সোমবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৪

পুলিশের দায়িত্ব ও শিশু স্বর্ণার চপেটাঘাত


ঘটনাস্থল সিলেট। নগরীর জিন্দাবাজার থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়–য়া ছোটবোন নুসরাত জাহান স্বর্ণাকে নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন মদনমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র শেখ সোহান ইসলাম। লামাবাজার পুলিশফাঁড়ির কাছে যাবার পরপরই মোটরসাইকেলের গাতিরোধ করে ৮-১০ জন যুবক। একপর্যায়ে চড়াও হয় যুবকরা সোহানের ওপর। মারধর ও ছুরিকাঘাতে ভাই সোহান মাটিতে লুটিয়ে পড়লে স্বর্ণা দৌঁড়ে কাছের পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে ভাইকে বাঁচানোর অনুরোধ করে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়–য়া ছোট্ট মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে পুলিশের হাত-পাও ধরে কাকুতি-মিনতি করে। কিন্তু পুলিশের এতে মন গলেনি। তারা মেয়েটির কথায় পাত্তা দেয়নি। পরে সোহানকে মেরে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে হন্তারকরা পালিয়ে গেলে মানুষের চেঁচামেচি শুনে ফাঁড়ি থেকে বের হয়ে পুলিশ তার মৃতদেহ উদ্ধার করে। সোহান নগরীর খুলিয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা সাবেক মহিলা কাউন্সিলর ও জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের কেন্দ্রীয় নেত্রী শাহানা বেগম শানু এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা তাজুল ইসলামের ছেলে। গত ২৬ জানুয়ারি রোববার বেলা আড়াইটার দিকে এ মর্মান্তিক হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটে। সোহানের বোন শিশু স্বর্ণা জানায়, তার কাকুতি-মিনতি শুনে পুলিশ এগিয়ে এলে হয়তো এ হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটতো না। সোহানের মা জানিয়েছেন, হত্যাকা-ের শিকার সোহানের জন্মদিন ছিল ঘটনার পরের দিন ২৭ জানুয়ারি সোমবার। এ উপলক্ষে সোহান তার বন্ধুদের দাওয়াতও দিয়েছিল। কিন্তু দুর্বৃত্তরা তাকে বাঁচতে দিল না। হন্তারকরা মোটরসাইকেলটি না নিলেও মোবাইল ফোনটি নিয়ে গেছে বলে সোহানের বাবা জানিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট পুলিশ অবশ্য পরে জানায় যে, পূর্ব শত্রুতার জের হিসেবে এ হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটতে পারে। এ ব্যাপারে পুলিশী তদন্ত চলছে বলে জানানো হয়েছে।
দিনেদুপুরে সোহানের মর্মান্তিক হত্যাকা-ের বিবরণ শুনে মনে হচ্ছে, “ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী যেমন মরিয়া যায়, ঠিক তেমনই পুলিশ আসিবার পূর্বে সোহানরা দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হয়।” এভাবে কেবল শেখ সোহান ইসলাম একাই দুর্বৃত্তদের দ্বারা মারা যাননি। প্রতিদিন অসংখ্য সোহান দুর্বৃত্তের হাতে নিহত হচ্ছে। মা-বাবার বুক খালি হচ্ছে। পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে হন্তারকদের রুখে দিয়ে হামলার শিকার মানুষকে রক্ষা করতে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। অথচ সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় পুলিশের বেতন-ভাতা দেয়া হয়। পুলিশ শুধু সরকারি হুকুম তামিলের জন্যই নয়, জনগণের জান-মাল রক্ষারও দায়িত্ব পুলিশের। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ঔপনিবেশিক আমল থেকে পুলিশ সরকারের পেটোয়াবাহিনীরূপে বিবেচিত হয়ে আসছে। পুলিশের এ মানসিকতা এখনও পুরোপুরি দূরীভূত হয়েছে বলা যায় না। তবে ঔপনিবেশিক আমলের পুলিশ এবং স্বাধীন দেশের পুলিশের কর্মপদ্ধতির পরিবর্তন তো কিছু হলেও সাধিত হয়েছে। আমরা মনে করি পুলিশকে আরও আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। প্রশিক্ষণ দিতে হবে। শুধু অপরাধী ধরে এনে থানায় বেঁধে মারধর করে স্বীকারোক্তি আদায়ই পুলিশের কাজ নয়। অপরাধ ও অপরাধীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমে গিয়ে মানুষ যেন সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। সমাজে যাতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকে ও নাগরিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত হয় সে ব্যাপারেও পুলিশকে কাজ করতে হবে। আগের দিন থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ চলে আসছে সেগুলো যেন না থাকে এ বিষয়ে সরকার ও পুলিশ প্রশাসনকে নতুন করে ভেবে দেখতে হবে। প্রয়োজনে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা নিরসনে আন্তরিক হতে হবে। পুলিশ যে মানুষের বন্ধু তা দেখাতে হবে কার্যক্ষেত্রে।
সিলেটের লামাবাজারের পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা সোহানের বোন শিশু স্বর্ণার সঙ্গে যে আচরণ করেছে তা শুধু পুলিশের দায়িত্বের অবহেলার মধ্যেই পড়ে না। তারা মানবাধিকারও লংঘন করেছে। শিশুটি যখন দুর্বৃত্তদের দ্বারা আক্রান্ত বড়ভাইকে রক্ষার জন্য পুলিশের হাত-পা ধরে কান্নাকাটি করছিল তখন তাদের দৃষ্টি কোনদিকে ছিল? কেন তারা ফাঁড়ি থেকে বের হয়ে ঘটনাটি যাচাই করলো না তাৎক্ষণিকভাবে? দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়–য়া ছোট্ট একটি মেয়েশিশু যেভাবে পুলিশের কাছে ছুটে গিয়ে ভাইকে বাঁচানোর জন্য আকুলি-বিকুলি করে সাহায্য চাইলো, সচেতনতা দেখালো তা অনেকটাই নজিরবিহীন বৈকি। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, পুলিশ তার কর্তব্যপরায়ণতা দেখাতে চরমভাবে ব্যর্থ হলো। বলা যায়, পুলিশের অবহেলার জন্যই তাদের ফাঁড়ির সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে সম্ভাবনাময় তরুণ সোহানের জীবনপ্রদীপ নিভে গেল। স্বর্ণা নামের শিশুটি তার প্রিয় ভাইকে চোখের সামনে দুর্বৃত্তদের হাতে জীবন দিতে দেখলো। অথচ এ ভাইটি মোটরসাইকেলে করে স্বর্ণাকে স্কুল থেকে আনতে গিয়েছিল কিছুক্ষণ আগে। এ মেয়ে শিশুটি সমাজের কাছে কী শিখলো। পুলিশের কাছেইবা কী পেল সাহায্য চাইতে গিয়ে? আমাদের মনে হয়, শিশু স্বর্ণা ভাইকে বাঁচাতে গিয়ে পুলিশের সাহায্য চেয়ে নিজেই কেবল ব্যর্থ হয়নি। আমাদের পুলিশ প্রশাসন, রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজ সবকে ব্যর্থ হিসেবে প্রতিপন্ন করলো। এটা আমাদের সবার প্রতি শিশু স্বর্ণার চপেটাঘাত বৈকি। এ চপেটাঘাতে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ববোধ, চৈতন্য, বিবেক বলে কিছু থাকলে সেগুলো জাগ্রত হবে তো?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads