সম্প্রতি অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচন নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও তত্ত্বাবধায়কের আবশ্যকতা প্রমাণ করেছে। একই সঙ্গে শক্তিশালী ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একান্ত আবশ্যক বলে মত দিয়েছেন বিবিসি বাংলা সংলাপের প্যানেল আলোচকরা। রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত বিবিসি বাংলা সংলাপের আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চৌধুরী মাহমুদ হাসান ও বাংলাদেশ অ্যালায়েন্স ফর উইমেন লিডারশিপের নির্বাহী পরিচালক নাসিম ফিরদৌস। বিবিসি বাংলা সংলাপের ৬৬তম পর্বটি উপস্থাপনা করেন সাংবাদিক আকবর হোসেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে এক দর্শকের প্রশ্নের জবাবে নজরুল ইসলাম খান বলেন, উপজেলা নির্বাচন প্রমাণ করে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন আদৌ সম্ভব নয়। তবে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা হয়তো চিরদিন থাকবে না। যে পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ না আসে সে পর্যন্ত এর বিকল্প নেই। তিস্তা নদীর ন্যায্য হিস্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন তিস্তার পানি পাওয়ার কোন সম্ভাবনা দেখছি না। এ জন্য দ্বিপক্ষীয় আলোচনাই শুধু যথেষ্ট নয়। ভারতকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। জামায়াত নিষিদ্ধ প্রসঙ্গে নজরুল ইসলাম খান বলেন- একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মনে করি একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াতের ক্ষমা চাওয়া উচিত। কিন্তু আপোষ করতে যদি রাজি হয় তাহলে সরকারের তরফে বোধহয় জামায়াত নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন হবে না। ২৬শে মার্চ লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা জাতীয় সংগীত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রেকর্ডের পেছনে ছোটা কাক্সিক্ষত নয়। ঐদিন অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবার কথাই বলা হয়েছে কিন্তু কোন মুক্তিযোদ্ধার কথা বলা হয়নি। এবিষয়টি দুঃখজনক।
ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচনে গেলে রাজনৈতিক দলগুলো বলবে নির্বাচনে সূক্ষ্ম ও স্থুল কারচুপি হয়েছে। আমার প্রশ্ন এর শেষ কোথায়? তার চেয়ে নির্বাচন কমিশন কিভাবে শক্তিশালী করা যায় সেই নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা হতে পারে। তিনি বলেন, তিস্তা নদী নিয়ে বর্তমান সরকারের কোন অনিচ্ছা ও ভারতপ্রীতি নেই। পানিসম্পদ মন্ত্রী হিসেবে আমি নেগোশিয়েট করি দিল্লিকে, মমতাকে নয়। আমাদের পানি চাই- ন্যায্য হিস্যা চাই।
ড. চৌধুরী মাহমুদ হাসান বলেন, ভারত আমাদের বড় প্রতিবেশী। তিস্তার ন্যায্য হিস্যা নিয়ে কোন সমস্যা থাকলে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে তা সমাধান করা যেতে পারে। তিনি বলেন- গণতন্ত্রে পরমতসহিষ্ণুতা দরকার। কোন রাজনৈতিক কারণে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা ঠিক হবে না।
প্যানেল আলোচক নাসিম ফিরদৌস বলেন- তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা আসলেই যে রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হবে আমি তা মনে করি না। আগে গণতন্ত্রের চরিত্র পাল্টাতে হবে। তিস্তার পানির হিস্যার বিষয়ে তিনি বলেন- গিভ অ্যান্ড টেকের ভিত্তিতে আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তিনি বলেন, উপজেলা নির্বাচনে ভাল ফলাফলের জন্য সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে চাইছে- বিষয়টি এমন নয়। আর মুখের কথায় জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে দিলেই তাদের সহিংসতা শেষ হয়ে যাবে এর নিশ্চয়তা কোথায়?
বলা বাহুল্য, বিবিসি সংলাপে অংশ নেয়া ব্যক্তিবর্গের বক্তব্যে অন্যান্য ইস্যু ও বিষয়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণভাবে উঠে এসেছে নির্বাচন কমিশন প্রসঙ্গ। আরেকটি খবর হুবহু তুলে দিলে নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে আরও জানা সম্ভব হবে। খবরটি একটি সহযোগী দৈনিক থেকে সংগৃহীত। পত্রিকাটি লিখেছে : “বিএনপি নাকে খত দিয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আব্দুল মোবারক। গত রোববার বিকাল সাড়ে ৩টায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা বলেন। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচন কমিশনকে সরকারের আজ্ঞাবহ দাবি করে পদত্যাগের আহবান জানিয়েছিলেন। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে মূলত দায়িত্বপ্রাপ্ত সিইসি এ প্রতিক্রিয়া দেন। প্রধান বিরোধী জোট জাতীয় নির্বাচন বর্জন করায় অর্ধেকের বেশি আসনে নির্বাচনই হয়নি। এরপর উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াত অংশ নেয়ায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও দলের নেতারা বলে আসছিলেন বিএনপি নাকে খত দিয়ে নির্বাচনে এসেছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সিইসিও তাদের সুরেই প্রতিক্রিয়া জানালেন।
তিনি চতুর্থ ধাপের উপজেলা নির্বাচন সুষ্ঠু হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই কমিশনারের পদত্যাগ দাবি করছে বিএনপি। অথচ এ কমিশনের অধীনেই তারা নাকে খত দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। তিনি বলেন, আমরা কিছুই না হতে পারি, জিরোও হতে পারি কিন্তু সেই জিরোর অধীনেই তারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। তাহলে কি নাকে খত দিয়ে অংশ নেওয়া হলো না? নির্বাচনী সহিংসতা নিয়ে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে যারা সহিংসতা বা অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত থাকবে তাদেরকে ছাড় দেয়া হবে না। নির্বাচনের পরও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সহিংসতার জন্য নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারকে দায়ী করেন তিনি। এসময় অপর তিন নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ, জাবেদ আলী ও শাহনেওয়াজ উপস্থিত ছিলেন।”
এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করা নি®প্রয়োজন। তবে কেউ কেউ লিখিতভাবে মতামত জানাতে পিছ পা হচ্ছেন না। একজন কলামিস্ট যথার্থই লিখেছেন : “আমাদের মন্ত্রীরা একটু বেশি বলেন-এটা পুরনো কথা। কিন্তু এখন এই দৌড়ে যোগ দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনারগণ। শুধু তাই নয়, রীতিমতো চ্যাম্পিয়ন হতে যাচ্ছেন তারা। বিদায়ী বছরের সেপ্টেম্বরে বিরোধীদলীয় নেতা বেশকিছু ভাষণে নির্বাচন কমিশনকে অথর্ব ও মেরুদ-হীন বলেছেন। কিন্তু প্রতিক্রিয়ায় সম্মানিত কমিশনার জাবেদ আলী সাংবাদিকদের চটুল রসিকতাসহ এর জবাব দিয়েছেন। বিরোধী নেতার পাল্টা জবাবে ৬৩ বছরের জাবেদ আলী মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে যান। সাংবাদিকরা তখনও বুঝতে পারেননি এর অর্থ কি? অল্পক্ষণ পরেই তিনি সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে মেরুদ- প্রদর্শন করে বলেন, আমার বয়স ৬৩ বছর। মেডিকেল রিপোর্টে আমি ওই রকম রোগী নই। কোন ব্যথা অনুভব করছি না। এত বয়স হয়েছে, ডাক্তার কখনো ওকথা বলেনি। আমার কোমর সোজাই আছে, অসুবিধা নেই। একই সঙ্গে তিনি সিইসি সহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের মেরুদ-ও সোজা বলে দাবি করে বলেন, ৫ সদস্যের কমিশনে তিনিই সর্বকনিষ্ঠ। এখানে সবচেয়ে কম বয়স আমার। আমার যদি মেরুদ- সোজা থাকে, অন্যদের আরো বেশি সোজা। উপজেলা নির্বাচনের তৃতীয় ধাপে ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার সহিংসতা ও তিনজন নিহতের ঘটনায় স্বস্তি ও শান্তির কথা শোনালেন। বললেন, আলহামদুলিল্লাহ,। আমরা সন্তুষ্ট। আল্লাহর মেহেরবানী, মাত্র ৩ জন প্রাণ হারিয়েছে। আরও বেশি মারা যেতে পারতো। তা হয়নি। প্রতি মিনিটে ১৩/১৪টি ভোট দেয়া স্মার্টনেসের পরিচয় বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। চতুর্থ ধাপের সহিংসতা ও হানাহানি, ভোট জালিয়াতির খবরেও তিনি আলহামদুলিল্লাহ বলে সন্তুষ্টি ব্যক্ত করেছেন মিডিয়ায়। অথচ তৃতীয় ধাপে ১৫ই মার্চের নির্বাচনে গায়েবি ভোটে অনেক এলাকাতেই বাক্স ভরে গেছে। তা গণমাধ্যমে প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদন দেখলেই বোঝা যায়। অন্যদিকে, অল্প সময়ে বেশি ভোটের হিড়িক পড়ার দৃশ্যও দেখা গেছে বিভিন্ন কেন্দ্রে। চাঁদপুরে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের বাড়ির পাশের কেন্দ্রে দেখা গেছে মিনিটে ৬ ভোট পড়তে। অন্যদিকে বরিশালে ছাত্রলীগের এক নেতা একাই ৪০০ ভোট দিয়েছেন। যদি ভারপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনারের ভাষায় এটা স্মার্টনেসের পরিচয় হয় তাহলে কি বলার আছে? ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকেই অদ্ভুত এক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের। পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের পর সরকার প্রধান থেকে শুরু করে বিভিন্ন মহলে বলাবলি ছিল, এই কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব কিনা তা নিয়ে। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে তা বলে দিলো কমিশন নিজেই। যেখানে ৫ ভাগ ভোটও পড়েনি তা দেখানো হলো সরকারের চাহিদা অনুযায়ী ৪০ ভাগের ওপরে। কিন্তু এত কিছুর পর কমিশনের অর্জন আসলে কি? উপজেলা নির্বাচন প্রথম দফায় বিএনপি সমর্থিত জোট এগিয়ে থাকায় গাত্রদাহের শুরু। দ্বিতীয় দফাতে সহিংসতা আর কারচুপি, তৃতীয় দফায় গায়েবি ভোট আর ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নেয়ার উৎসব। চতুর্থ দফায় আরও ভিন্ন কৌশল। রাতেই বেশির ভাগ উপজেলায় ব্যালট বাক্সে ভোট ভরে রাখলো সরকার দলীয় কর্মীরা। সকালেই ঘুম থেকে ওঠেই খবর মিললো দক্ষিণাঞ্চলের আগৈলঝাড়া থেকে। রাতের অ াঁধারেই তারা ভোট শেষ করেছে। প্রভাতের আলোতেই সেখানে ভোট শেষ হয়েছে। এখানে এতো বেশি স্মার্টনেস দেখিয়েছে সরকার সমর্থিতরা। যা সত্যিই বিস্ময়কর। এখানের এক কেন্দ্রে আধঘণ্টায় পড়েছে ১৮০০ ভোট। এমন কিছু কেন্দ্রও দেখা গেছে, কারা পোলিং এজেন্ট, কারা প্রিজাইডিং অফিসার বোঝা মুশকিল। সবাই একতালে সিল মারছে পছন্দের প্রার্থীকে। কি অদ্ভুত কিসিমের কমিশনের অধীনে নির্বাচন পরখ করছে দেশবাসী। অভিনন্দন জানাতে হয়, মাননীয় সিইসি সহ অন্য চার কমিশনারকে নিয়ে। ওনারা আজিজ কমিশনের রেকর্ড ইতিমধ্যেই ভেঙে তছনছ করে দিয়েছেন।”
একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের অংশগ্রহণমূলক সংলাপ, একটি খবর এবং একটি মতামতের অংশ বিশেষ উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা হলো। নির্বাচন কমিশন স্বীয় কর্মকা- ও বক্তব্যে হররোজ আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছে। এখানে নতুন কোনও মন্তব্য আর যোগ করা হলো না। সব দেখে-শুনে পাঠকই নিজস্ব মত-প্রকাশের সাংবিধানিক স্বাধীনতার আওতায় এই নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে কি বলবেন বা মন্তব্য করবেন, সেটা ভালো বুঝবেন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন