রবিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১৪

‘ট্র্যাজিকমিক’ নির্বাচন এবং হার্ডলাইনের সরকার


৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে একটি অনাকাক্সিত ও অভাবনীয় নির্বাচন হয়ে গেল। ভোটারবিহীন, প্রার্থীবিহীন ও দেশের ৪০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৮টি দলের বর্জনের মুখে আওয়ামী লীগ নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে এই নির্বাচন সম্পন্ন করল। এবং গতকাল এ নির্বাচন সূত্রে ১৫৩ জন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত এমপিসহ বাকিদের মধ্যে পাতানো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাস হওয়া এমপিদের নিয়ে একটি সরকারও এরই মধ্যে আমরা পেয়ে গেছি। এটি আমাদের দশম জাতীয় সংসদ।

এই নির্বাচনকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ চিহ্নিত করেছে সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষার নির্বাচন। বিরোধী দল বলছে, এটি কোনো ইলেকশন নয়, সিলেকশন। ভাগভাটোয়ারার নির্বাচন। এর মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের মৃত্যু হয়েছে। এর বাইরে নানাজনের নানা মন্তব্য। কেউ বলছেন এটি একটি প্রহসনের নির্বাচন। এই নির্বাচনে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আশা-আকাক্সার কোনো প্রতিফলন নেই। এই নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় দেশের মোট ভোটারের ৫২ শতাংশই তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বাকি ১৪৭ আসনেও নির্বাচন সম্পন্ন হলো ভোটারবিহীনভাবেই। সরকারি দলের দাবি, এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তাদের বিজয় হয়েছে আর বিএনপির পরাজয় ঘটেছে। কেউ বলেছে, এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতেছে, হেরেছে বাংলাদেশ। ভারতীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য হিন্দুর মন্তব্য : বাংলাদেশে কেউই বিজয়ী হয়নি।অপর দিকে ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পাদকীয় প্রকাশ করে বলেছে, বাংলাদেশের নতুন সরকার অবৈধ। গত শুক্রবার পত্রিকাটির সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছেÑ ‘বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকার বিষয়েও নয়াদিল্লির একটি স্পষ্ট অবস্থান থাকা দরকার। মূল বিরোধী দলের বয়কটে এবার বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিতভাবেই একপক্ষীয় হয়েছে। মাত্র ২২ শতাংশ ভোট পড়েছে, ক্ষমতাসীন সরকারই কার্যত বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় আবার ক্ষমতার হাল ধরেছে। স্বভাবতই গণতন্ত্রের মাপকাঠিতে নতুন সরকারের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ কিংবা সরাসরি অবৈধ।

এ নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। ব্যাপক সহিংসতার মধ্য দিয়ে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন কমিশন তা স্বীকার করেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় সহিংসতা ঠেকানো যায়নি। এ দিকে ভোটগ্রহণের দিন সারা দেশের মোটামুটি বেশির ভাগ কেন্দ্রগুলো ভোটারশূন্য দেখা গেলেও ভোটের দুই দিন পর নির্বাচন কমিশন জানাল, এ নির্বাচনে ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে। এ নিয়ে আছে নানা বিতর্ক। এ দিকে বেসরকারি সংস্থা ব্রতিবলেছে, তাদের পর্যবেক্ষণ মতে ঢাকা শহরে ২৬ শতাংশ ও অন্য পর্যবেক্ষণকেন্দ্রগুলোতে গড়ে ৩৭ শতাংশ ভোট পড়েছে। আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২২ শতাংশ ভোট পড়েছে। টেলিভিশন চ্যানেলে অংশ নেয়া বিভিন্ন আলোচককে বলতে শোনা গেছে, ভোট পড়ার হার ১০-২০ শতাংশ। এর চেয়ে বেশি নয়।

দেশের বিভিন্ন মহলের কথা বাদ দিলেও আন্তর্জাতিক মহলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে। সমালোচনার পাশাপাশি দ্রুত সরকারকে তাগিদ দিয়েছে, বিএনপির সাথে সংলাপে বসে দ্রুত সব দলের অংশগ্রহণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য। বেশির ভাগ দেশ নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার সমালোচনা করে দ্রুত সব দলের মধ্যে সমঝোতা গড়ে তুলে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে বলেছে। গত শুক্রবার অনলাইনে ও এর পরদিন এর মুদ্রণ সংস্করণে প্রকাশ করাÑ ‘বাংলাদেশস ইলেকশন: অ্যানাদার বিটিং, শেখ হাসিনা প্ল্যানস টু হ্যাঙ অন টু অফিস আফটার অ্যান ইলেকশন ফার্সশীর্ষক প্রতিবেদনে দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকা মন্তব্য করেÑ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চান। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের রাজনীতি পচে গেছে। আমেরিকা, ব্রিটিশসহ কোনো দেশ এ নির্বাচনকে স্বীকৃতি দেয়নি। ইকোনমিস্ট জানায়, গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক দিন আগে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচন বয়কটের ভুলকরায় বিরোধী দলকে তিরস্কার করেন। এরপর তিনি তার নির্বাচনী বৈধতা সৃষ্ট সংশয় উড়িয়ে দেন। ইকোনমিস্ট বলে, যেকোনোভাবেই বিবেচনা করা হোক না কেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র পচে গেছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারকে আরেক মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার ম্যান্ডেট দেয় না। এতে বলা হয়, অনেক ভোটকেন্দ্রে ভোটার বলতেই ছিল না। এর পরও দিনের শেষভাগে সন্দেহজনকভাবে বিপুল ভোট পড়তে দেখা যায়। এ ছাড়াও এ প্রতিবেদনে ইকোনমিস্ট আরো এমন অনেক মন্তব্যই করেছে, যা শেখ হাসিনা ও ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকেই কার্যত প্রশ্নবিদ্ধ করে।

এ দিকে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি) বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে একটি ট্র্যাজিকমিকইলেকশন বলে মন্তব্য করেছে এবং বলেছে, আর এই ট্র্যাজিকমিক যৌথভাবে মঞ্চস্থ করেছে বাংলাদেশ সরকার ও নির্বাচন কমিশন। এএইচআরসি বলেছে, এখন দেখার অপেক্ষায় এই জালিয়াতির নির্বাচন বাংলাদেশকে কতটুকু ডুবায়। গত বুধবার হংকং-ভিত্তিক এই মানবাধিকার পর্যবেক্ষক সংগঠন এক বিবৃতিতে আরো বলে, এই সাধারণ নির্বাচন এর প্রতিশ্রুত সহিংসতা, কারচুপি ও প্রহসন পুরোপুরি পূর্ণ করেছে। এখন দেখার সময় বাংলাদেশ কতটুকু ডুবে। সার্বিকভাবে ভোটার টার্নআউট ছিল খুবই কম। অনেক ভোটকেন্দ্রে অর্ধেক দিন কোনো ভোটই পড়েনি। ৪০টির মতো ভোটকেন্দ্র ছিল ভোটশূন্য। এসব কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। সুনিশ্চিত ভোট পড়ার কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিবৃতিতে বলা হয়, যেমনটি ধরেই নেয়া হয়েছিল সরকার ভোট জালিয়াতির জন্য রাজনৈতিক ক্যাডার নামায়।

অপর দিকে নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বলেছে, আওয়ামী লীগ নিজেকে দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক দল দাবি করলেও যেভাবে সমালোচকদের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে তাতে গণতন্ত্রের কিছুই নেই। সংস্থাটি বাংলাদেশে গণগ্রেফতার ও ভিন্নমত দমন বন্ধ করে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকারকে বিরোধী দলের নেতাকর্মী ও অন্যদের নির্বিচারে গ্রেফতার দ্রুত বন্ধ করতে হবে। ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হওয়ার পর থেকে নতুন করে এই গণগ্রেফতার শুরু হয়েছে।

৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জন করায় ১৮ দলীয় নেতাকর্মীদের নির্বাচনের আগ থেকেই ডজন ডজন, সম্ভবত শত শত বিরোধী নেতা গ্রেফতার হবেন বলে এই সংস্থাটি দাবি করেছে। এ দিকে কুয়েত নিউজ এজেন্সি (কুনা) ব্রাসেলস থেকে গত বুধবার জানায়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিনিধি ও সদস্যরাষ্ট্রগুলোর দূতাবাসের মাধ্যমে বাংলাদেশ পরিস্থিতির ওপর নিবিড় নজর রাখছে। সেই সাথে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে সহিংসতা বন্ধ করার আহ্বান জানায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র বিষয়ক মুখপাত্র মিশেল মনকে উদ্ধৃত করে এ প্রতিবেদনে বলা হয়, আমরা আমাদের ডেলিগেশন ও ঢাকায় সদস্যরাষ্ট্রগুলোর দূতাবাসের মাধ্যমে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছি। বিরোধী দলগুলো এ নির্বাচন বর্জন করেছে। নির্বাচনে খুব কম ভোট পড়েছে। উল্লেখ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২৮টি দেশের একটি শক্তিশালী ব্লক।

এই নির্বাচনকে ঘিরে নির্বাচনের আগে থেকেই বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর কার্যত নির্বিচারে গ্রেফতার, আটক ও মামলা-হামলা শুরু হয়। নির্বাচন-উত্তর সময়ে তা আরো বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সরকারের একজন মন্ত্রী বলেছেন, প্রয়োজনে বিএনপির সব নেতাকে কারাগারে পাঠানো হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৮ দলীয় জোটের নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে বলেছেন, বিরোধী দল দমনে যত দরকার তত কঠোর হবেন। এতে ধারণা করা হচ্ছে, গতকালের সরকার গঠনের পর এই তৎপরতা সরকার আরো জোরালো করে তুলবে। এরই মধ্যে কারাগার পরিপূর্ণ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দিয়ে।

গত শনিবার দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন কারাগারে ঠাঁই নেইশীর্ষক শীর্ষ সংবাদে এ নিয়ে মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। এ প্রতিবেদনে বলা হয়Ñ ‘ঠাঁই নেই দেশের কারাগারগুলোতে। রাজনৈতিক ধরপাকড় আর গণগ্রেফতারের কারণে বন্দীতে ঠাসা দেশের কারাগারগুলো। নিত্যনতুন বন্দীদের ভারে রীতিমতো উপচে পড়ছে দেশের ৬৮টি কারাগার। ধারণক্ষমতা ২৯ হাজার হলেও বর্তমানে সেখানে রয়েছে ৭০ হাজারেরও বেশি বন্দী। আড়াই গুণের বেশি বন্দী সামাল দিতে বেসামাল হয়ে পড়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। একই সাথে দেখা দিয়েছে নানা সমস্যা। তীব্র শীতে কারা অভ্যন্তরে বন্দীদের দুর্দশা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ঠাণ্ডাজনিত রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে। চিকিৎসাও মিলছে না যথাযথ। মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে কারাগারের ভেতরে। সূত্র মতে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ধারণক্ষমতা দুই হাজার ৬৮২ থাকলেও গত শুক্রবারে সেখানে ছিলেন সাত হাজার ৪৮২ জন বন্দী। এদের বেশির ভাগই বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী। তারপর প্রতিদিন ১০০ থেকে ২০০ বন্দী কারাগারে আসছেন।

এবার সরকার জোর প্রচার চালাচ্ছে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা নির্বাচনপরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে লুটপাট করছে। এ অভিযোগে এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে ১৮ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের নির্বিচার গ্রেফতার। বিরোধী দলের অভিযোগ, সরকারি দলের লোকজন এ ধরনের হামলা চালিয়ে এর দায়ভার চাপাচ্ছে ১৮ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের ওপর। তাদের এই অভিযোগ যে বায়বীয় নয়, সে প্রমাণও অনেক ক্ষেত্রে পাওয়া যাচ্ছে। যে কারণে বিবিসির সংলাপে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা আসাদুজ্জামান নূরও বলেছেন, ‘আমি এ অভিযোগ স্বীকার করি।

এ দিকে সরকার ও সরকারের বশংবদ কিছু পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল সংখ্যালঘু নির্যাতনের যাবতীয় দায়ভার ১৮ দলীয় জোটের ওপর চাপানোর গোয়েবলসীয় প্রচারে লিপ্ত তখন দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন কার্যত তাদের মুখে চুনকালি লেপে দেয়।

গত ১০ জানুয়ারি দৈনিক মানবজমিন সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রশ্নে ডিসিদের চিঠি পেয়ে হতবাক সরকারশীর্ষক একটি শীর্ষ সংবাদ প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়Ñ দেশের বিভিন্ন জেলার সংখ্যালঘু নির্যাতনের অবস্থা জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠাচ্ছেন বিভিন্ন জেলা প্রশাসক (ডিসি)। এসব চিঠি পেয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো রীতিমতো হতবাক। ওইসব চিঠিতে সংখ্যালঘু নির্যাতনে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের পরোক্ষভাবে দায়ী করা হয়েছে।

অপর দিকে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্যপরিষদ নেতারাও বলছেন, জামায়াত-শিবির নয়, আওয়ামী লীগই সংখ্যালঘু হামলায় জড়িত। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনায় এ পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা সুব্রত চৌধুরী বলেছেন, সংখ্যালঘু নির্যাতনে জামায়াত-শিবির জড়িত, এটি একটি স্লোগানে পরিণত হয়েছে। বাস্তবে এমনটি নয়, বরং আওয়ামী লীগই এর সাথে জড়িত। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের শতাধিক বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলার ঘটনার পর তিনি বিবিসিকে এ কথা বলেন। সমালোচকেরা বলছেনÑ আওয়ামী লীগের হাতে তিনটি ট্রাম্পকার্ড আছেÑ যুদ্ধাপরাধী, ধর্মীয় জঙ্গিবাদ ও সংখ্যালঘু। ক্ষমতায় টিকে থাকতে যখন যেটি প্রয়োজন দলটি তা ব্যবহার করে। আর বর্ম হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তো আছেই। সব অন্যায় জায়েজ হয়ে যায় এই তাবিজের উসিলায়। আর সংখ্যালঘু নিয়ে আওয়ামী নেতাদের অন্তর্নিহিত নীতি হচ্ছে, হিন্দুরা দেশে থাকলে তাদের ভোট আমার, আর চলে গেলে তাদের জমি আমার; কিন্তু সময়ের সাথে এসব টাম্পকার্ড মনে হয় আওয়ামী লীগের জন্য বুমেরাং হয়ে উঠছে।

এ দিকে বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সংলাপ ও রাজনৈতিক সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চকক্ষ সিনেট। গত ৭ জানুয়ারি ১১৩তম কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ৮ জানুয়ারি এর বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়। সিনেটে পাস হওয়া এ প্রস্তাবে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়Ñ রাজনৈতিক নেতাদের সরাসরি ও সত্যিকার অর্থে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংলাপে বসতে হবে। চলমান সহিংসতা বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়াসহ শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। লাগাতার রাজনৈতিক অচলাবস্থা উদ্বেগজনক। কারণ, তা বাংলাদেশের অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাধা সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক মতবিরোধ দূর করতে আলোচনা এগিয়ে নিতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত ও মানবাধিকার কর্মীদের হেনস্তা বন্ধসহ গ্রামীণ ব্যাংকের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে হবে। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র সর্বশেষ দুই নেত্রীর কাছে চিঠি দিয়ে দ্রুত অবাধ নির্বাচনের জন্য তাগিদ দিয়েছে।

নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে গতকাল যে সরকার গঠন হলো, এর গঠনপ্রক্রিয়া নিয়েও আছে নানা সাংবিধানিক বিতর্ক। কেউ বলছেন, এখানেও সুস্পষ্টভাবে সংবিধান লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। পুরনো ও নতুন এমপি মিলিয়ে দেশে ৬৩৮ এমপি হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এক আসনে দুই এমপিও আমাদের দেখার সুযোগ হলো। তবে এ নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে একটি জটিলতার উদাহরণও খবরের কাগজে দেখা গেল। নবীগঞ্জে এক আসনে দুই এমপি মুখোমুখি অবস্থান নেয়ার ফলে একটি রাস্তা আর উদ্বোধন হলো না। সে যা-ই হোক, নির্বাচনপরবর্তী সময়েও রাজনৈতিক সঙ্কট কাটানোর কোনো আলামত নেই। সরকার ঘোষণা দিয়েই বিরোধী দলের নেতাকর্মী দমনে নেমেছে। দেশের ভেতরে-বাইরে এর প্রবল সমালোচনা থাকলেও সরকার এসব কিছুই আমলে নিচ্ছে না। সরকার এ সঙ্কট সমাধানে কোনো উদ্যোগ না নিয়ে দমনপীড়ন চালিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেছে বলেই মনে হয়। অন্যরা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে অসুষ্ঠু ও অগ্রহণযোগ্য প্রভৃতি যা-ই বলুক না কেন তাতে সরকারের কিছু যায়-আসে না। সরকারের চোখে এটি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। এ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের দেশ শাসনের ম্যান্ডেট দিয়েছে। অতএব কোনো ভয় নেই; কিন্তু সরকারের উচিত জনগণের মন পাঠ করা। জনগণ কী বলছে তা উপলব্ধি করা এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া। নইলে সামনে সমূহ বিপদ সরকারের নিজের জন্য, গোটা জাতির জন্য। কারণ যে ট্র্যাজিকমিক নির্বাচন হলো, সে সূত্রে যে জগাখিচুড়ির সরকার গঠিত হলো তা দিয়ে আর যা-ই হোক জনপ্রত্যাশা পূরণ হবে না; বরং আওয়ামী লীগের কলঙ্ক তিলক আরো বড় আকার নেবে। 


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads