রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৪

তোরা যে যা বলিস ভাই

কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গান : তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই।এরই আদলে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার একটি আপ্তবাক্যকে যেন অলঙ্ঘনীয় বলে গ্রহণ করেছে। আর সেই আপ্তবাক্যটি হচ্ছে : তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার ক্ষমতায় থাকা চাই।অন্তরে এ স্লোগান বাজিয়ে বর্তমান সরকার যেন ধেয়ে চলেছে সামনের দিকে। ভাবটা যেন এমন, আর যা থাকে কপালে, যত কূটকৌশলেই হোক হোক অগণতান্ত্রিক, হোক তা জনগণের চাওয়া-পাওয়াবিরোধী কোনো উপায় অবলম্বন, তবুও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় থাকতেই হবে।
বর্তমান সরকারের পূর্ববর্তী পাঁচ বছর মেয়াদে সব মহল থেকে দাবি ওঠে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে, দলীয় সরকারের অধীনে নয়। সরকার সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে দেশে চালু করা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের প্রেক্ষাপটে এ দাবি রাজনৈতিক অঙ্গনে জোরালো হয়। তখন বিভিন্ন জরিপে স্পষ্ট আভাস আসতে থাকে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের ভরাডুবি হবে। আর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠনের সুযোগ পাবে। এমনই অবস্থায় তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার ক্ষমতায় থাকা চাইনীতির ধারক আওয়ামী লীগ স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে কিছুতেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে দেয়া যাবে না। অতএব, যে করেই হোক দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। এ জন্য সরকারকে যত কঠোরই হতে হয়, সরকার তাতে পিছপা হবে না। এটাই তখন হয়ে ওঠে সরকারের ধনুকভাঙা পণ। ফলে দেশ-বিদেশের সব মহলের মতামত উপেক্ষা করে বিরোধী দলের ওপর প্রবল দমনপীড়ন অব্যাহত রেখে ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচন সম্পন্ন করে এ সরকার। নির্বাচনের ঠিক আগে সরকারি দলের নেতানেত্রীরা বারবার বলেছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী একটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। এ নির্বাচনের পর সব মহলের সাথে সমঝোতা করে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা হবে; কিন্তু বিরোধী দল দৃশ্যত সে নির্বাচন শতভাগ প্রতিহত করতে পারেনি সত্য, তবে এক অর্থে বিরোধীদলীয় জোটের নির্বাচন বর্জনে জনগণ কার্যত সাড়া দেয়। আমরা দেখেছি, ৩০০ আসনের ১৫৩টিতে প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো প্রার্থী পাওয়া যায়নি। বাকি আসনগুলোতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী পাওয়া গেলেও এসব প্রার্থী ছিলেন কার্যত সরকারি জোটেরই কোনো না কোনো দলের প্রার্থী আর জোর করে নির্বাচনে যেতে বাধ্য করা ছিন্নভিন্ন জাতীয় পার্টির একাংশের প্রার্থী। বিভিন্ন দলনিরপেক্ষ মহল মনে করে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ১০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি। সে বিবেচনায় বলা যায়, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সর্বতোভাবেই ছিল জনগণের প্রত্যাখ্যাত একটি নির্বাচন। ভোটারবিহীন এই একতরফা নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতানেত্রীরা এখন থেমে থেমে হুঙ্কার ছাড়ছেন এ সরকার পুরো পাঁচ বছর মেয়াদে ক্ষমতায় থাকবে। এর আগে কোনো নির্বাচন নয়। তা ছাড়া পাঁচ বছর পরের সে নির্বাচনও করতে হবে শেখ হাসিনার সরকারের অধীনেই। ৫ জানুয়ারির পর বিরোধী দল যখন প্রত্যাশা করছে, সরকার জনমনে বিবেচিত বিরোধী দল বিএনপির সাথে আলোচনার মাধ্যমে শিগগিরই সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের আয়োজন করবে সরকার, একই সাথে জনগণও সে প্রত্যাশাই করছে তখন সে পথে না গিয়ে সরকার পাঁচ বছর পর নির্বাচন দেয়ার কথা প্রচার করে চলেছে। এর ফলে সরকার আবারো দেশকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলেই মনে হয়।
কেউ কেউ বলছেন, এবার সব দলের অংশগ্রহণে দ্রুত আরেকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন না দিয়ে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার একগুঁয়েমি প্রদর্শনের মূল কারণ এবারো সরকার ধরেই নিয়েছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলে সরকারি জোটের নির্বাচনী ভরাডুবি ঘটবে। আর বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট নিশ্চিত ক্ষমতায় চলে আসবে। অতএব, ‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার ক্ষমতায় থাকা চাইমন্ত্রে দীক্ষিত বর্তমান সরকারি জোট ৫ জানুয়ারির নিয়ম রক্ষার বহু বিতর্কিত নির্বাচনের পরও নতুন নির্বাচন না দেয়ার অনড় অবস্থান নিয়েছে। সরকারের ধারণা, এই পাঁচ বছর বিরোধী দলের ওপর কঠোর দমনপীড়ন চালিয়ে পাঁচ বছর পার করে ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি দলীয় নির্বাচনের সংস্করণের উপহার দেবে। কারণ সরকার এরই মধ্যে উপলব্ধি করতে পেরেছে, সদ্যসমাপ্ত উপজেলা নির্বাচনে প্রমাণ হয়েছে জনস্রোত কোন দিকে। আর এরই মধ্যে সুস্পষ্ট জনধারণা সৃষ্টি হয়ে গেছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের বিজয় কোনো মতেই ঠেকানো যাবে না।
এ কারণেই হয়তো সরকারি দলের নেতাকর্মীরা নানা ধরনের অযৌক্তিক কথাবার্তা এখানে-সেখানে বলে বেড়াচ্ছেন। আর পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার মতো অন্যায় কৌশল খুঁজছে এ সরকার। সরকারের এই পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার প্রবণতা যখন বাড়ছে, তখন দেশের সচেতন মহল যেমন এ ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছে, তেমনি বিদেশী শক্তিগুলোও নানাভাবে সরকারকে সতর্কবাণী পাঠাচ্ছে। কিছু দিন আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিনিধিরা সরকারকে জানিয়ে গেছেন, ৫ জানুয়ারি নির্বাচন প্রশ্নে ইইউর পুরনো অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এরা মনে করেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল ভোটারবিহীন ও প্রতিদ্বন্দ্বীহীন একতরফা নির্বাচন। এতে জনগণ ভোটাধিকার বঞ্চিত হয়েছে। এতে সব দলের অংশগ্রহণ ছিল না। এ নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলনও নেই। অতএব ইইউ চায় যথাশিগগির সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এ দিকে গত ১৭ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া এক ভাষণে উল্লেখ করেন রাজনীতিতে সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। তাই সব দলের অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশকে অব্যাহতভাবে চাপ দিয়ে যাচ্ছে।
এর পরও আমরা দেখছি, আমাদের সরকারি দল বা জোটের একলা চলোর নীতি সময়ের সাথে শুধু বেড়েই চলেছে। এই নীতির প্রতিফলন দেখতে পাই সব দলের অংশগ্রহণের একটি নির্বাচনের ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সরকার এখন পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার স্বপ্নলোকে বিচরণ করছে। আর এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের একমাত্র অবলম্বন হিসেবে সরকার স্বৈরতান্ত্রিক আচরণকে হাতিয়ার করে নিয়েছে। তবে এর সমালোচনা দেশের ভেতরে ক্রমেই প্রবল আকার ধারণ করছে। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস কাবে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে দেশের বিশিষ্টজনেরা মন্তব্য করেছেন দেশে বর্তমানে গণতন্ত্রের নামে ফ্যাসিবাদ চলছে। আওয়ামী লীগ মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বললেও কার্যকলাপে দলটি মুক্তযুদ্ধের মূল চেতনার পরিপন্থী। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা গণতন্ত্রহত্যা করে সরকার ফ্যাসিবাদী আচরণ করছে। এই ফ্যাসিবাদের সাথে শুধু হিটলার ও মুসোলিনির সময়ের তুলনা চলে। এ গোলটেবিলে আলোচনায় অংশ নিয়ে গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী সরকারের প্রবল সমালোচনা করে বলেন, গায়ের জোরে ক্ষমতায় থাকা যায় না। স্বৈরাচারী আচরণ করে কেউ ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ভোটারবিহীন নির্বাচনে যে জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, সেখানে দেশ ও জনগণের উন্নয়নের কথা না বলে, কে কার বিরুদ্ধে কতটুকু কুৎসা রটনা করতে পারেন, সে প্রতিযোগিতা চলছে। প্রবাসী শ্রমিকদের ঘামে অর্জিত পয়সা দিয়ে সরকার কুইক রেন্টালের নামে পকেট ভারী করছে। এ অবস্থা চলতে পারে না। দেশের মানুষ আজ পরিবর্তন চায়। কবি ফরহাদ মজহার বলেনÑ দেশে আজ স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই। গুম ও অপহরণ ক্রমেই বাড়ছে। কেউ নিরাপদ নয়। আমরা অদ্ভুত এক দেশে বাস করছি। বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা আরেক দেশের লোককে আমার দেশ থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের কোনো অনুমতি লাগে না। স্বাধীন কোনো দেশে এটি কল্পনা করা যায় না। এভাবে চলতে পারে না। দেশ-বিদেশের কেউ এ সরকারকে গণতান্ত্রিক সরকার বলে মনে করে না।
এর পরও গত বৃহস্পতিবার আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী তার মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বললেন, পশ্চিমাদের সুর এখন নরম হয়ে এসেছে, সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন সরকার এগিয়ে চলেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। সব কিছু ঠিকঠাক মতো চলছে। তা হলে অসুবিধাটা কোথায়? তিনি আরো বলেন, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় জোটসহ বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জন করেছে। ১৫৩ আসনে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। বাকি আসনগুলোতে দুর্বল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। সবল প্রতিদ্বন্দ্বীরা না এলে কী করার আছে?
পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলছেন দেশে সব কিছু ঠিকঠাক মতো চলছে, তখন দেশের মানুষ দেখছে ভিন্ন চিত্র। এরা মনে করে, দেশে এখন চলছে গণতন্ত্রহীন দুঃসহ অবস্থা। এখানে মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই। সরকার ফ্যাসিবাদী কায়দায় বিরোধী দলের ওপর অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে দমনপীড়ন। হত্যা, খুন, গুম এখন আমাদের নিত্যসাথী। দেশ পরিণত হয়েছে ভোট ডাকাতি ও ভোট জালিয়াতির দেশে। দেশের মানুষ হারিয়েছে ভোটের অধিকার। মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এর পর কি আমরা বলব, দেশ ঠিকঠাক মতো চলছে এবং আগামী পাঁচ বছরই এমনটি চলবে।
আসলে সরকার এখনো দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, আওয়ামী লীগ অযাচিত নানা কার্যকলাপের মাধ্যমে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অতএব, নির্দলীয় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে এ সরকারকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হবে। বিগত উপজেলা নির্বাচন থেকে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সে ধারণা আরো পাকাপোক্ত হয়েছে। তাই শেষ দিকের কয়েক দফা নির্বাচনে ভোট ডাকাতিই ছিল নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার সরকারি দলের একমাত্র পাথেয়। এসব নির্বাচনে ভোট ডাকাতি কোন পর্যায়ে কী মাত্রায় চলেছে, তা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। এর মাধ্যমে কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করা হয়নি? অথচ এদের মুখ থেকে শুধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথাই বেশি আসে। এখন হয়তো চেষ্টা চলছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাম ভাঙিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতি জন-আস্থা ফিরিয়ে আনার; কিন্তু যে দল আজ এক এক করে দেশ থেকে গণতন্ত্রের সব চিহ্ন মুছে দিয়ে নানা অগণতান্ত্রিক ছলচাতুরীর মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়, তাদের দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কিংবা সুরক্ষা হওয়ার নয়, যদিও এ দলই ছিল মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী একটি দল। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা দেখে ভাবতে অবাক লাগে, এ দলই এক সময় ছিল মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী একটি দল।
সম্প্রতি কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের ৪৩ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক আলোচনা সভার আয়োজন করে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিদেশের মাটিতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী কলকাতা মিশনের তৎকালীন উপ-হাইকমিশনার মরহুম এম হোসেন আলীর পরিবারের দুজন সদস্য তার মেয়ে জলি আহমেদ এবং ভাইপো হাবিবুল্লাহ হাবিবসহ অন্যান্য আমন্ত্রিত অতিথি নির্ধারিত সময়ের কাছাকাছি সময়ে অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হন। প্রধান অতিথি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অন্য অতিথিদের আসন গ্রহণের পর শুরু হয় বক্তৃতাপর্ব। হোসেন আলীর ভাইপো তার বক্তব্যে চাচার স্মৃতিচারণ করেন। একপর্যায়ে তিনি তার চাচার মৃত্যু (১৯৮১ সালের ২ জানুয়ারি) এবং সেই ঐতিহাসিক কাজের স্বীকৃতি পেতে সরকারের বিভিন্ন দফতরে ধরনা দেয়ার বিবরণ দেন। তিনি তার বঞ্চনার কথাও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, হোসেন আলীর ওই ঐতিহাসিক অবদানের কথা অনেকেই জানেন না। তার জীবদ্দশায় কেউ এটি স্বীকারই করতে চাইতেন না। স্বীকৃতিটুকু আদায়ে পররাষ্ট্র দফতরের মন্ত্রীসহ অনেকের কাছে ধরনা দিয়েছি। স্বীকৃতি তো দূরে থাক, ন্যূনতম ভালো ব্যবহার পর্যন্ত পাইনি। অভিযোগকারীর কথা শেষ না করতেই তাকে থামিয়ে দেন পররাষ্টমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী। তিনি সেই সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন না, আজ কেন সে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে তা তিনি জানতে চান। মন্ত্রীর জিজ্ঞাসার জবাব দিতে কথা শুরু করলে আবারো তাকে থামিয়ে দেয়া হয়। জনাকীর্ণ এই আয়োজনে পররাষ্ট্র দফতরের সব স্তরের কর্মকর্তা ও সাবেক কূটনীতিকেরা উপস্থিত ছিলেন। পরে অবশ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে দুঃখ প্রকাশ করেন। এই হচ্ছে আমাদের সরকারের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনের একটি নমুনা।
দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রথম দিকে কলকাতায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে এম হোসেন আলী সর্বপ্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে এ দেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে রীতিমতো উৎসাহিত করেছিলেন। তাকে নিয়ে আজ যে অভিযোগের কথা শুনছি, তা শোনার কথা নয়। বিশেষ করে যখন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটি রাষ্ট্রক্ষমতায় এবং যেখানে দলটির নেতাকর্মীদের দাবি এটিই এ দেশের একমাত্র দল, যেটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক। কোনো কোনো নেতা খোলামেলা বলে ফেলেন বাকি সব দল স্বাধীনতার বিরোধী। যদি তাই হয় তবে এমনটি কেন হলো? জানি না, হোসেন আলী আওয়ামী লীগের কেউ ছিলেন না বলেই কি তার ন্যায্য স্বীকৃতি আজো তিনি পাননি।
আসলে আওয়ামী লীগ এমন একটি দল, যা বিরোধী ব্যক্তি, দল, মত কখনো সহ্য করতে পারে না। এর জায়মান উদাহরণ হচ্ছে প্রথিতযশা সাংবাদিক ও সাবেক সংসদ সদস্য এবিএম মূসার জাতীয় সংসদ চত্বরে  নামাজে জানাজা না হওয়ার বিষয়টি। এবিএম মূসা এমন একজন সাংবাদিক ছিলেন, যাকে সারা দেশের মানুষ এক নামে চিনত। তার সাহসী উচ্চারণ তাকে করে তোলে জাতীয় মুরব্বি, জাতীয় বিবেক। তার কলম সচল ছিল ৬০ বছর। শেষজীবনে ছিলেন টকশোর জনপ্রিয় আলোচক। টকশোর মাধ্যমে তার যৌক্তিক বক্তব্য তাকে সাংবাদিক পরিচয় ছাপিয়ে করে তুলেছিল জাতীয় বিবেক। স্বাভাবিক কারণেই বর্তমান সরকারের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের প্রবল সমালোচক ছিলেন তিনি। যদিও ১৯৭৩-এর সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ থেকেই। অথচ সেই আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে সরকারের চুশূলে পরিণত হন তিনি। যার ফলে একজন সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি জাতীয় সংসদে জানাজা পাওয়ার সুযোগটিও পাননি। পত্রপত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, ওপরের নির্দেশে তার সংসদে জানাজার কর্মসূচি বাতিল করা হয়। তাই অভিযোগ ওঠে, সরকার এবিএম মূসার প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে।
সরকারের অসহিষ্ণু আচরণ আওয়ামী লীগের মতো জনসংশ্লিষ্ট দলকে আজ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। কেন এ  দলের মনোভাব এমন হয়ে উঠল? কেন এ দলের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদী আচরণের অভিযোগ উঠবে? ‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার ক্ষমতায় থাকা চাই।’ -এমন মনোভাব কেন এ দলকে পেয়ে বসবে? এটি জনগণের দল বলে খ্যাত পরিচয়টি কেন হারিয়ে ফেলবে? এসব প্রশ্ন দেশের মানুষের  দলটির নেতানেত্রীদের কাছে।


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads