বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০১৪

সংখ্যালঘুদের উপর হামলা প্রসঙ্গ


আওয়ামী প্রহসনের নির্বাচনের দিন থেকে হঠাৎ করে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের নাগরিকদের সহায়-সম্পত্তি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে জানমালের উপর হিংসাত্মক আক্রমণ শুরু করা হয়েছে। বর্বর এই ঘটনার দ্রুততা এবং ব্যাপকতা দেখে দেশের সচেতন নাগরিকদের মনে সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক যে, এসব বর্বর হামলা কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়। এসব সিরিজ হামলার পেছনে একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা রয়েছে। শুধু সুচিন্তিত পরিকল্পনাই নয়, যারা এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে, তাদের পেছনে আধিপত্যবাদী সন্ত্রাসী অপশক্তির মদদ রয়েছে বলেও গোপন রহস্য এখন ফাঁস হতে শুরু করেছে। যশোরের অভয়নগর ও মনিরামপুর উপজেলায় যখন ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা করা হয় তখন অনেকে মনে করেছিলেন যে, এটি হয়তো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষের স্থানীয় বিরোধভিত্তিক তাৎক্ষণিক উত্তেজনার ফল। কিন্তু গত ৫ জানুয়ারির আওয়ামী ভোটারবিহীন ভুয়া নির্বাচনের পর থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও একটি পূর্ব পরিকল্পিত ভয়াবহ ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। গত কয়েকদিন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি ঘটনার খবর উল্লেখ করার মতো। নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকটি বাড়ি-ঘরে সন্ত্রাসীরা হামলা করেছে। জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার কুসুম্বা ইউনিয়নের সোনাকুল গ্রামে রাতে তাপস নামে এক সংখ্যালঘুর বাড়ির খড়ের গাদায় আগুন দিয়েছে স্থানীয় দাগী সন্ত্রাসীরা। শেরপুর উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের পশ্চিম বক্কাকুড়া গ্রামের গীর্জার গেটে গত মঙ্গলবার রাতে আগুন দিয়েছে সন্ত্রাসীরা। নওগাঁর রাণীনগরে গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে সন্ত্রাসীরা কুবড়াতলী এলাকার রেজাউলের তুলার মিলের পাশে রাখা তুলা বোঝাই একটি গাড়িতে, পশ্চিম খট্টেশ্বরের আঃ রাজ্জাকের ২টি খড়ের গাদায়, তাজিমুদ্দিনের ১টি, আবুলের ১টি, মোসাদ্দেকের ২টি, শ্রী চরণের ১টি, গোপী মোহনের ১টি, প্রাণ চরণের ১টি ও সদাশ্রী চরণের ২টিসহ ১১টি খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে দিয়ে সন্ত্রাসীরা দ্রুত পালিয়ে যায়। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার গোপালপুরে গত মঙ্গলবার রাতে পুলকেশ বসুর ঘরে রাখা ধানের গোলায় আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে সন্ত্রাসীরা। এতে প্রায় ২০ হাজার টাকার ধান পুড়ে যায়। গাইবান্ধার কোপতলা ইউনিয়নের এবং সদর উপজেলার ভেড়াডাঙ্গা গ্রামের সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘরে সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। চট্টগ্রামের সীতাকু-ের কয়েকটি স্থানে, পৌর সদর এলাকার দত্তবাড়ী, আমিরাবাদ গ্রাম, সৈয়দপুর ইউনিয়ন, বারবকু-ের নামার বাজার ও কুমিরার হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছুসংখ্যক ব্যক্তির উপর সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। ময়মনসিংহের ত্রিশাল ও নেত্রকোনার কলমাকান্দায় হিন্দু মন্দিরে আগুন দিয়েছে সন্ত্রাসীরা। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় ১টি এবং ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় ১টি হিন্দু বাড়িতে সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়েছে। জামালপুরের উপজাতি পরিবার এবং দিনাজপুর শহরের কর্নাই গ্রামে সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘরে হামলা ও ভাঙচুর করেছে দাগী সন্ত্রাসীরা। এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর, পটুয়াখালীর কলাপাড়া এবং গাইবান্ধার বেড়াডাঙ্গা গ্রামে হিন্দুদের বাড়ি-ঘরে হামলা করেছে চিহ্নিত সন্ত্রাসী দাগী অপরাধীরা। নোয়াখালী জেলার হাতিয়ার দক্ষিণ তমরদ্দি গ্রামে প্রদীপ দাসের একটি খড়ের গাদায় সন্ত্রাসীরা আগুন দিয়েছে। প্রদীপের স্ত্রী নীলিমা সাংবাদিকদের জানান, আগুনে খড়ের গাদাটি সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে।
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো যে, গত ৫ জানুয়ারির তথাকথিত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ মানুষ যখন বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে ঠিক তখনই গণতন্ত্রকামী জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার জন্যই আধিপত্যবাদী অপশক্তির ইশারায় এদেশেরই কায়েমী স্বার্থবাদী অপশক্তি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার হত্যাকারী, সন্ত্রাসী লুটেরা স্বৈরাচারদের হুকুমে যশোর থেকে সংখ্যালঘুদের উপর যে সন্ত্রাসী হামলা শুরু, গত কয়েক দিনে তার বিস্তৃতি ঘটেছে অনেক জেলা ও উপজেলায়।
আজ দুই সপ্তাহ পেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই সন্ত্রাসী হামলার পেছনে কারা দায়ী, সে সম্পর্কে সুষ্ঠু তদন্ত ও আইনের মাধ্যমে কোনো গোষ্ঠী বা ব্যক্তিকে দায়ী করা হয়নি এবং দায়ী করার কোনো পদক্ষেপও সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি। আমরা মনে করি, বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর। অথচ পুরো বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার অপচেষ্টা চালানোর কৌশল নেয়া হচ্ছে। মনে হচ্ছে যে, বিরোধী রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াতসহ ১৮ দলীয় জোটের উপর দায়ভার চাপাতে পারলেই আওয়ামী সরকার ও মহল এবং  প্রশাসনের দায়িত্বশীল আওয়ামী আমলাদের সকল দায়-দায়িত্ব শেষ। যশোরের ডিসি হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। নির্বাচন নাটকের দিন যখন অভয়নগর ও মনিরামপুরে মানবতার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী হামলার খবর তার কাছে এসে পৌঁছে, তখন তিনি বলেন যে, তার ফোর্স ব্যালট বাক্স রক্ষায় ব্যস্ত। এই মুহূর্তে হামলা কবলিত এলাকায় ফোর্স পাঠানো সম্ভব নয়। পাবনায় ৪০টি হিন্দু বাড়িতে হামলা হয়। আওয়ামী সরকারের সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ অভিযোগ করেছেন যে, এই হামলায় সরকারের (সদ্য বিদায়ী) স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর সন্ত্রাসী বাহিনী অংশ নিয়েছে। শুধু এবারই নয়, এই পর্যন্ত যতবার যত জায়গায় সংখ্যালঘুদের উপর মানবতাবিরোধী সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, অপরাধ সংঘটিত করা হয়েছে, তার কোনটিতেই বিচার বিভাগীয় তদন্ত তো দূরের কথা, কোনো উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত অনুষ্ঠিত হয়নি। সাম্প্রদায়িক সহিসংতার জন্য আজ পর্যন্ত একজন ব্যক্তিকেও দায়ী করা হয়নি। এবং একজন ব্যক্তিকেও আইনের আওতায় আনা হয়নি। এর ফলে প্রকৃত অপরাধীরা আড়ালেই থেকে গেছে এবং ইস্যুটি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে অপর পক্ষ ব্যবহার করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে।
২০১১ সালে কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলার মানবতাবিরোধী সন্ত্রাসী ঘটনায় গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দাগী সন্ত্রাসীদের নাম উঠে এসেছিল। আঞ্চলিক ভিত্তিতে সেই ঘটনার তদন্তও হয়েছিল। আওয়ামী সরকার সেই তদন্ত রিপোর্ট ধামাচাপা দিয়েছে। এখন বোধগম্য কারণেই দেশব্যাপী অভিযোগ উঠেছে যে, গত ৫ জানুয়ারি বিরোধী দলবিহীন, ভোটারবিহীন নির্বাচনের নামে যে আওয়ামী তামাশার নাটক মঞ্চস্থ করলো নির্বাচন কমিশন, সেই তামাশা থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্নদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার জন্যই সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর আওয়ামী সন্ত্রাসী অপশক্তি এই সুপরিকল্পিত মানবতাবিরোধী হামলা চালিয়েছে। এই অপশক্তি গণতন্ত্র ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনা সংঘটিত করার মধ্য দিয়ে ইতোমধ্যেই আংশিকভাবে সফলতার দাবি করছে। কারণ নির্বাচনের নামে সারা দেশে ভোটার উপস্থিতি যে অবিশ্বাস্য নি¤œ হার এবং প্রায় সব নির্বাচনকেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী নামধারী সশস্ত্র ক্যাডার-সন্ত্রাসীদের জালভোটের মহোৎসব নির্বাচনের উপর যে কলঙ্ক তিলক এঁকে দিয়েছে সেই কলঙ্ক তিলক সংখ্যালঘু হামলার প্রচারণায় ইতোমধ্যেই ম্লান হতে বসেছে। একশ্রেণীর মিডিয়া সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী হামলাকে এমনভাবে প্রচার করছে, যাতে করে প্রহসনের নির্বাচনের কেলেঙ্কারি চাপা পড়ে যায়। দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণের দাবি, স্বৈরাচারী এবং মানবতাবিরোধী মহল বিশেষের প্রপাগান্ডার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করে সন্ত্রাসী, অপরাধীদেরকে তদন্তের মাধ্যমে শনাক্ত করা হোক এবং কঠোর শাস্তি দেয়া হোক।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads