বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৪

নরেন্দ্র মোদী : ‘নব্য-হিটলার’ আতঙ্কে কম্পমান শান্তিবাদী দক্ষিণ এশিয়া


১.
উগ্র-হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) চলতি বছরে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে গুজরাটে মুসলিম নিধনের খলনায়ক নরেন্দ্র মোদীকে দিল্লীর মসনদে প্রধানমন্ত্রী পদে বসার জন্য দলীয় মনোনয়ন দিয়েছে। সকলেই জানেন যে, মোদী একজন ‘নব্য-হিটলার’ ইহুদি নিধনের জন্য হিটলারের যে কুখ্যাতি, মুসলিম নিধনের জন্য মোদীরও এই কুখ্যাতি। আবার হিটলারের সঙ্গে তুলনায়ও মোদীর অনেক মিল রয়েছে। এই একনায়কতন্ত্রী ও অত্যাচারী নেতা কাজ করেন ভারতব্যাপী উগ্র হিন্দুত্বের রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে। ফলে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ভারতের তথাকথিত গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, পরমতসহিষ্ণুতা বাস্তবিক অর্থেই হুমকির সম্মুখীন। ভারতের শান্তিবাদী ও সংখ্যালঘু জনতা এবং আঞ্চলিক ক্ষুদ্ররাষ্ট্রসমূহ প্রকৃত অর্থেই আতঙ্কিত। ভারত একটি সভ্য মুখোশ চাপিয়ে যেভাবে নিজ দেশে সংখ্যালঘু ও স্বাধীনতাকামীদের নিধন করেছে এবং সমগ্র অঞ্চলে সম্প্রসারণবাদ ও আধিপত্যবাদ কায়েম করেছে, তাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য মোদীর চেয়ে উগ্র ও কট্টরপন্থী আর কেউ নেই। সিকিম, ভূটানে দখল আর অন্যান্য প্রতিবেশী রাষ্ট্র তাঁবেদারদের অধীনে শাসনের মাধ্যমে শোষণ ও আধিপত্য বজায়ের ভারতীয় যে ধারা এখন দক্ষিণ এশিয়ায় চলছে, উগ্র-হিন্দু সাম্প্রদায়িক মোদীকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে সেই ব্রাহ্মণ্যবাদী এজেন্ডার পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের শেষ ধাপ এসে গেছে। হিটলারের সঙ্গে মোদীর তুলনায় সেই সত্য স্পষ্ট হবে।     
২.
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিপুল আর্থিক বোঝা সামলাতে জার্মানির অর্থনীতির সে সময় নাভিশ্বাস দশা। উৎপাদন কমতির দিকে, চাহিদার ঘাটতি, বেকারত্ব প্রভৃতি সমস্যায় জর্জরিত দেশ। এই অবস্থায় জাতিসত্তার হৃতগৌরব ফিরিয়ে দেয়ার ঢালাও প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসেন হিটলার। সবটাই যে তার ফাঁকা প্রতিশ্রুতি ছিল, তা নয়। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৯, এই ছয় বছরের মধ্যে বিশ্বযুদ্ধ-বিপর্যয় দেশের অবস্থা বহুলাংশে বদলে দেন হিটলার। উৎপাদনের গতি আসায় চাহিদা বেড়েছিল। ফলে বেকার সমস্যারও সমাধান করা সম্ভব হয়। হিটলারের নেতৃত্বে হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে থাকে জার্মানি।
হিটলার ক্ষমতায় এসে শিল্পপতি, জাতীয়তাবাদী ও সৈন্যদলের একটি উগ্র অংশকে হাত করে নেন। জার্মানির স্বার্থের নামে এদের কাছ থেকে হিটলার আদায় করেন সীমাহীন ও প্রশ্নহীন আনুগত্য। এই উগ্র সমর্থকদের নিয়ে হিটলার জার্মানির সমৃদ্ধির চাকাতে এতটাই সচল করেন যে, বিশ্ব দখলে উদ্যত হন। শুধু জার্মানিতেই হিটলারের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি সীমাবদ্ধ থাকেনি, ইউরোপের দেশে দেশেও ছড়িয়ে যায়। তার গুণমুগ্ধের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। হিটলার-ভক্তদের মধ্যে ছিলেন রাষ্ট্রনায়ক (ব্রিটেনের রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড) এবং সমাজের নানা পেশা ও শ্রেণীর মানুষ। তাঁকে নিয়ে সে সময় সারা পৃথিবীতেই আলোড়ন তৈরি হয়েছিল। এতটাই যে, ১৯৩৯ সালে ‘টাইম’ পত্রিকা প্রচ্ছদপটে হিটলারকে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’ ঘোষণা করে। আর ঠিক সেই বছরই হিটলারের উগ্র-জার্মান বাহিনী আক্রমণ করল পোল্যান্ড। বেজে উঠে মহাযুদ্ধের দামামা। অল্প বছরের ব্যবধানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হলো, যাতে পারমাণিক বোমার অপব্যবহার ছাড়াও প্রভূত সম্পদ হানি আর কমপক্ষে পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটে। ঘরোয়া হোপিওপ্যাথিতে অভ্যস্ত, নিরামিষাশী একজন মানুষ সামান্য সময়ের মধ্যে কীভাবে গোটা বিশ্বের ত্রাসে পরিণত হলেন, সেটা ভেবে স্তম্ভিত হয়ে যায় পুরো বিশ্বমানবতা। যদিও তার উত্থান ছিল ক্রমশ-প্রকাশ্য। ঝাঁ-চকচকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন দিয়ে মানবতা-বিরোধী প্রবল রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়কে আবডাল করার চেষ্টা করেছিলেন হিটলার। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। আত্মঘাতী হয়ে যুদ্ধে-পরাজয়ের দায় ও গ্লানি থেকে নিজেকে মুক্ত করলেও ইতিহাস তাকে ক্ষমা করেনি। খামখেয়ালি ও নিষ্ঠুর এক যুদ্ধবাজের তকমা সে কারণে আজও তাকে মানবতা ও শান্তির শত্রুরূপেই পরিচিতি দিয়ে রেখেছে।
৩.
অতীত থেকে বর্তমানের ভারতবর্ষ। প্রেক্ষাপটটি তুলনীয়, কারণ চলছে চূড়ান্ত অস্থিরতা ও ব্যক্তি ক্যারিশমার বিকাশ। চারদিকে ভরপুর নৈরাজ্য ও নৈরাশ্য। দিল্লিতে স্বল্প মেয়াদি ক্ষমতার ধারা। কেন্দ্রে সরকার আছে বলে মাঝে-মাঝে শোনা যায় কিন্তু কাগজ-পত্র ছাড়া বাস্তবে সেটার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না। সে সরকারে মন্ত্রী-আমলা সকলেই আছেন বটে কিন্তু তাদের উল্লেখযোগ্য কাজ নেই। দুই-চারটি বিল পাশই যেন শেষ কাজ। তারপর ঘোরতর স্থবিরতা। সব কিছু যেন থমকে আছে সরকারকে ঘিরে। সংস্কার-টংস্কার নিয়ে কথাবার্তা হলেও সেটা কাজে দেখানোর সময় সরকারকে ক্র্যাচে ভর করে নানা শরিকের শক্তিতে খুঁড়িয়ে চলতে দেখা যায়। ফলে মুল্যবৃদ্ধি ঘটে। ফড়েবাজি ঠেকানো যায় না। মধ্যবিত্তের চোখে ভাসে সরষে ফুল। আবার ভর্তুকি-খাতে করের টাকা জমা করানোয় সেই চোখ-ঝাপসা মধ্যবিত্তই পরিণত হয় বলির পাঁঠায়। কখন সরকারের গণেশ উল্টে যায়, সেই ভয়ে অর্ধমৃত কেন্দ্রের সরকার। ক্ষমতা রক্ষায় মানতে হয় দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি। নানা সময়ে সরকারের মন্ত্রীরা কখনও স্বজন-পরিবৃত্ত (উদাহরণ, রেল মন্ত্রণালয়ে মামা-ভাগিনার খেলা), কখনও পরিজন-পরিবৃত্ত (উদাহরণ, টু-জি স্পেকট্রাম) হয়ে বেশ টু-পাইস কামিয়ে নিচ্ছেন। আর জোট দায়বদ্ধতাকে ভীষ্ম-প্রতিজ্ঞা করে নৈঃশব্দের প্রতিরূপ হয়ে ধৈর্য্যরে পরীক্ষা দিয়ে চলেছেন সরকারের শীর্ষ পদাধিকারীগণ। ফলে প্রতিকার-প্রতিরোধহীন এই ধরনের রাষ্ট্রীয় পুকুরচুরির ঘটনা ঘটেছে দিনের পর দিন। এইসব অনিয়ম ও অবক্ষয় জনতার ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটিয়েছে, বাড়িয়েছে বিরক্তি, মনে জন্ম দিয়েছে হতাশা, পুঞ্জিভূত করেছে ক্ষোভ। ইউপিএ সরকারের অকর্মন্যতার বিরুদ্ধে গলি থেকে রাজপথে নেমেছে মানুষ। দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনও হয়েছে অনেক। ভারতের নৈরাশ্যের ঘনান্ধকারে এক বিন্দু আলো হাতড়ে বেড়াচ্ছিলেন মানুষ। সেই সঙ্কুল পরিস্থিতিতে বিপর্যস্ত জার্মানির হিটলারের মতো ভারতে নরেন্দ্র মোদীর উত্থান। হিটলারের মতো তার সঙ্গে শিল্পপতি আর দলীয় ক্যাডারের ভিড়। মুকেশ আম্বানি, রতন টাটার আইকন মোদী। এবং হিটলারের মতো মোদীও ‘টাইম’ প্রচ্ছদে চলে এসেছেন (২০১২ সালে)। ঘঙগঙ৪চগ, মানে, নরেন্দ্র মোদী ফর প্রাইম মিনিস্টার, শিরোনামে মিডিয়া ও ওয়েব জগতে চলছে প্রচার-যুদ্ধ। ভারতের মধ্যে এবং বিশ্বব্যাপী অভিবাসী ভারতীয়দের সামনে মোদীর ‘গুজরাট-মডেল’ তুলে তাকে বানানো হচ্ছে হিরো। মুখ্যমন্ত্রী রূপে ‘ভাইব্রান্ট গুজরাট’ শ্লোগান দিয়ে মোদী তার রাজ্যকে ভারতের এক নম্বর সমৃদ্ধশালী রাজ্যে পরিণত করার সঙ্গে সঙ্গে শিল্পায়ন, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বিমোচন, আয় বৃদ্ধি, বিনিয়োগ বাড়ানো, আধুনিকায়ন ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নসহ ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করেছেন। যেমন বিধ্বস্ত জার্মানির উন্নয়নে হিটলার, তেমনি গুজরাতের বিকাশে মোদী, যাকে এখন উপস্থাপন করা হয়েছে বিজেপি’র পক্ষ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী রূপে। সুকৃতির পাশাপাশি কুকীর্তিতেও হিটলার আর মোদী তুলনীয়। তার গামলা ভর্তি সুকর্মের দুধের মধ্যে রয়েছে দুষ্কর্মের ফোঁটা ফোঁটা চোনা। যে কারণে ইতিহাসের পর্যবেক্ষকগণ বিগত শতাব্দীর মানবতার পয়লা নম্বর শত্রু হিসাবে কুখ্যাতি অর্জন করা জার্মানির সেই একনায়ক হিটলারের সঙ্গে মোদী-চরিত্রের তুলনা টেনে আনতে বাধ্য হচ্ছেন। হিটলার ও মোদীর মানবতাহীনতার তুলনামূলক আলোচনার স্বার্থে সে রকম অনেক ঘটনার মাত্র কয়েকটি উল্লেখ করা যেতে পারে।
মোদীর বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র কথা বললে বা অবস্থান নিলে, এমন কি, ট্যাঁ-ফোঁ করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দুরবস্থা কী রকম হতে পারে, তা ভাবলে শিউরে ওঠেন তাঁর অধস্তন মন্ত্রী-আমলারা। শাস্তির খাঁড়া হয়ে নামতে পারে বিপদজ্জনক বদলি, পদাবনতি। এমনকী, আরও খারাপ কিছু। হিটলারের মতো মোদীও নিরামিষাশী। কিন্তু তার দোর্দ-প্রতাপ চরিত্রে নিরামিষের ছিটে-ফোঁটাও নেই। দলের অভ্যন্তরে মোদীর বিরুদ্ধাচরণ করে এ পর্যন্ত টিকতে পারেননি কেউই। নিপুণ দক্ষতায় একে-একে পথের কাঁটা দূর করেছেন মোদী। যেমন, ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলকে সরিয়ে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হন মোদী। রুষ্ট কেশুভাই প্রথমে বিক্ষুব্ধ ও পরে বিদ্রোহী হন। কিন্তু কিছুই করতে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত দল ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। শুধু পদ থেকে নামানো নয়, প্রতিদ্বন্দ্বীকে হটিয়ে দিতে পারঙ্গম বলেই মোদী নির্বিঘেœ দশকের পর দশক রাজতন্ত্রের আদলে গুজরাতে শীর্ষ আসনটি কব্জা করতে পেরেছেন। কেশুভাইয়ের মতো যারাই মাথা তুলতে বা অমান্য করতে চেয়েছেন, যেমন, গোবর্ধন জাডাফিয়া প্রমুখ দল ছেড়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন। উদাহরণ স্বরূপ, দীর্ঘদিন জাতীয় কর্মসমিতির সদস্য সঞ্জয় জোশীকে পর্যন্ত দল ছেড়ে ভাগতে হয়েছে। জোশীর অপরাধ একটাই, ব্যক্তিগতভাবে মোদী তাকে পছন্দ করতেন না। সঞ্জয় না হয় দল ছেড়ে প্রাণে বেঁচেছেন, একদা মোদীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদাবাদের এলিস ব্রিজ এলাকার বিধায়ক হরেন পা-া তো প্রাতঃভ্রমণ সেরে জীবিতাবস্থায় বাড়িই ফিরতে পারেননি। তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে পৃথিবী থেকেই। যে হত্যাকা- মোদীকে প্রশ্নবিদ্ধ করে অস্বস্তিতে ফেললেও মোদী ভ্রƒক্ষেপ পর্যন্ত করেননি। কে কি বলছে, সেটা পরোয়া না করে বরং তিনি খুনের সকল আলামত ও প্রমাণসমূহ অতি যোগ্যতার সঙ্গে নিজের শরীর থেকে সরিয়ে ফেলেন।   
হিটলারের ইহুদি-নিধনের মতোই মোদীর মুসলিম নিধন তুলনাযোগ্য। গোধরা-পরবর্তী সময়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর নির্বিচারে হামলায় যে তিনি পুলিশ-প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় ও পুরো সরকার ব্যবস্থাকে ঠুঁটো করে রেখেছিলেন, তা ইতিমধ্যে নানা কমিশন রিপোর্ট ও বিচার বিভাগীয় তদন্তে সংশয়াতীতভাবে প্রমাণিত। এই প্রসঙ্গে মাত্র একটি ঘটনার উল্লেখই সম্ভবত যথেষ্ট হবে। সেটি হলো: রাজধানী আহমেদাবাদের গুলবর্গা সোসাইটির বাসিন্দা কংগ্রেস নেতা ও প্রাক্তন সংসদ সদস্য এহসান জাফরিকে ২০০২ সালে মুসলিম-বিরোধী দাঙ্গায় নিষ্ঠুরভাবে কুপিয়ে ও জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিল মোদীর দাঙ্গাবাজ কর্মীরা। কারণ ছিল জাফরির জনপ্রিয়তা। তিনি ১৯৭৭ সালে সারা দেশে প্রবল ইন্দিরা-বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও নিজ কৃতিত্ব ও প্রভাবে জয়ী হয়েছিলেন। তাকে হত্যার সময়  পেশাদারিত্বের প্রমাণ রাখে অপরাধীরা। হত্যাকারীদের কাজের ধরন দেখে সেটা বোঝা যায়। দাঙ্গার প্রয়োজনে মুসলিম-অধ্যুষিত ঐ অঞ্চলের প্রতিটি বাড়ির প্রতিটি বাসিন্দার নাম-ঠিকানার তথ্য-সংবলিত কম্পিউটার প্রিন্ট আউট জোগাড় করা হয়েছিল স্থানীয় পৌরসভা ও ভোটার পরিচিতিপত্র নথিকরণ কেন্দ্রের দপ্তর থেকে। নিজের ও এলাকাবাসী মুসলিম জনতার জন্য বারবার পুলিশি সাহায্য চেয়েছিলেন আক্রান্ত জাফরি। তার এলাকায় গিয়ে স্বয়ং পুলিশ কমিশনার আশ্বাস দিয়ে এসেছিলেন, বলেছিলেন, নির্ভয়ে থাকতে। কিন্তু যথাসময়ে কোনও সাহায্যকারীই আসে নি। শত শত মুসলমানের সঙ্গে নিজের এলাকার মধ্যে প্রভাবশালী এই নেতাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল দাঙ্গাবাজদের হাতে। দাঙ্গাবাজরা দীর্ঘ সময় ধরে ধীরে-সুস্থে হত্যাকা- চালিয়ে নিরাপদে চলেও গিয়েছিল। যদিও জাফরির বাড়ি ও মুসলিম এলাকা থেকে আহমেদাবাদ পুলিশ কমিশনারের অফিসটি ছিল ঢিল-ছোঁড়া দূরত্বে। মাত্র এক কিলোমিটারেরও কম। এত কিছুর পরেও মোদীর অভিধানে অনুতাপ বা অনুশোচনা নামক কোনও শব্দের ঠাঁই নেই। যদিও রাজনীতিবিদদের কাছে অনুতাপ, অনুশোচনা, ক্ষমাÑএসব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। কিন্তু মোদী এসবের বদলে ভয়ঙ্কর আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে নিজের অপকর্মের সমর্থনে যুক্তি সাজান। এমন কি, নিজের দলের অপরাধীকে পুরস্কৃত করেন। যেমন, ২০০৫ সালে সংঘটিত সোহরাবউদ্দিন হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন মোদীর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে সিবিআই তদন্তের ফলে গ্রেফতার হয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিতে হয় অমিত শাহকে। জামিন পেলেও গুজরাত প্রবেশে এখনও তার উপর আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এই অমিত শাহকেই আগামী লোকসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশে দলের দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন মোদী। নিজের বা দলের অপরাধীর ব্যাপারে তিনি কখনওই অনুতপ্ত নন, বরং পৃষ্ঠপোষক। উল্লেখ করা দরকার, অমিত শাহকে উত্তরপ্রদেশ প্রেরণ করার পরই মুজাফফরনগরে শুরু হয় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও সংঘর্ষ।
৪.
হিটলারের মতো মোদী রুক্ষ ভাষায় কথা বলেন। নিজের লোকদের উত্তেজিত করেন। বাহবা দেন। প্রতিপক্ষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেন। এহেন মোদীকে পেয়ে পোয়াবারো হয়েছে কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের। কিন্তু একনায়কতন্ত্রের শক্তিতে অপরাধকে আইনি বৈধতা ও রাজনৈতিক পোশাক দেয়ার মাধ্যমে প্রতিপক্ষ ও সংখ্যালঘু নিধন করে যে উন্নয়ন ও সুশাসনের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে উজ্জ্বলতার চেয়ে কালো রক্তের ছাপই অধিক। প্রশ্ন উঠেছে, ক্ষমতায় এলে মোদীও কি হিটলারের মতো একদিকে উন্নয়ন আর আরেক দিকে ধ্বংসযজ্ঞের ধারা চালিয়ে যাবেন? ভারতীয় গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে হিন্দুত্বের উগ্র আবেগের কাছে বলি দেবেন? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে আগামী নির্বাচনে ভারতীয় ভোটাররা কি সিদ্ধান্ত জানান, সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু শান্তিবাদী দক্ষিণ এশিয়া যদি সম্প্রসারণবাদী-আধিপত্যবাদী একটি দেশের ক্ষমতার শীর্ষে উগ্র সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গীভাবাপন্ন নেতাকে পায়, তাহলে গণতান্ত্রিক পরমতসহিষ্ণুতা ও মুসলিম সংখ্যালঘুদের যে বারোটা বাজবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সন্দেহ সাদা চামড়ার লাল-মুখো সাহেবদের নিয়ে; যারা বিশ্বের সর্বত্র জঙ্গীবাদ-মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িক দল ও নেতাদের দেখে, মোদীকে দেখে না!      

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads