মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারী, ২০১৪

নতুন সংকটের দিকে যাত্রা শুরু

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 
হাঃ! হাঃ! হাঃ! গত ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো আজব এক ‘জাতীয় নির্বাচন।’ বাংলাদেশে তো নয়ই স্মরণকালের বিশ্বের কোথাও এ ধরনের প্রহসনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। তাছাড়া একটি নির্বাচন কমিশন যে এতোবড় বেহায়া হতে পারে তারও উদাহরণ আধুনিক পৃথিবীর কোথাও পাওয়া যাবে না। এ নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে বিকেল চারটা পর্যন্ত মাছি মেরেছেন নির্বাহী কর্মকর্তারা। চারটার পর কোনো কোনো কেন্দ্রে বাক্স ভর্তি ব্যালট পেপার পাওয়া গেলো। শুধু তাই নয়, শিশুরাও এই নির্বাচনে লাফালাফি করে ভোট দিয়েছে। বিরোধী দল একদলীয় একতরফা নির্বাচন প্রতিরোধের জন্য এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের জন্য দীর্ঘকাল ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলো। শেষমেশ গত মাসাধিককাল ধরে তারা দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচির ডাক দেয়।
তার আগে বিভিন্ন জনমত জরিপে দেখা গেছে যে, দেশে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন চায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নির্বাচন কমিশন এসব জনমতের কোনো তোয়াক্কাই করেননি। কমিশন নেচেছে প্রধানমন্ত্রী যেভাবে তাদের নাচিয়েছেন। উঠতে বললে উঠেছেন। বসতে বললে বসেছেন। কিন্তু কখনও এসব করতে গিয়ে তারা লজ্জিত হননি। নির্বাচন কমিশনে কোনো নারী নেই। নইলে হয়তো তারা বলতে পারতেন, লজ্জা নারীর ভূষণ। আমরা পুরুষ মানুষ আমাদের আবার লজ্জা কি!
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে দেশব্যাপী জনমত গড়ে উঠেছিলো। তাই বিরোধী দল যখন অবরোধের ডাক দিলো তখন সাধারণ মানুষ একযোগে রাস্তায় নেমে আসে এবং রাজপথেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের ফয়সালা করতে চায়। পূর্বে উল্লেখিত জনমত জরিপে এও দেখা গেছে যে, সরকারের পক্ষে ২০/২৫ ভাগ ভোটারের বেশি সমর্থন নেই। তখন থেকে ভারতের মদদে সরকার বিরোধী দলকে এই নির্বাচন থেকে দূরে রাখার পরিকল্পনা আটতে থাকে। সরকার যে ফ্যাসিবাদী কায়দায় দেশ পরিচালনা করেছে তাতে তাদের প্রতি জনসমর্থন থাকারও কোনো কারণ নেই। আর তাই বিরোধী দলকে নির্বাচনের বাইরে রাখার ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। সে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর আবির্ভাব। সে সংশোধনীর মাধ্যমে এমন এক গোঁজামিলের ব্যবস্থা করা হয় যাতে দুই এ দুই এ চার মেলেনা। এমন আজব নির্বাচনের কথা কেউ কোনো দিন শুনেছে বলে মনে হয়না। সংবিধান এমনভাবে সংশোধন করা হয় যাতে বর্তমান সংসদ সদস্যরা তাদের স্বúদে বহাল থাকবেন এবং আরেকদল লোক ঐসব আসনে নির্বাচন করবেন। পৃথিবীর সব জায়গায়ই সংসদীয় ব্যবস্থার নিয়ম হলো নির্বাচনের আগে বহাল সংসদ ভেঙে দেয়া। বর্তমান ক্ষেত্রে সেটা করা হয়নি। মন্ত্রীরাও স্বপদে বহাল থেকে সকল রকম সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নির্বাচন করেছেন। ফলে এই নির্বাচনে প্রহসন হতে বাকি থাকেনি।
সরকার যখন এরকম পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলো এবং বিরোধী দলের সঙ্গে এক সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছিলো তখনই এর একটা সুরাহা চাইছিলো আন্তর্জাতিক পরিম-ল। কিন্তু সরকার কারও কথায় কর্ণপাত করেনি। এগিয়ে এসেছিলো জাতিসংঘ। এগিয়ে এসেছিলো যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা, জাপান, জার্মনীর মতো দেশগুলোও। কিন্তু সরকার ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে তাদেরকে কোনো গুরুত্ব দেয়নি। এর পরিণতি সরকারের জন্য কী হতে পারে এবং দেশের মানুষের জন্য কী হতে পারে ক্ষমতা-অন্ধরা তাও ভেবে দেখতে চায়নি। জনগণের কি হলো তাতে কিছুই আসে যায়না। বিশ্বের প্রভাবশালী দেশসমূহ দেনদরবারে যখন ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেলো তখনও ভেবে দেখা উচিত ছিলো যে, এদের সহযোগিতা ছাড়া সামনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব কিনা।
কেউ কেউ এমনও বলছিলেন যে, এরকম ক্ষেত্রে ইউরোপসহ পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এক হঠকারী মন্ত্রী বলে বসলেন যে, সেটা কিছুতেই সম্ভব নয়, ‘ইউরোপীয়রা যদি বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক না নেয় তবে তাদের ন্যাংটা থাকতে হবে।’ কতোটা উন্মত্ত হলে বাংলাদেশের কোনো মানুষ এরকম উক্তি উচ্চারণ করতে পারে।
বাংলাদেশের ভূ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এই যে, এই দেশটিকে নিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় পরাশক্তির স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আছে। সে ক্ষেত্রে নীতি হওয়া দরকার ছিলো সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক। কিন্তু এক ভারতের যুপকাষ্ঠে বাংলাদেশকে বলি দেয়ার জন্য সেসব দিকে মনোযোগ দেয়নি সরকার। সারা পৃথিবী যখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, তখন ভারত বাংলাদেশ সরকারকে হাওয়া দিয়েছে, তাদের শেখ হাসিনাকে আবার সরকারে চায়।
এরকম একটা পরিস্থিতিতে যখন সকল আলাপ-আলোচনা, অনুরোধ-উপরোধ ব্যর্থ করে দিয়ে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে গেলো সরকার। আর শেষ পর্যন্ত তেমন একটা তামাশার নির্বাচন অনুষ্ঠিতও হলো। শতাধিক কেন্দ্রে একটিও ভোট পড়েনি। এমনকি অনেক আওয়ামী লীগাররাও ভোট দেয়নি। বহু কেন্দ্রে ভোট পড়েছে একটি বা দু’টি। আরও মজার ব্যাপার হলো এই যে, ৩০০ আসনের জাতীয় সংসদে ১৫৩টি তে নির্বাচনের আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যায় আওয়ামী লীগ ও তার সাঙ্গাতরা। এবং শেখ হাসিনা প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’কে এই বলে আহ্বান জানিয়েছিলেন যে, তারা যদি সরকারে আসে তবে তাদেরকেও উচ্ছিষ্টের খানিকটা ভাগ দেয়া হবে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে সেরকম প্রস্তাব বিএননপি’র পক্ষে বিবেচনা করারও কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। সংসদ যেনো বানরের পিঠা ভাগের মতো। এর ফলে দেশে প্রায় পাঁচ কোটি ভোটার ভোটাধিকার বঞ্চিত হয়েছে। আমি জানলাম না, ভোট দিলাম না। অথচ আমার প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে গেলো। সে সন্ত্রাসী না ডাকাত না খুনি তা নির্ধারণ করার যে এখতিয়ার সেটা আগেই কেড়ে নেয়া হলো। কেড়ে নেয়া হলো এবার সদ্য যারা ভোটার হয়েছেন তাদের ভোট দেয়ার আনন্দ।
যে ১৪৭টা আসনে প্রহসনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো দিনভর টেলিভিশনে আমরা তার লাইভ প্রচার দেখেছি। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির লোকেরা গোল হয়ে গল্পে মেতে বসেছিলেন। নির্বাচনী কর্মকর্তারা বসে ঘুমাচ্ছিলেন। ভোটারের লাইনের বদলে মাঠে রোদ পোহাচ্ছিলো নেড়ি কুকুর। প্রায় তিনটার সময় এরকম একটি বুথে ঢুকেছিলেন টিভি চ্যানেলের এক সাংবাদিক। ওখানে ভোটার সংখ্যা ছিলো প্রায় ২৩০০। সাংবাদিক পোলিং অফিসারকে জিজ্ঞেস করলেন, ইতোমধ্যে আপনার এখানে কতো ভোট কাস্ট হয়েছে? জবাবে কর্মকর্তা বললেন, দু’টি। পাশের বুথে গেলেন। নির্বাচনী কর্মকর্তা সহাস্যে বললেন, আমাদের এখানে অবস্থা ভালো। সাংবাদিক বললেন, কি রকম? জবাবে কর্মকর্তা বললেন, আমাদের এখানে ১০টি ভোট কাস্ট হয়েছে। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার দু’দিন পর কমিশন বললো, সারাদেশে ভোট কাস্ট হয়েছে ৪০.৫৬ শতাংশ। দিনভর টিভিতে যা দেখা গেছে তাতে সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকরা অনুমান করেছেন যে, এই নির্বাচনে ৫/৮ শতাংশের বেশি ভোট কাস্ট হয়নি। লালমনিরহাট সদরে ৯৩ ভোট কেন্দ্রের মধ্যে ৪২টি কেন্দ্রে একজন ভোটারও ভোট দিতে আসেননি। মানুষের চোখ, টিভি ক্যামেরা এসবকে উপেক্ষা করে কমিশন গায়েবি আওয়াজ দিলো ৪০.৫৬ শতাংশ। আর কমিশন নির্বাচন নিয়ে ‘সন্তোষ’ প্রকাশও করেছে।
এখন বিএনপি’কে উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন যে, জামায়াতের সঙ্গ ছেড়ে আসুন। আলোচনা হবে। আলোচনার জন্য তো বিএনপি সব সময় প্রস্তুতই ছিলো। কখনও তো তারা বলেননি যে, আলোচনা হবে না বা আমরা আলোচনায় বসতে রাজি নই। কিন্তু ততোদিনে জনগণই দেশের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে নেয়। ঢাকার বাইরে সরকারের অস্তিত্বই থাকেনা। দাবি একটাই ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা’ ফেরত দাও। সরকারের পেটোয়া বাহিনী এই নিরস্ত্র জনসাধারণের ওপর নির্বিচার গুলী চালিয়ে প্রায় ৩০০ মানুষকে হত্যা করলো। আহত হলো হাজারে হাজারে। গ্রেফতারও হলো তেমনি। ১৮ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নিজ বাসভবনে গৃহবন্দী করে রাখা হলো। ঐ দলের শীর্ষস্থানীয় সকল নেতাকে কারাবন্দী করা হলো। যারা দুই একজন ছিলেন, তারাও ছিলেন আত্মগোপনে। কিন্তু মানুষ শেষ পর্যন্তও দমে যায়নি। তারা রাজপথের আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে।
বাংলাদেশ ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ। ফলে এখানে ইসলামভিত্তিক রাজনীতি থাকবেই। জাতীয়তাবাদী রাজনীতিরও একটি প্রধান স্তম্ভ ইসলাম। সেক্ষেত্রে যারা জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত তারাতো একত্রিত হবেনই। সুতরাং জামায়াতকে বাদ দিয়ে আসতে হবে কেনো। আর বাংলাদেশে এখন যাদের বয়স ৬০ এর নিচে তাদের অধিকাংশই স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হয় নাবালক ছিলেন, নয়তো জন্মগ্রহণই করেননি। তাদের ঢালাওভাবে জঙ্গিবাদী আখ্যায়িত করে যে বাহবা শেখ হাসিনা কুড়াতে চেয়েচিলেন, পশ্চিমা দুনিয়ার কাছে সেটি এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে। তারা বারবার বলেছে, বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী উদার ইসলামী দল। সরকার বলেছে, বেগম খালেদা জিয়া যদি তাদের এই আহ্বানে সাড়া না দেন তাহলে সরকার নাকি আরও হার্ডলাইনে যাবে। সরকারের হার্ডলাইন শুরু হয়ে গেছে অনেক আগে থেকেই। এরপরে যা তাহলো দেশের গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাওয়া। সরকার এ পর্যন্ত যা করেছে তাতে দেশে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। সে ক্ষত পূরণ হবার নয়। সরকার যখন তার পেটোয়া বাহিনী দিয়ে জনগণের ওপর পৈশাচিক নির্যাতনে মেতে ওঠে তখন সেখানে প্রতিহিংসা কিংবা প্রতিশোধের আগুন জ্বলবেই। সেটা যদি প্রকাশ্যে সম্ভব না হয়, তাহলে প্রতিশোধকামীরা তো গোপনে সংঘটিত হবেই। সরকার যদি হুঁশে না ফেরে, গণতন্ত্রের চর্চা না করে, প্রত্যেক মানুষকে স্বাধীনভাবে তার মত প্রকাশ করতে না দেয়, অবাধে চলাচল করতে বাধা দেয়, তাহলে প্রতিরোধ তো তৈরি হবেই। সেই প্রতিরোধ, প্রতিশোধে শুধু জামায়াত কেনো সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ অংশ নিতে বাধ্য হবে। সে পরিস্থিতি কারও জন্য কাম্য নয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads