তি ও স্থানীয় বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। বিদেশী বিনিয়োগ আসবে না। রেমিট্যান্স-প্রবাহ কমতেই থাকবে। ফলে সরকার এক জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। যদিও দেবপ্রিয়দের অভিপ্রায় খুব স্পষ্ট নয়। তারা গণতন্ত্র ঘাতকদের সমর্থন করেছেন। এ দেশে সামরিক শাসন আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। সেভাবে দেবপ্রিয় জেনেভা শান্তি মিশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে চাকরি পেয়েছিলেন। চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই আবার শুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। এখন নানা ধরনের সারমন দিয়ে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করার চেষ্টা করছেন। এরা সৎ প্রার্থীর খোঁজে বিদেশী টাকায় জেলায় জেলায় সম্মেলন করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু রাজনীতিকদের ধাওয়া খেয়ে তারা আবার রাজধানীতে ফিরে আসেন। জয়তু সুশীলসমাজ।
এখন আবার এসে দিব্যি সুশীল হয়ে গেছেন। ভালো হয়ে গেছেন। এখন আমরা দেবপ্রিয় ভাষণ শুনি। তার বক্তব্যের জন্য দাঁড়িয়ে থাকি। দেবপ্রিয় ভনেন, আমরা পুণ্যজনেরা শুনি। বাংলাদেশের মানুষ কী মাত্রায় সহনশীল, সেটা দেবপ্রিয়ের পুনরুত্থানে টের পাচ্ছি। বাংলাদেশের নাগরিকেরা সম্ভবত অসহায়ই। তা না হলে দেবপ্রিয়ের সারমনকে আমরা এত গুরুত্ব দেবো কেন? কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিকদের যতটা অসহায় ভাবছি, তারা কিছুতেই তা নন। গত কয়েক মাসে তারা জানান দিয়েছেন, তারা ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠায় কতটা উদগ্রীব। সত্য যেখানে ভূলুণ্ঠিত, মানুষ সেখানে প্রতিবাদী। তাই সত্য এখন বিতাড়িত।
আমরা দেখেছি, সংখ্যালঘু নিয়ে অনেক রাজনীতি হলো। কিন্তু যেখানেই শেষ পর্যন্ত প্রকৃত আসামি ধরা পড়ল, সেখানেই দেখা গেল আসামি আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ কর্মী। কেবল জামায়াত-শিবির, জামায়াত-শিবির জিগির সেখানে কার্যকর হলো না। হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালায় কে? আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ। কেন? তাদের সম্পত্তি দখল এবং ওইসব পরিবারের মেয়েদের ইজ্জতহানি। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা এক সময় চুপ ছিলেন। এখন মুখ খুলছেন। তারা বলছেন, তাদের ওপর নির্যাতন করছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ। জামায়াত-বিএনপি বরং তাদের রক্ষা করেছে। কতকাল তারা আওয়ামীপ্রীতির জন্য এ অত্যাচার সহ্য করে যাবেন? ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ বলেছেন, সরকার যেভাবে সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষায় উদ্যোগ নিয়েছে তাতে তারা সন্তুষ্ট। পঙ্কজ শরণ বুঝে দেখতে চাননি যে, কারা এই সহিংস কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত এবং সরকার তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছে।
এখন এ রকমই ডামাডোল চলছে। আর এই ডামাডোলের ভেতরে সরকার নানা কিসিমের ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। এক দিকে ভোটারবিহীন নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হিসেবে কিছু নাম ঘোষণা করে দিয়ে ভালো বেকায়দায়ই পড়ে গেছে সরকার। জোরগলায় শুধু বললেই হবে না যে, নির্বাচন করেছি, পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকব। যে বিদেশীরা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দাবি করে আসছে, তাদের উদ্দেশ করে জবরদস্তির এই সরকার নানা কটূক্তি ও বেপরোয়া কথাবার্তা বলছে। আর এই ফাঁকে সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে তার ফলে এই বাহিনীর সদস্যরাও বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। বিরোধী দল দমনের ক্ষেত্রে এরা যা করছে, তাতে খুব সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন উঠেছে যে, এরা কারা? এরা যদি বাংলাদেশেরই মানুষ হতো, তাহলে দেশের আর একজন মানুষের ওপরও এরা এমন বর্বর নির্যাতন চালাতে পারত না। সে নির্যাতন অবর্ণনীয়। বাড়িঘরে হামলা চালাচ্ছে। নারী-পুরুষ-শিশুদের বেইজ্জতি করছে। বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। এ কাজে পুলিশের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে সরকারদলীয় লোকেরা। কোথাও কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন গিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রশ্ন করছে, এ এলাকায় জামায়াত-শিবির-বিএনপি কে করে। তারপর বেছে বেছে সেসব বাড়িতে হামলা চালানো হচ্ছে।
সরকার বা র‌্যাব-পুলিশের সদস্যরা এটা বুঝতেই চাচ্ছে না যে, সব ধরনের অ্যাকশনের একটা রি-অ্যাকশন আছে। মানুষ অনন্তকাল ধরে এসব জুলুম-নির্যাতন মেনে নেবে না। প্রতিবাদ তারা করবেই। কারণ সরকার শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের পথও রুদ্ধ করে দিচ্ছে। এখন প্রতিদিনই ৫-১০ জন অজ্ঞাত পরিচয়ের লাশ নানা জায়গা থেকে উদ্ধার হচ্ছে। বেড়ে গেছে শিশুহত্যার হারও। অভিযোগ উঠছে, ক্ষমতাসীনদের লোকেরা অনেক শিশুকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করছে। মুক্তিপণ নিয়ে বা না নিয়ে ওই শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। প্রতিদিনই এ রকম হত্যাকাণ্ডের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এসব হত্যাকাণ্ডের ধরনের ভেতরেও অদ্ভুত মিল লক্ষ করা যায়। আর তা হলো, লাশের গলাকাটা। গত ২২ দিনে সারা দেশ থেকে ১৮ ব্যক্তির গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এসব লাশের ঘাতক কি একই শ্রেণী-পেশার লোক? এরা কি গলাকাটায় বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত? এমন হাজারো প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মনে।
গলাকাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, একজন পুলিশ কনস্টেবল পুলিশ লাইনের ভেতরেই, যেখানে শত শত পুলিশ বসবাস করেন, সেখানে একজনের গলা কেটে মুণ্ডু পৃথক করে পলিথিনের ব্যাগে ভরে মুণ্ডু ফেলে দিয়েছে পুলিশ লাইনেরই পুকুরে। পুলিশ বাহিনীর একজন সদস্য এই কাজ করতে পারে, এটা আমাদের বিবেচনায় আসে না। কিন্তু আসুক বা না আসুক কাজটি সে করেছে। তবে কি তাকেও ওই রকম প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, যার জোরে সে একজন মানুষকে গলা কেটে হত্যা করতে পারে? এবং পৃথককৃত মাথাটি বয়ে নিয়ে গিয়ে ব্যারাকের ভেতরেই ফেলে দিতে পারে। এ ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে গেছে দেশের সাধারণ মানুষ। কিন্তু সরকারের এ দিকে নজর আছে বলে মনে হয় না।
আরো উদ্বেগের কথা, অনেক ক্ষেত্রেই নিহত ব্যক্তির পরিবার দাবি করছে, র‌্যাব বা পুলিশ তাদের স্বজনদের মামলার কথা বলে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে। তারপর পাওয়া গেছে ওই ব্যক্তির লাশ; গলাকাটা কিংবা গুলিতে নিহত। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিপদ হলো এই যে, র‌্যাব-পুলিশের পরিচয়ে তুলে নিলেও কেউ দায়িত্ব স্বীকার করছে না। তাহলে জনগণ কী করবে? র‌্যাব-পুলিশের পরিচয়ে কেউ যদি কাউকে গ্রেফতার করতে আসে, তবে কি তাদের আটকে রেখে এরা প্রকৃতই র‌্যাব বা পুলিশ কি না সেটি যাচাই করবে? কিংবা র‌্যাব-পুলিশের কাছ থেকে লিখিত নেবে যে, এরা অমুককে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। এর কোনোটাই সম্ভব নয়। কিন্তু জনগণ তো বসে নেই। তারা প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করেই যাচ্ছে। কোথাও কোথাও এমনও হয়েছে যে, দলমত নির্বিশেষে গ্রামবাসী র‌্যাব-পুলিশকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। তারপর বিজিবি-সেনাবাহিনী গিয়ে তাদের উদ্ধার করে এনেছে। সরকার যদি সচেতন না হয়, তাহলে এমন ঘটনা আরো ঘটবে। গণতন্ত্রের সাথে সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মৃত্যুঘণ্টা বাজতেও দেরি হবে না। 


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads