বুধবার, ২২ জানুয়ারী, ২০১৪

সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরু সবাই এখন নির্যাতিত


ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকারের ভোটারবিহীন একতরফা পাতানো নির্বাচনের আগে-পরে দেশের কয়েকটি জেলা ও উপজেলায় সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর এবং তাদের ঘর-বাড়ী, সহায়-সম্পত্তির ওপর বর্বর হামলার ঘটনা ঘটেছে। অনাকাংক্ষিত এবং ঘৃণিত এসব ঘটনা নিয়ে টেলিভিশনের টকশো, আলোচনাসভা, পত্র-পত্রিকায় তোলপাড় চলছে। রাজনৈতিক দলের নেতা, বুদ্ধিজীবী সমাজ, পেশাজীবী সমাজ, এনজিও, সামাজিক সংগঠন, মানবাধিকার সংস্থা, বিশিষ্টজন, বিদ্যাজীবীসহ সর্বমহলে তোলপাড় হচ্ছে, নিন্দার ঝড় উঠেছে। দেশের কোনো বিবেকবান মানুষ এ ধরনের ঘটনাকে সমর্থন করতে পারেন না। হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপর এ ধরনের আক্রমণের সাথে যারা জড়িত তদন্তপূর্বক বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু প্রহসনের নির্বাচনের আগে-পরে সারা দেশের সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণের ঘটনা কোনো অংশে কম ঘটেনি। বর্বরোচিত এসব ঘটনার সংখ্যা বিবেচনা করলে সারাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের কয়েক শ’ বাড়ীঘরে আক্রমণ হয়েছে, আর সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক সংখ্যাগুরু মুসলমানদের হাজার হাজার বাড়ী-ঘর, সহায়-সম্পত্তিতে আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। সারাদেশে লাখ লাখ সংখ্যাগুরু মুসলমান এখন নিজেদের বাড়ী-ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন না। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে প্রতিটি শহর, বন্দর, জেলা ও উপজেলা, গ্রামগঞ্জ, পাড়া-মহল্লায় আওয়ামী লীগ, যুব লীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সন্ত্রাস,  জুলুম-নির্যাতনের পাশাপাশি যৌথবাহিনী (পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবি) ঘরে ঘরে তল্লাশির নামে বর্বর নির্যাতন চালাচ্ছে। সংখ্যাগুরু মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর পাইকারী হারে সন্ত্রাস, জুলুম-নির্যাতন নিয়ে বিশিষ্টজনদের মুখে একটি কথাও বের হচ্ছে না কেন? মানবতাবিরোধী এসব ঘটনার খবর মিডিয়ায় অনীহা কেন? এমন কী অপরাধ করলো এদেশের সংখ্যাগুরু মুসলিম সম্প্রদায়? গরীব মুসলমান পরিবারে জন্ম নেয়াই কী তাদের অপরাধ? নাকি সংখ্যাগুরু মুসলমানদের ওপর সন্ত্রাস, অমানবিক জুলুম-নির্যাতনের চিত্র তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, আইনজীবী, বিদ্যাজীবী, সুশীল, গণতন্ত্র ও মানবতাবাদীদের রাডারে ধরা পড়ছে না?
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার রায়ের ঘটনা এবং রাজধানীর মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশে অবস্থান নেয়া লাখ লাখ আলেম-ওলামাদের আওয়ামী স্বৈর সরকারের নির্দেশে নিরাপত্তা বাহিনী বৈদ্যুতিক বাতি নিভিয়ে দিয়ে রাতের আঁধারে বন্দুকের নলের মুখে উঠিয়ে দেয়ার পর সারাদেশে তল্লাশীর নামে মাদরাসা পড়–য়া হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর বর্বর জুলুম-নির্যাতন করা হয়। অনেক জেলা, উপজেলা, গ্রামগঞ্জ, পাড়া-মহল্লায় আলেম-ওলামা, মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, হাফেজ-ক্বারী, মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের ঘরছাড়া করা হয়। মাসের পর মাস তারা ঘর-বাড়ীতে ফিরতে পারেননি। এমনকি স্থানীয় পর্যায়ের আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠন যুবলীগ, ছাত্রলীগকে নগদ অর্থ দিয়ে মুচলেকা দিয়ে বাড়ী-ঘরে ও কর্মস্থলে ফিরতে হয়েছে দেশের অনেক মসজিদে আজান দেয়ার মতো লোক ছিল না। আর আজান দেয়ার লোক থাকলেও জুমার নামাজ পড়ার মুসল্লী ছিল না অনেক এলাকায়। এসব নিকট অতীতের ঘটনা। চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে প্রার্থীবিহীন ভোটারবিহীন একদলীয় আওয়ামী প্রহসনের নির্বাচনের আগে-পরে কয়েকটি জেলায় প্রান্তিক সুবিধাবঞ্চিত হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ী-ঘরে আগুন দেয়া হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার নামে যৌথবাহিনী গঠন করে সারাদেশে আওয়ামী লীগ বিরোধী মত ও পথের গণতন্ত্রকামী জনগণের ওপর জুলুম -নির্যাতন চালিয়ে মিথ্যা ভিত্তিহীন শত শত সাজানো মামলা দিয়ে হাজার হাজার আসামী আসামী করা হলেও সরকার এই সংখ্যালঘুদের সার্বিক নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হলো কেন? সারাদেশে গণআন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলো নাকি সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করেছে, আর সেসব ঘটনার সাথে সুপরিকল্পিতভাবে জামায়াত-শিবির ও বিএনপির নাম উল্লেখ করে আওয়ামীপন্থী মিডিয়ায় খবর প্রচার করেছে। আওয়ামী প্রশাসন ও নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করার  জন্য বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের নাম প্রচার করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। অথচ নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা দেয়ার সাংবিধানিক দায়িত্ব সরকারের। সরকার সেই দায়িত্ব পালন করেনি। আর যেসব এলাকায় সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর ছাত্রলীগ-যুবলীগ-আওয়ামী লীগের কর্মী-ক্যাডার সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করেছে, জ্বালাও পোড়াও, ভাংচুর-লুটপাট করেছে, সেসব ঘটনায় প্রচার করা হয় দুর্বৃত্তরা আক্রমণ করেছে। সরকারী দলের নেতা-কর্মী-ক্যাডার নামধারী সন্ত্রাসীদের হাতে সংখ্যালঘু হিন্দুরা আক্রান্ত হলে কৌশলে বলা হয় এরা দুর্বৃত্ত। দুর্বৃত্তদের কোনো দল নেই। অথচ অন্যদের বেলায় তাদের নাম ঠিকানা তুলে ধরা হয়। সরকারের এ কৌশল হচ্ছে সংখ্যালঘুদের বেলায়। আর সংখ্যাগুরু মুসলমানদের ওপর আক্রমনের খবর চাপিয়ে যাওয়া হয়। রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, বগুড়া, নওগাঁ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, যশোর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরিশাল, সিলেট, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ প্রায় অর্ধশত জেলায় হাজার হাজার মুসলিম পরিবারের বাড়িঘরে আক্রমণ হয়েছে। অনেকের বাসা-বাড়ী, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর, লুটপাট, আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে ছাত্রলীগ-যুবলীগ-আওয়ামী লীগের কর্মী-ক্যাডার নামের সন্ত্রাসীরা। হাজার হাজার আক্রান্ত মুসলিম পরিবারগুলোর লাখ লাখ সদস্য মানবেতর জীবনযাপন করছে প্রচ- শীতে। অনেকে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের নির্যাতনের ভয়ে, আবার অনেকে র‌্যাব-পুলিশের নির্যাতন ও গণগ্রেফতারের ভয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন। অনেক গ্রাম, পাড়া-মহল্লা পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। সারা দেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমানোর নামে তারপরও পুলিশ-র‌্যাবের গ্রেফতার, জুলুম-নির্যাতন কমেনি। দেশের প্রায় সর্বত্রই পুলিশ আসামী ধরার নামে গ্রেফতার বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। চরম দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছে দেশের জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক ধারা ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। সংখ্যাগুরু এই মুসলমানদের ওপর আওয়ামী সন্ত্রাসী ও র‌্যাব-পুলিশের এসব মানবতাবিরোধী ক্ষমাহীন অপরাধমূলক ঘটনাগুলোর সম্পর্কে আওয়ামী দলদাশ মিডিয়াগুলোতে একটি রিপোর্টও প্রচার করা হচ্ছে না। সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয় দেশব্যাপী সংখ্যাগুরু মুসলমানদের ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র। সুবিধাভোগীরা নয়, সুবিধাবঞ্চিত সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে আওয়ামী আমলে। আবার তথাকথিত প্রগতিশীল এবং সুবিধাভোগী চাটুকাররা নিরাপদে থাকলেও রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ বিরোধী হিসেবে পরিচিত এবং সুবিধাবঞ্চিত সাধারণ সংখ্যাগুরুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সংখ্যালঘুদের নির্যাতন আওয়ামী দলদাশ মিডিয়াগুলোতে ফলাও করে প্রচার এবং তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল, বুদ্ধিজীবী, বিদ্যাজীবী, সুশীলরা সেটাকে ‘মানবতা গেল’, ‘মানবতা গেল’ বলে প্রতিদিন টেলিভিশনের টকশোতে চিৎকার করছেন। কিন্তু সংখ্যাগুরু মুসলমানদের ওপর আওয়ামী নির্যাতনের চিত্র নিয়ে কোনো শব্দ করছেন না। তারা কী আসলেই জানেন না দেশের জাতীয়তাবাদী গণতন্ত্রকামী এবং ইসলামী আদর্শবাদী সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন? রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে প্রশাসনকে ব্যবহার করে রাজধানী থেকে শুরু করে সারা দেশে তাদের ওপর কী আওয়ামী ফ্যাসিবাদী অমানবিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে না?
গত ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের আগেই ১৫৩ জন আওয়ামী প্রার্থীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত ঘোষণা করেছেন নির্বাচন কমিশন। বাকি ১৪৭টি সংসদীয় আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঐসব সংসদীয় আসনে নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ আদৌ কী ছিল? প্রধান নির্বাচন কমিশনার দাবি করেছেন নির্বাচনের পরিবেশ রয়েছে। কিন্তু তিনি কী খোঁজ নিয়ে দেখেছেন ঐ ১৪৭টি নির্বাচনী এলাকার হাজার হাজার গ্রাম এখন পুরুষশূন্য। পুলিশ-র‌্যাবের গণগ্রেফতারের ভয়ে আর ছাত্রলীগ, যুবলীগ-আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের আক্রমণের ভয়ে তারা এলাকা ছাড়া। ঘর-বাড়ি ছেড়ে অনেকেই আশপাশের উপজেলা ও জেলায় আত্মীয়-স্বজনের বাসা-বাড়িতে গিয়ে মাসের পর মাস থাকছেন। গ্রামবাংলার ঐসব এলাকায় জুমাবার মসজিদের নামায পড়ার মুসল্লীর সংখ্যা কমে গেছে। সিইসি এসবের খোঁজ-খবর না নিয়েই নির্বাচন সম্পন্ন করেছেন। কথায় কথায় অপহরণ, হত্যা, গুম, খুন, মিথ্যা মামলা, যৌথ বাহিনীর ভয়াবহ বর্বর অভিযান, গণগ্রেফতার, জুলুম-নির্যাতনের ভয়ে সারা দেশের ঘর-বাড়ি ছাড়া সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়ের ভোটারদের কী ভোট দেয়ার অধিকার নেই? বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম এবং প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের গ্রাম-গঞ্জে বসবাসরত দুর্বল নাগরিকরা জুলুম-নির্যাতনের শিকার হন। তবে সংখ্যালঘু নির্যাতনের সচিত্র খবর মিডিয়ায় ফলাও করে প্রকাশ পায় বেশি। দিনে এনে দিনে খাওয়া সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর কেন এসব অপরাধ সংঘটিত হয়, তা নিয়ে তক-বিতর্কের শেষ নেই। ক্ষমতাসীন দলের ব্যর্থতাকে আড়াল করার জন্য বিরোধী রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করেন। দেশী-বিদেশী এনজিওগুলো এসব নির্যাতনকে পুঁজি করে নতুন প্রকল্প খোলে, ব্যবসা করে প্রসার বাড়ান। মানবাধিকার সংস্থাগুলোরও ঐ একই অবস্থা। নাগরিক সমাজ বুদ্ধিবৃত্তিক তর্কে মেতে উঠেন। এদের কেউ সরকারকে খুশি করেন আবার কেউ নিজেকে গণমানুষের একজন প্রমাণে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনকারীদের খিস্তিখেউর করেন। রাজধানীর এসিরুমে বসে তারা যে সুবিধাবাঞ্চিত প্রান্তিক মানুষগুলোর জন্য সদা সর্বদাই উদগ্রীব তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে অনেকেই ভিক্ষুককে কোনদিন ভিক্ষা দেন না, অথচ সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে টিভির পর্দা ফাটাচ্ছেন কেউ কেউ। সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে সমাজতাত্ত্বিকেরা গবেষণায় নতুন বিষয় পেয়ে যান। কিন্তু ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুরা যে প্রতিবার নির্যাতন ও নৃশংসতার শিকার হয়, তা থেকে তাদের উদ্ধার করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করছেন না কেউ। আওয়ামী সরকার যে সুপরিকল্পিতভাবেই সংখ্যালঘু নির্যাতনকে কার্ড হিসেবে ব্যবহার করছে সেই বাস্তব কথাটা কেউ বলছেন না কেন? রাষ্ট্র সন্ত্রাসীদের লালন করে সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণ, জলুম নির্যতান করতে সহায়তা দিচ্ছে সেটা তাদের বিবেককে দংশন করছে না কেন?
সমাজে প্রচার রয়েছে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কারণ ভোট ও জমি। জমি দখলের প্রক্রিয়া সব আমলেই হয়ে থাকে। সেখানে যার জোর আছে, সেখানেই সে দুর্বলের বাড়ি-ঘর, জমাজমি দখল করে নেয়। কিন্তু সম্প্রতি সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের মূল কারণ ভোট এবং রাজনীতি। দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ে বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা নাকি হিন্দু ও আদিবাসী পাড়ায় আক্রমণ করেছে। আর যশোর, পাবনায় আক্রমণ করেছে ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ। দিনাজপুর ও ঠাকুগাঁওয়ের ঘটনাকে বিএনপি-জামায়াত -শিবির ঘটিয়েছে বলে মিডিয়ায় প্রচার করা হয়। আর যশোর ও পাবনায় হিংসাত্মক ঘটনা ছাত্রলীগ-যুবলীগ-আওয়ামী লীগের নাম গোপন রেখে ‘দুর্বৃৃত্তরা’ ঘটিয়েছে বলে মিডিয়ায় প্রচার করা হয়। ছাত্রলীগ-যুবলীগ-আওয়ামী লীগ কী সরকারের আজ্ঞাবহ মিডিয়াগুলোর ভাসুর? তাদের নাম-পরিচয় প্রচার করতে এবং মুখে আনতে ভয় কিসের? আওয়ামী লীগের নেতা জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ আব্দুল ওয়াহাবের লোকজন যশোরে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংস হামলা চালিয়েছে। আর পাবনায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সামসুল হক টুকুর লোকজন সাঁথিয়ায় হিন্দুদের প্রায় ৪০টি বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আক্রমণ করেছে। আওয়ামী লীগের নেতা সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাঈদ ও মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান তথ্য-প্রমাণসহ এসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটনার তথ্য দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেছেন। শুধু তাই নয়, দেশের বিভিন্ন জেলায় সংখ্যালঘু নির্যাতনের অবস্থা জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জরুরি চিঠি পাঠিয়েছেন বিভিন্ন জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)। এসব চিঠি পেয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো হয়েছে হতবাক। সাতক্ষীরা, যশোর, বাগেরহাট, পাবনা, দিনাজপুরসহ অন্যান্য জেলার ডিসিরা চিঠিতে সংখ্যালঘু নির্যাতনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের পরোক্ষভাবে দায়ী করে।
 দেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে আওয়ামী লীগের রিজার্ভ ভোট ব্যাংক হিসেবে ধরা হয়। (যদিও এখন আগের সে অবস্থা নেই। অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তি অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত)। সে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা এবং তাদের হারানো (সম্পত্তি) অধিকার ফিরিয়ে দেয়া কী আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নয়? সমাজে প্রচার রয়েছে সংখ্যালঘু হিন্দুরা থাকলেও আওয়ামী লীগের লাভ, চলে গেলেও লাভ। থাকলে নৌকায় ভোট পড়ে, আর চলে গেলে জমি পাওয়া যায়। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর ১৯৬৬ সালে বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) থেকে চলে যাওয়া হিন্দুদের সম্পত্তি নিয়ে ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ করে পাকিস্তান সরকার। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে শত্রু সম্পত্তি আইনের নাম পরিবর্তন করে ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’ করে তৎকালীন আওয়ামী সরকার। নাম পরিবর্তন করা হলেও অর্পিত সম্পত্তি আইনের অন্তর্গত সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তির আজো কোনো সুরাহাই করেনি আওয়ামী লীগ সরকার। এ সময়ের মধ্যে দুই দফায় (১৯৯৬-২০০১, ২০০৯-’১৩) আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু নৌকার ভোটব্যাংক খ্যাত সংখ্যালঘু হিন্দুদের ‘অর্পিত সম্পত্তি’ সহজভাবে তাদের ফিরিয়ে দেয়ার কোনো ব্যবস্থাই করেনি। মাঝে মাঝে জাতীয় সংসদে এ আইনে শব্দের পরিবর্তন করা হয়, ধারা, উপধারার সৃষ্টি করা হয়। ঐ পর্যন্তই। প্রশ্ন হলো, কেন সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করছে না সংখ্যালঘু হিন্দুপ্রেমী আওয়ামী লীগ সরকার? এর জবাব অতি সোজা। অধিকাংশ তথা শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ অর্পিত সম্পত্তিই আওয়ামী লীগের নেতাদের দখলে। তাই অর্পিত সম্পত্তি আইন নিয়ে তালবাহানাই চলছে বছরের পর বছর থেকে। হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আওয়ামী লীগ সরকারের এটাই কী চরম নির্যাতন নয়? এক্ষেত্রে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের নির্যাতনের কোনো যুক্তি আছে কী?
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান পাবনা, বগুড়া, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, যশোরসহ বেশ কয়েকটি জেলা সফর করে ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলেছেন। সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট মানববন্ধন করেছে। সারা দেশে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫টি জেলায় সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের প্রতিবাদে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। সবাই প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানিয়েছেন। বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা এডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেছেন, এখন যেমন বলা হচ্ছে জামায়াত-শিবির সংখ্যালঘু নির্যাতন করেছে। এটা একটা স্লোগান হয়ে গেছে। বাস্তবে অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের লোকজনরাই জড়িত রয়েছে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, যদি জামায়াত-শিবিরই হামলা করে থাকে তবে সরকার কেন তাদের বিচার করছে না? নবম জাতীয় সংসদের হুইপ আবদুল ওয়াহাব যশোরের এবং সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু পাবনার সাঁথিয়ায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা অস্বীকার করেননি। অথচ সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বিবিসি সংলাপে দাবি করেছেন ঐ সব ঘটনার সাথে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জড়িত নয়। তিনি হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা সুব্রত চৌধুরীর অভিযোগকে মিথ্যা বলে দাবি করেন। মূলত আধিপত্যবাদী অপশক্তির মদদে সুপরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর মানবতাবিরোধী সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে জঙ্গীবাদী আওয়ামী সরকার। ৫ জানুয়ারির প্রার্থীবিহীন, ভোটারবিহীন প্রহসনের নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক এড়ানো এবং মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে আওয়ামী সন্ত্রাসী অপশক্তি নিজেরাই সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে পরিকল্পিতভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত-ছাত্রশিবিরের ওপর দোষ চাপানোর ব্যর্থ চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। সংখ্যালঘুর ওপর আক্রমণের চিত্র মিডিয়ায় একতরফাভাবে প্রচার করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে গণতান্ত্রিক গণআন্দোলনরত বিএনপি-জামায়াতসহ ১৮ দলীয় জোটকে ঘায়েল এবং আওয়ামী স্বৈরাচারদের পক্ষে বিশ্ব জনমতকে টেনে আনার নানা ফন্দিফিকির করা হচ্ছে। গণতন্ত্রের নামে অগণতান্ত্রিক, একনায়ক, গণবিচ্ছিন্ন, বিরোধী দলবিহীন, প্রার্থীবিহীন ও ভোটারবিহীন প্রহসনের নির্বাচনে গায়েবী ভোটের মাধ্যমে আবারো ক্ষমতায় আসা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন স্বৈরসরকার এ কূটকৌশল গ্রহণ করতেই পারে। কিন্তু দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হিন্দুদের মতো সংখ্যাগুরু মুসলমানদের ওপর প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে যে আওয়ামী জুলুম-নির্যাতন, অপহরণ, খুন, গুম, গুপ্ত হত্যা, হামলা, গায়েবী মামলা, যৌথ বাহিনীর নামে অভিযান, গণগ্রেফতার, রিমান্ডে পুলিশী নির্যাতন, গ্রেফতার বাণিজ্য ও হয়রানি চলছে সেটাও দেশবাসী ও বিশ্বসম্প্রদায়ের সামনে তুলে ধরা উচিত। প্লট, ফ্ল্যাট পাওয়া দলকানা সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রো-ভিসি, মিডিয়ার মালিক, রাষ্ট্রদূত, ব্যাংক-বীমার চেয়ারম্যান, পরিচালক, অধিদফতর, পরিদফতরের চেয়ারম্যান, পরিচালক হওয়া সরকারের আজ্ঞাবহ একচোখা বুদ্ধিজীবী ও তথাকথিত গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবাদীদের দৃষ্টি সংখ্যাগুরু মুসলমানদের নির্যাতন চিত্র এড়িয়ে যাবে স্বাভাবিক। কিন্তু দল নিরপেক্ষ লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, সুশীল, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবাদীদের চোখ তো এসব ঘটনা এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। তাদের উচিত সংখ্যালঘু হিন্দুদের নির্যাতনের চিত্রও তুলে ধরার পাশাপাশি সংখ্যাগুরু মুসলমানদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা। কারণ, সুবিধাবঞ্চিত সংখ্যাগুরু মুসলমানরাও আজ সংখ্যালঘুদের চেয়েও অনেক অনেক বেশি নির্যাতিত ও অসহায়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads