গুম-অপহরণের শিকার হওয়ার জন্য তো মানুষ সমাজবদ্ধ হয়নি। মানুষ সমাজবদ্ধ হয়েছে মানবিক প্রয়োজন মিটাবার আকাক্সক্ষায়। সমাজবদ্ধ মানুষ রাষ্ট্র গঠন করেছে সুশাসন, নিরাপত্তা ও উন্নত জীবনযাপনের লক্ষ্যে। নাগরিকদের এইসব লক্ষ্য পূরণ না হলে রাষ্ট্র তার গুরুত্ব হারায়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, স্বাধীনতার ৪৩ বছরে দেশের জনগণ গণতন্ত্র ও সুশাসনের কথা অনেক শুনেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, গণতন্ত্র ও সুশাসনের স্বাদ তারা আস্বাদন করতে পারেননি। দেশে সুশাসন থাকলে একের পর এক গুম বা অপহরণের ঘটনা ঘটে কেমন করে? এর জবাব তো সরকারের দেয়ার কথা। কিন্তু সঙ্গত কোনো জবাব জনগণ এখনও পায়নি।
পত্র-পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলেই এখন অপহরণের নানা খবর পাওয়া যায়। অপহরণের সাথে এখন যেন জড়িয়ে গেছে সাদা পোশাক ও সাদা মাইক্রোবাস। সাদা পোশাকধারীরা নিজেদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে একের পর এক অপহরণ করে যাচ্ছে। অপহৃত ব্যক্তিদের কারো কারো লাশ পাওয়া যাচ্ছে, আবার কারো কারো পাওয়া যায় না কোনো খোঁজ। গত মঙ্গলবার পত্রিকান্তরে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৩ ঘণ্টায় এক ডজন মানুষকে অপহরণ করা হয়েছে। বেশির ভাগ ঘটনায়ই সাদা পোশাকধারীরা নিজেদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বলে পরিচয় দিয়েছেন। এদিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে না। কারো সাথে কথা বললে বলা হয়, এ সবের সাথে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জড়িত নয়, হয়তো সংঘবদ্ধ অপরাধীরা নিজেদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে এই অপকর্ম করছে। তাহলে কারা করছে তাও উদঘাটনে ব্যর্থ পুলিশ ও গোয়েন্দারা। এমন কি বহুল আলোচিত আবু বকর সিদ্দিক অপহরণের সাথে কারা জড়িত তাও দুই সপ্তাহে উদঘাটন করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। সাদা পোশাকের ব্যাপারে বর্তমানে যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করার জন্য অনেকেই বলছেন, কাউকে গ্রেফতার বা পাকড়াও করতে হলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দিষ্ট পোশাক পরেই তা করা উচিত। তাহলে একদিকে বিভ্রান্তি যেমন দূর হবে, তেমনি সুযোগ সন্ধানীরাও নিজেদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোক বলে পরিচয় দেয়ার সুযোগ হারাবে।
এখন প্রায় প্রতিদিনই অপহরণের খবর পাওয়া যাচ্ছে। গত রোববার বেলা আড়াইটার দিকে নারায়ণগঞ্জ থেকে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের দুই নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও তার চার সঙ্গী। নজরুলের ব্যবহৃত গাড়িটি গাজীপুরের শালবন থেকে উদ্ধার হলেও তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। প্রায় একই সময় নারায়ণগঞ্জ থেকে অপহৃত হয়েছেন এডভোকেট চন্দন ও তার ড্রাইভার। তাদের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত। অপহরণের এইসব ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ নারায়ণগঞ্জবাসী আগুন জ্বালিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেছে। অপহৃতদের জীবিত ফেরত পেতে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তাদের স্বজনরা। গত সোমবার সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তারা এ আকুতি জানান। এদিকে নিখোঁজ ৭ জনকে জীবিত উদ্ধারে পুলিশ প্রশাসন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তৎপরতা চালাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি গোলাম ফারুক। দৈনিক আমাদের সময়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নজরুলসহ ৫ জন অপহরণের ঘটনায় অভিযুক্ত সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নূর হোসেনসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে গত সোমবার ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার বাদী হয়েছেন অপহৃত নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি। এদিকে সোমবার রাত পৌনে এগারটায় নিখোঁজ আইনজীবী চন্দনকুমারের গাড়িটি রাজধানীর গুলশান নিকেতন এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার নিশ্চিত করেন। গুম বা অপহরণের ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে জনমনে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। প্রথম দিকে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গুম হতে দেখা গেছে, মাঝে মাঝে ব্যবসায়ীরাও গুম হয়েছেন। এখন সরকারি দলের লোকজনকেও গুম হতে দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, মুক্তিপণ, দলীয় প্রভাব-প্রতিপত্তির কোন্দলসহ নানা ক্ষেত্রে এখন অপহরণের ঘটনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অপহরণের মত ঘটনার নায়কদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে প্রশাসন ব্যর্থ হওয়ায় অপরাধীরা এখন বেশ বেপরোয়া। ফলে এখন সরকারি ঘরানার কাউকে কাউকে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত বলেছেন, সম্প্রতি যেভাবে গুম ও অপহরণ হচ্ছে তা সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। তাই সরকারের সামনে এখন দু’টি চ্যালেঞ্জ। একটি হলো আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, অন্যটি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। তিনি আরো বলেন অপহরণ, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের পেছনে কারা রয়েছে তা খুঁজে বের করতে হবে। নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পর সারাদেশে আইনের শাসনে বিশ্বাসী মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। এদিকে গত সোমবার এক মানববন্ধন কর্মসূচিতে সুপ্রীমকোর্ট বারের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেছেন, দেশে আইনবহির্ভূত হত্যা, গুম, অপহরণ বেড়েই চলেছে। অথচ সরকার এ বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করছে না। সরকারের র্যাব, পুলিশ ও সন্ত্রাসীরা এই হত্যা, গুম ও অপহরণ করছে।
দেশে আশঙ্কাজনক হারে অপহরণ ও গুমের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানও। গত সোমবার দৈনিক আমাদের সময়ের সাথে এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, কোনো নাগরিক যদি নিখোঁজ, অপহৃত কিংবা গুম হয়ে যান, তা তিনি যে-ই হন না কেন, তাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চোখ যদি না খোলে, আগামী ২-৩ দিনের মধ্যে যদি এটার প্রতিফলন না ঘটে তাহলে আমরা আইনি পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হব। প্রয়োজনে আদালতে যাব। ড. মিজান আরো বলেন, অপহরণের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের গ্রেফতারের দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর। এ বাহিনী সে ধরনের চৌকসও। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যর্থ হলে যেকোনো মানুষ বলবে, রাষ্ট্রের হয়তো কোনো না কোনোভাবে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
অপহরণ, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের বিষয় এখন জাতির জন্য প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনিতে দেশের মানুষ নানা সমস্যায় জর্জড়িত। দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও মানুষ জীবনের নিরাপত্তা চায়, একটু শান্তিতে ঘুমাতে চায়। কিন্তু অপহরণ ও গুমের আতঙ্ক মানুষের সে শান্তিটুকু কেড়ে নিয়েছে। সরকার যদি গুম ও অপহরণের মত ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করে মানুষকে স্বাভাবিক জীবনযাপনের গ্যারান্টি দিতে না পারে, তাহলে সেই সরকার দিয়ে জনগণ কি করবে? অপহরণ ও গুমের ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের প্রতি জনগণের অভিযোগের মাত্রা বাড়ছে। বিষয়টি যে সরকার বোঝে না তা নয়। তারপরেও গুম ও অপহরণের ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সরকার কেন কার্যকর ভূমিকা পালনে সমর্থ হচ্ছে না, তা এক রহস্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই রহস্যের সমাধান সরকারই করতে পারে। সরকার শপথ অনুযায়ী অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে যদি ন্যায়দ- প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাহলে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সঙ্গত ভূমিকা পালন না করে পারে কি? আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি যে, সরকারের ভ্রান্ত নীতির কারণে যখন দলীয় সংকীর্ণতা কিংবা দলবাজি প্রশ্রয় পায়, তখন সুযোগ সন্ধানীদের মধ্যে অপরাধ সংঘটনের ব্যাপারে বেপরোয়া মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। এমন পরিস্থিতিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও পেশাগত দায়িত্ব পালনে শিথিলতা প্রদর্শন করে। অনেক ক্ষেত্রে হাওয়া যেদিকে সেদিকে চলার চেষ্টা করে। বর্তমানে আমরা অপহরণ ও গুমের যে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি লক্ষ্য করছি, তার মূলে রয়েছে ন্যায়দ- প্রতিষ্ঠার বিপরীত পরিবেশ। প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তথা সরকার এর দায় এড়াতে পারে না। সরকার যদি পরিস্থিতির গভীরতা উপলব্ধি করতে পারে, তাহলে ক্ষমতার রাজনীতিকে অবজ্ঞা করে জনগণের জানমাল ও ইজ্জ্বতের নিরাপত্তা বিধানের কাজকেই এখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার কথা। সরকার গণ-আকাক্সক্ষার অনুকূলে পথ চলে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন