রবিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৪

বাংলা পঞ্জিকার পয়লা বৈশাখ


এ লেখাটি যখন লিখছি, দিনটি বৃহস্পতিবার ২৭ চৈত্র ১৪২০, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৩৫, ১০ এপ্রিল ২০১৪। বাংলা, হিজরি ও গ্রেগরিয়ান তিনটি বর্ষপঞ্জিই আমাদের দেশজ সংস্কৃতির ওপর সমানভাবে প্রভাব বিস্তার করে আছে। বাংলা সনের মাসগুলো আমাদের গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত ঋতুচক্রের আগমন-নির্গমনের মধ্য দিয়ে দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। ছায়ানট-উদীচীর নটনটীরা রবীন্দ্রনাথের গান পরিবেশনের মাধ্যমে ঋতুবরণকরুক বা না করুক বিধাতার অমোঘ বিধানে প্রাকৃতিক নিয়মে ঋতু পরিবর্তন হবেই। এর প্রভাব পড়বে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-ভাষা নির্বিশেষে এ দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর ওপর। হিন্দু সম্প্রদায়ের যাবতীয় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, পূজা-পার্বণ, উৎসব উদযাপিত হয়ে থাকে বাংলা সনের পঞ্জিকা অনুযায়ী। চৈত্রের শেষ দিনটিতে পালন করা হয়ে থাকে চৈত্রসংক্রান্তি। পূজা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তারা বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সূচনা করে থাকে। ছায়ানটের শিল্পীরা রমনা বটমূলে রবীন্দ্রনাথের গান এবং ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবরে মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বলনের মধ্য দিয়ে নববর্ষ উদযাপনের সূচনা করে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা

হিজরি বর্ষপঞ্জির প্রতিটি মাসের প্রভাব বিশ্বব্যাপী প্রধানত মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় বিধিনিষেধ, উৎসব অনুষ্ঠান পালনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত।
 
মোগল শাসনের ৭০০ বছরে এ উপমহাদেশের শাসনকার্য পরিচালিত হয়েছে হিজরি সাল অনুযায়ী এবং তখনকার রাষ্ট্রভাষা ছিল ফারসি। মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পর ১৯০ বছর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং ব্রিটিশ শাসনামলে শাসনকার্য চলত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। তাদের রাষ্ট্রভাষা ছিল ইংরেজি। ব্রিটিশরা উপমহাদেশ ছেড়ে চলে গেলেও শাসনকার্য পরিচালিত হতে থাকে তাদের প্রবর্তিত ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাজে ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য এখনো বিদ্যমান। সব অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। সর্বক্ষেত্রে ইংরেজির প্রাধান্য এখনো দৃশ্যমান।
মোগল বাদশাহ আকবর রাজকার্য পরিচালনার ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য, কৃষিকাজে সম্পৃক্ত প্রজাকুলের কাছ থেকে রাজকর আদায়ের সুবিধার্থে তারিখ-ই-ইলাহীবা ফসলী সনউদ্ভাবনের জন্য সে সময়ের পণ্ডিত, বিজ্ঞানী এবং জোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজীকে নির্দেশ দেন। আকবরের নবরতœ সভার সদস্য এবং পণ্ডিত আবুল ফজলের আকবরনামাথেকে জানা যায়, কৃষকদের জন্য হিজরি সাল অনুযায়ী খাজনা নির্ধারণকে প্রজাহিতৈষী আকবর অন্যায় কাজ বলে বিবেচনা করতেন। কারণ, ফসল উৎপাদিত হয় সৌরসাল অনুযায়ী, অথচ খাজনা নির্ধারণ করা হতো চান্দ্রসনের ভিত্তিতে। দেখা যায়, প্রতি ৩১ চান্দ্রসন প্রায় ৩০ সৌরসনের সমান।
৯৯২ হিজরি (১৫৮৪ খ্রি:) আবুল ফজল ফসলি সনের ফরমান জারি করেন। এতে উল্লেখ করেন, বাদশাহ আকবরের সিংহাসনারোহণকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ৯৬৩ হিজরির প্রথম মাস মহররম থেকে তারিখ-ই-ইলাহীর সময় গণনা শুরু হবে। তখনো বঙ্গে শকাব্দচালু ছিল এবং এর প্রথম মাস ছিল চৈত্র। ৯৬৩ হিজরির মহররম মাসে শকাব্দের বৈশাখ মাস মিলে যাওয়ায় এ ফরমানে তারিখ-ই-ইলাহীর বর্ষ শুরুর মাস বৈশাখকে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। সে থেকেই চৈত্রের পরিবর্তে বৈশাখেই বাংলা নববর্ষের সূচনা।
গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের মতো বাংলা সনেও ৩৬৫ দিন গণনা করা হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে আসতে পৃথিবীর সময় লাগে ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড। সময়ের এ ব্যবধানকে ঘুচানোর জন্য গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে প্রতি চার বছর অন্তর ফেব্রুয়ারি মাসে লিপ ইয়ার হিসেবে এক দিন যোগ করা হয়ে থাকে। আগে এ নিয়মটি ছিল না। বাংলা সনের সাথে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সমন্বয় করার জন্য জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে প্রধান করে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটি ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সালে বাংলা সনের নি¤œবর্ণিত সংস্কার সাধন করে
১. বছরের প্রথম পাঁচ মাস, বৈশাখ থেকে ভাদ্র পর্যন্ত প্রতিটি মাস গণনা করা হবে ৩১ দিন।
২. বাকি সাতটি মাস, আশ্বিন থেকে চৈত্র পর্যন্ত প্রতিটি মাস গণনা করা হবে ৩০ দিন।
৩. গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের প্রতি লিপ ইয়ার বর্ষে বাংলা সনের ফাল্গুন মাসের সাথে অতিরিক্ত একটি দিন যুক্ত হবে (যা ২৯ ফেব্রুয়ারির ১৪ দিন পর)।
এ সংস্কারের ফলে আমরা প্রতি ইংরেজি বছরের ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখ উদযাপন করতে পারছি। সংশোধিত এ বাংলা বর্ষপঞ্জি বাংলাদেশে কার্যকর হয় ১৯৮৭ সালে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা এ সংশোধন গ্রহণ করেননি। বাংলা সনের সাথে হিন্দু সংস্কৃতির নিগূঢ় সম্পর্কের কারণে তারা তাদের পুরনো ক্যালেন্ডারের ভিত্তিতেই ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি উদযাপন করে থাকেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টস ইনস্টিটিউটের কিছু ছাত্র যশোরে গিয়ে চারুপীঠনামে একটি সংগঠন গড়ে তোলে। বাংলা নববর্ষ উদযাপনে মঙ্গল শোভাযাত্রার উদ্বোধন ছিল যশোরে ১৯৮৬ সালে। এর উদ্দেশ্য হিসেবে উদ্যোক্তারা দাবি করেনÑ রঙ-বেরঙের মুখোশ পরে শোভাযাত্রায় অংশ নিলে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ সহজ হবে। চৈত্রের শেষ রাতে যশোর শহরে রঙ-বেরঙের আল্পনা আঁকা হয়েছিল। ভূতপ্রেত, দেও-দানবের মুখোশ, ফুল-পাখি ও বাঘের রেপলিকা ব্যবহার করা হয় সেই শোভাযাত্রায়। ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৮৮ সালে প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয় বলে শোনা যায়। এতে ব্যবহৃত হয় শিল্পীদের তৈরী দশটি ছোট আকৃতির ঘোড়া, একটি বৃহদাকার হাতি (যাকে হিন্দুরা গণেশবলে পূজা করে থাকে) এবং ৫০টি মুখোশ। এরপর থেকে প্রতি বছর মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়; যাতে ব্যবহৃত হয় লক্ষ্মীপেঁচা, গণেশ, বাঁদর, হনুমান, উল্লুক, পেখম তোলা ময়ূর, রাক্ষস-খোক্ষসের রেপলিকা। দেব-দেবীদের মুখোশ ব্যবহৃত হয়। ঢাক-ঢোল-কাঁসার ঘণ্টার তালে তালে চলতে থাকে নৃত্য ও আনন্দ উল্লাস। শোভাযাত্রার সাথে যোগ হয়েছে এখন বিশেষ মহলের রাজনীতির প্রলেপ ও প্রচারণা।
এ দেশে সাংস্কৃতিক বিপর্যয় চরমে পৌঁছেছে। ভিনদেশী হিন্দির দাপটে বাঙালি শিশুরা এখন বাংলার চেয়ে হিন্দিতে বাতচিত করতে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। দেশী টিভি চ্যানেলগুলো অনেক ক্ষেত্রে অপসংস্কৃতির প্রচার এবং প্রসারের বিনা বাধায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বিদেশী মোবাইল অপারেটররা পাল্লা দিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নামে বিদেশী নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকাদের এ দেশে এনে যেসব অনুষ্ঠান করছে, সেগুলো আমাদের দেশজ সংস্কৃতিকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। কখনো জাতীয় স্টেডিয়ামে, কখনো আর্মি স্টেডিয়ামে প্রতিবেশী দেশ থেকে আগত শিল্পীরা অশ্লীল পোশাক পরে নাচগান করে থাকে, তা সুস্থ রুচি এবং সমাজের জন্য রীতিমতো বিব্রতকর। হিন্দি চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত নাটক, সিনেমা এবং খোলামেলানৃত্যগীত আমাদের দেশজ সংস্কৃতিকে উচ্ছন্নে নিয়ে যাচ্ছে। পারিবারিক শৃঙ্খলা, সামাজিক সৌজন্যবোধ নৈতিকতার স্থলনে দ্রুত পতনোন্মুখ। পয়লা বৈশাখেও অবাধ মেলামেশা হলে তা হবে দেশীয় ঐতিহ্যের পরিপন্থী।

কাজী সাইদ


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads