মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১৪

নরহত্যার উপত্যকা

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 
বাংলাদেশে এখন নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের মহোৎসব চলছে। পত্রিকায় চোখ বুলালেই পাওয়া যাচ্ছে তেমন সংবাদ। এটি এখন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এই সংবাদের সরল শিরোনাম হয়, লাশ উদ্ধার। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব লাশের কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। আমরা লিখি, অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির লাশ উদ্ধার। কিন্তু অজ্ঞাত পরিচয় কেমন করে হয় যার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, সে এই হত্যাযজ্ঞের অল্প কিছুদিন আগে কিংবা অল্প কিছু সময় আগেও এই সমাজের ভেতরে জীবিত ছিলো। তার একটা পরিচয় ছিলো তিনি কারও সন্তান, কারও ভাই, স্বামী বা পিতা। কিন্তু যখন লাশ হলেন তখন হয়ে গেলেন অজ্ঞাত পরিচয়। যার যায় সে বোঝে। পরিবারে-পরিবারে কান্নার রোল ওঠে। বাপ-মা-ভাই-বোন-স্ত্রী-সন্তানের আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। কারও তবু লাশ পাওয়া যায়। কারও কারও হদিস মেলে না। এভাবেই হত্যাযজ্ঞ চলছে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় যে, র‌্যাব বা ডিবি পুলিশ পরিচয়ে নিহত ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। তারপর আর সন্ধান মেলেনি। এসব ক্ষেত্রে আবার র‌্যাব-পুলিশ অস্বীকার করে বসে যে, তারা এ রকম কাউকে কখনও দেখেনি বা ধরে নেয়নি। তাহলে ভরসা কোথায়? জলজ্যান্ত মানুষটাকে র‌্যাব বা ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো। তারপর অস্বীকার করা হলো যে, তারা তাকে ধরে নেয়নি। পাওয়া গেলো লাশ। ফলে এখন পথ চলতে গা ছম ছম করে ওঠে। কেউ সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলবেনাতো যে, আমরা ডিবি পুলিশ। চলো আমাদের সঙ্গে।
এ নিয়ে আবার গোটা দেশে বিপুল বাণিজ্যও চলছে। এভাবে ধরে নিয়ে গিয়ে পরিবার বা স্বজনদের কাছে দাবি করা হচ্ছে টাকা। এটা অনেকটা ফ্রি স্টাইল। সরকার র‌্যাব-পুলিশকে বিরোধী দল দমনে এমনভাবে ব্যবহার করছে যে, তারা নিজেরাই এখন বাণিজ্যে নেমে পড়েছে। যে যেখানে যেভাবে পারছে এই বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। এখন এসেছে আরেক আপদ। যার নাম যৌথবাহিনী। তারা বিভিন্ন এলাকায় মানুষের বসত বাড়ী গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। দোকান পাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভেঙে তচনছ করে দিচ্ছে। সেই নিষ্ঠুর পৈশাচিক বর্বরতার ছবি পত্রিকার পাতায় ছাপা হচ্ছে। বহু এলাকায় মানুষ এমন প্রচ- শীতের রাতে ঘর-বাড়ী ছেড়ে ধান ক্ষেতে বন-বাদাড়ে ঘুমাতে বাধ্য হচ্ছে। এ কেমন স্বদেশ। এমন দেশ বোধকরি এখানে কেউ কল্পনাও করেনি।
এর সঙ্গে নতুন ও সুদূরপ্রসারী অনুষঙ্গও তৈরি করা হয়েছে। কোনো একটি মামলা দায়েরের সময় পুলিশ দুই, চার, পাঁচ জনের নাম দিয়ে বাকী হাজার হাজার লোককে আসামীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করছে। যেন যে কোন সময় যে কাউকে ধরে বলা যায়, সেই করেছিলো অমন অপরাধ। এ রকম ঘটনা দেখছি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে। পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে গোটা এলাকার মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে পুলিশ বাহিনীকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছিলো। তার জন্য পুলিশ ছ’হাজার জনকে আসামী করে মামলা করেছে। অর্থাৎ ঐ গোটা গ্রামের প্রত্যেক বাসিন্দাই হতে পারে এই মামলার আসামী। শুধু নাম বসিয়ে দিলেই হলো। তারপর হয়রানি আর গ্রেফতার বাণিজ্য। এর আগে আর এক ঘটনা দেখলাম। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর তার নির্বাচনী এলাকায় এক সমাবেশে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। সেখানে তার ভোটাররা তাকে জুতা নিক্ষেপ করে মন্ত্রীর কর্মকা-ের প্রতিবাদ জানায়। তাতেও অজ্ঞাত পরিচয়ের তিন হাজার ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। অর্থাৎ সেখানেও বাণিজ্যের সুবিধাটি বহাল রাখার বন্দোবস্ত করা হয়েছে।
কিন্তু জুতা কেন মারে, সেটি বিবেচনা করে দেখতে তৈরি নয় সরকার। এমন কাজ করুক যাতে লোকে  জুতা না মারে। জুতার বদলে ফুলমাল্য দিয়ে স্বাগত জানায়। এই সরকারের কেউই ফুলের মালা পাবার উপযুক্ত এমন কোনো কাজ করেনি যে, তাদের জনগণ অভিবাদন জানাবে। বরং তারা ধারাবাহিকভাবে এমন সব কাজ করছে যে, জুতা মারা ছাড়া জনগণের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। এরপর আরেকজন মন্ত্রী গিয়েছিলেন চট্টগ্রামের এক সমাবেশে বক্তৃতা দিতে। তিনি এমন কথা বলছিলেন যে, উপস্থিত সাধারণ মানুষ তার দিকে অবিরাম জুতা নিক্ষেপ করতে থাকে। 
আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপি’দের যেখানে এই অবস্থা সেখানে তারা এক ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করেছে। আর তা হলো সরকার বিরোধীদের ধারাবাহিকভাবে হত্যার মাধ্যমে তাদের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দেবার ব্যবস্থা। তারই পরিণতিতে এখন কেবলই লাশ পাওয়া যাচ্ছে। এই শুধু মধ্যরাতে হানা দিয়ে গ্রামগঞ্জ থেকে সাধারণ মানুষকে তুলে নেয়া নয়, এই শহরের ব্যস্ত রাজপথ থেকে দিনের বেলায়ও ডিবি পুলিশ পরিচয়ে বহু মানুষকে প্রায় প্রতিদিনই তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শত শত লোক দেখলো যে, ডিবি পুলিশ পরিচয়ে কেউ তাদের তুলে নিয়ে গেলো। কিন্তু পুলিশ বলে কেউ তাদের বাধা দিতে পারলো না। এবং ঐ সাধারণ মানুষ জানতেও পারলোনা যে, যে হতভাগ্যকে ‘পুলিশ’ তুলে নিয়ে গেলো তার পরিণতি কী হলো। হয়তো সে লাশ হলো। নয়তো গুম হলো। কিংবা ফিরে এলো বিপুল অঙ্কের অর্থদ- দিয়ে। এই বাংলাদেশে এরকম অবস্থা আমরা এর আগেও দেখেছি ১৯৭২-৭৫ সালে। তখন বধ্যভূমি ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ও শামসুন্নাহার হলের মধ্যবর্তী জঙ্গলাকীর্ণ স্থান। সেখানে প্রতিদিনই দুই, একটি লাশ পওয়া যেতো। এসব লাশের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলো আরও একটি নাম, এস.পি মাহবুব। সে সময় আমরা যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে থেকে লেখাপড়া করেছি তারা মধ্যরাতে গুলীর শব্দের জন্য কান পেতে থেকেছি। এই বুঝি ঐ বধ্যভূমিতে কারও প্রাণ গেলো।
আমরা তখনও বলার চেষ্টা করেছি যে, বিরোধী কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য এই হত্যাযজ্ঞ সঠিক পথ নয়। এক্ষেত্রে পুলিশের ভাষা অভিন্ন। ঐ সময় যখন সিরাজ শিকদারকে হত্যা করা হয় তখনও পুলিশ বলেছিলো, সিরাজ শিকদারকে নিয়ে সাভারের দিকে তারা যাচ্ছিলেন অস্ত্রের সন্ধানে। কিন্তু পথে সিরাজ শিকদারের সমর্থকরা আকস্মিকভাবে পুলিশের উপর হামলা চালায়। সে সময় গুলীতে নিহত হন সিরাজ শিকদার। একইভাবে গত সোমবার মেহেরপুরে নিহত হয়েছেন জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি তারেক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। পুলিশ বলছে, অস্ত্র উদ্ধারের জন্য যখন তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। তখন তার সহকর্মীরা পুলিশের উপর হামলা চালায়। তখন পুলিশও পাল্টা গুলী ছোঁড়ে। এতে নিহত হন তারেক। পুলিশ একে বলছে, ক্রসফায়ার। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করলো কিনা তা আর গুরুত্বপূর্ণ নেই।
আওয়ামী লীগ নেতা আসাদুজ্জামান নূরের গাড়ী বহরে কে বা কারা হামলা চালিয়েছিলো। সে জন্য অজ্ঞাত পরিচয়ে বহু লোককে আসামী করে মামলা দায়ের করা হয়। কয়েকদিন আগে সে মামলার এক নম্বর আসামীর লাশ পাওয়া যায় পরিত্যক্ত অবস্থায়। পরিবার বলছে, সে র‌্যাব’র হাতে আটক ছিলো। পুলিশ বলছে, তারা কিছুই জানে না। এর মাত্র দু’দিন পরে একই মামলার তিন নম্বর আসামী আতিকের লাশ পাওয়া যায়। আতিকের পরিবার বলছে, সে গ্রেফতার ছিলো র‌্যাব’র হাতে। র‌্যাব-পুলিশ গ্রেফতারের ঘটনা অস্বীকার করেছে। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করেনি যে, এ মৃত্যুগুলো আকস্মিক। সাধারণ মানুষ দৃঢ়ভাবে মনে করছে যে, এদেরকে আটক অবস্থায় খুন করা হয়েছে।
কিন্তু আমরা বারবার বলেছি, এসব খুনের ঘটনা সরকারকে কোনো অবস্থাতেই স্বস্তি দেবে না। হত্যার মধ্য দিয়ে বিরোধী কণ্ঠ স্তব্ধ করা যাবে না। স্তব্ধ করার একমাত্র পথ সম্ভবত সুশাসন। আর প্রতিহিংসার বশবর্তী না হওয়া। যদি সুশাসন থাকে তাহলে মানুষের প্রতিবাদ করার কিছুই থাকে না। বরং সুশাসনকে আরও বেগবান করার জন্য তারা সরকারের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ায়। আর সুশাসন যদি না থাকে তাহলে মানুষ খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবাদ করে। এবং শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ করে। সরকার ইতিমধ্যেই বিভিন্ন স্থানে সে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছে। যতো দিন যাচ্ছে ততোই এ প্রতিবাদ প্রতিরোধ আরও বেগবান হচ্ছে। এটাই খুব স্বাভাবিক।
আমাদের সাধারণ ধারণা এই যে, যে কোনো বিপদে-আপদে আমরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা চাই। সাহায্যের জন্য তাদের কাছে ছুটে যাই। কিন্তু যখন সেই পুলিশই জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়, তখন প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়া মানুষের আর কোনো উপায় থাকে না। এটা ঘটেছে গাইবান্ধা, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রামে। এই প্রতিরোধের অংশ হিসেবেই নূর, মখা আলামগীর, আর এক প্রতিমন্ত্রী জনরোষের শিকার হয়েছেন। ভবিষ্যতে আরও অনেকেই এরকম রোষের মুখে পড়তে পারে। এসব ক্ষেত্রে অনন্যোপায় মানুষ ভূত-ভবিষ্যৎ চিন্তা করে না। বর্তমানের হানা-হামলা থেকে আত্মরক্ষাটাই বড় হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে গোটা দেশের ১৬ কোটি মানুষকে আসামী করে কিছুতেই শেষ রক্ষা হবে না। মানুষ প্রতিবাদ করবেই। আত্মরক্ষার জন্য নিজেরাই প্রতিরোধ গড়ে তুলবেÑ এটা খুব স্বাভাবিক। বালির বাঁধ দিয়ে জোয়ারের জল রোধ করা যায় না। জনতার জয় হবেই হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads