বাংলাদেশে এখন এমন সব অদ্ভূত কা- ঘটছে, যাতে কখনও কখনও সভ্য এবং শিক্ষিত সমাজ অপমানে আত্মগ্লানিতে অধোমুখ হয়ে পড়েন। এমন সব ব্যক্তি এমন সব প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হয়েছেন, যা কল্পনা করাও দুঃসাধ্য ব্যাপার। সরকার অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংসের একেবারে দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। এমন সব অথর্ব ব্যক্তির হাতে পতাকা তুলে দিয়েছে, যাদের সে পতাকা বইবার ন্যূনতম যোগ্যতা নেই। ফলে সকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এখন বিপন্ন। মানুষের শেষ ভরসার স্থলগুলো ক্রমেই ভরসা হিসেবে বিফল হচ্ছে। জীবন রক্ষার্থে বিপন্ন মানুষ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হতে ভীত-সন্ত্রস্ত। প্রশাসনের প্রতি পদে দুর্নীতিগ্রস্ত লোক। দুদক বিরোধী দলকে ঘায়েল করার হাতিয়ার মাত্র। বিচার পাওয়ার জন্য নিম্ন আদালতের ওপর আর কেউ ভরসা করতে পারছে না। উচ্চ আদালতেও ন্যায় বিচার পাবে, এমন আশাও বড় কম। চতুর্দিকে ভয় আর আতঙ্ক। সন্ত্রাসী, মাস্তান, খুনি, লুটেরা, প্রশাসন-আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গলায় গলায় সখ্য। এ রকমই এক ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়েছে বাংলাদেশের মানুষ।
পুলিশের পাশাপাশি অস্ত্র হাতে সাধারণ মানুষকে তাড়া করে ফিরছে শাসক দলের মাস্তানরা। পৃথিবীর আর কোনো দেশে বোধকরি এ রকম দৃশ্য কল্পনাতীত। যে কেউ যেকোনো কারণে যে কাউকে যেখানে খুশি খুন করে ফেলতে পারছে। প্রতিকারের আশা সূদুর পরাহত। গুম-খুনে গোটা দেশ প্রকম্পিত। আতঙ্কিত। গীবতকার সরকার কর্মের চেয়ে দিনরাত কেবলই অপরের গীবত গেয়ে চলেছে। আর যথেচ্ছ চালাচ্ছে দুর্নীতি। তার বিরুদ্ধে কেউ টু শব্দটি করলেও রেহাই নেই। সরকার ও তার বাহিনী একেবারে হামলে পড়ছে। কিংবা সরকারের কোনো অন্যায় আচরণে সমর্থন না দিলেও তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। অর্থাৎ সরকারের যাবতীয় কুকর্মকে এদেশের জনগণ সমর্থন দিতে বাধ্য। নইলে খবর আছে। বুদ্ধিজীবী সমাজ কেনো সরকারের অপকমের্র সমর্থন দিলো না, তাই নিয়ে মন্ত্রী পরিষদের বৈঠকে তুলকালাম কা- প্রতিনিয়তই ঘটছে। যেনো মন্ত্রিসভার সামনে আর কোনো ইস্যু নেই। জনকল্যাণের চিন্তা নেই। রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন যেনো তাদের ভাবনার বাইরে। বিদেশের সঙ্গে সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটছে। জনশক্তি রফতানি স্থবির হয়ে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার প্রতিনিয়ত সঙ্কুচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাত। সেখানে জনশক্তি রফতানি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে দেশের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে সরকারের সামান্যতম চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। মন্ত্রিসভায় ধিক্কার উঠলো যে, সুশীল সমাজ কেনো ‘জিয়াই বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি’ এমন ঘোষণার প্রতিবাদ করছে না।
দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রের শক্ত ভিত্তি। এই ভিত্তি মজবুত না থাকলে, এই ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়লে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়তে বাধ্য। এসব প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে যাদের বসানো হয়েছে, কখনও কখনও তারা এমন আচরণ করে বসেন যে, বিশ্বাসই হতে চায় না যে এরা শিক্ষিত, সভ্য মানুষ কিংবা এরা কী মাত্রায় নষ্ট পরিবেশ, নষ্টদের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন। তাদের অশালীন, ভব্যতাহীন কর্মকা-ে তাদের বাপ-দাদার শিক্ষা-সংস্কৃতিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। বিচার বিভাগও কখনও কখনও এর আওতার বাইরে নয়। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা একটি জাতির জীবনে আর কিছু হতে পারে না। আমাদের জীবনে এমনই এক দুর্ভাগ্যের কাল।
নির্বাচন কমিশনও এমন একটি স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সে কমিশন এমন লোকদের দিয়ে সাজানো হয়েছে তাদের আচরণে মনে হয়, তারা বোধকরি ছাত্রলীগেরই একটি সম্প্রসারিত ষ-ার দল। তাদের প্রয়োগকৃত ভাষা ও শারীরিক ভাষার মধ্যে শালীনতা তো নেই-ই, যেনো ইতরতাই মুখ্য। তেমন একজন বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনার মো. আব্দুল মোবারক। নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। তিনি তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বললেন ‘আলহামদুলিল্লাহ’। মাত্র দুইজন মানুষ এই নির্বাচনে খুন হয়েছে। নির্বাচনে শত শত ভোট কেন্দ্র দখল হয়ে গেলো। জাল ভোট হলো। নির্বাচনী কর্মকর্তারা ব্যালট পেপারে সীল মারলো। সেসব ছবি পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তিনি বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ’ মাত্র এক শতাংশের ক্ষেত্রে এমনই হয়েছে। নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু হয়েছে।
পাঁচ দফায় উজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম দফা নির্বাচন মোটামুটি উৎসবের পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। তাতে সরকারের দলের ভরাডুবি ঘটে। সরকার মরিয়া হয়ে ওঠে। এমনি করে দ্বিতীয় দফা, তৃতীয় দফা, চতুর্থ দফায় মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে পুলিশ-প্রশাসন আর আওয়ামী লীগের ষ-া মাস্তানরা। নির্বাচনের আগে থেকেই তারা মাইকিং করে ভোটারদের জানিয়ে দিয়েছে, সরকারদলীয় প্রার্থী জিতে গেছেন। ভোটারদের আর ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার দরকার নেই। আর কেউ যদি যায়, তাহলে ভোট দিয়েছে কিনা আঙ্গুল দেখে দেখে তা নিরূপণ করা হবে এবং সে আঙ্গুল কেটে দেয়া হবে। উপরন্তু ভোট দিতে গিয়ে কেউ যদি খুন হয়, তবে সে দায়িত্ব তাকেই নিতে হেব। সরকারদলীয় প্রার্থী সে দায়িত্ব নেবে না। কেউ কেউ আবার ঘোষণা দিয়েছে যে, মাত্র শ’খানেক লোক হলেই চলবে। যারা লাইনে দাঁড়িয়ে দিনভর ভোট দেবে। কেন্দ্রে আর কোনো কাক-পক্ষী ও যাবে না এবং শেষ পর্যন্ত করেছেও তাই। শত শত প্রার্থী নির্বাচনে আচরণ বিধি লঙ্ঘনের এমন অভিযোগ করেছেন। কিন্তু কমিশন এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না দিয়ে বরং আচরণ বিধি লঙ্ঘনের এই ধারা আরও জোরদার করে তুলেছে। আওয়ামী প্রার্থীরা যেভাবে বলেছে, সেভাবে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের অদল-বদল করা হয়েছে। আওয়ামী প্রার্থীদের হারের মুখে কোথাও কোথাও নির্বাচন স্থগিত করেছে। যাতে পরে আরও শক্তি সঞ্চয় করে আওয়ামী প্রার্থীরা বল প্রয়োগের মাধ্যমে নির্বাচনী ফলাফল তাদের অনুকূলে নিতে পারে।
ফলে খুব সঙ্গত কারণেই কমিশনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলসমূহ এবং সুশীল সমাজ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। এরা কমিশনকে মেরুদ-হীন ও অযোগ্য বলে অভিহিত করেছেন। তখন এই কমিশনার মোবারক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলেছেন, কই আমরা মেরুদ-হীন। এই যে দেখেন, আমার মেরুদ- সোজা আছে। একে ভাঁড় ছাড়া বোধকরি আর কিছু বলা যায় না। এ রকম ভাঁড়দেরই ধরে এনে সরকার সাংবিধানিক পদগুলোতে বসিয়েছে। এই কমিশনের প্রধান কাজী রকিবউদ্দিনও আরেক ভাঁড়। কা-জ্ঞাহীন, দায়িত্বজ্ঞানহীন এক অথর্ব তল্পিবাহক। প্রথম দফা নির্বাচনের পর তিনি সপরিবারে শ্রান্তিবিনোদনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন। পত্র-পত্রিকায় দেখলাম, তিনি নাকি পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পদত্যাগ করলে তার প্রভুদের কোনো ঝামেলা হয় কিনা, সেই ভেবে পদত্যাগ না করেই শ্রান্তিবিনোদনে আছেন। পেটে দুই চার অক্ষর বিদ্যা আছে, এমন কেউ বোধকরি এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারতো না। যদি সত্যি সত্যি এই রকিবউদ্দিন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ হতেন, তাহলে পদত্যাগ করতেন। নাটক করতেন না। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ দফা নির্বাচনে সহিংসতা যতো বেড়েছে আওয়ামী লীগ ততো বেশি সংখ্যক আসনে নির্বাচনের জয় কেড়ে নিয়েছে। এই নির্বাচনে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের জন্য এক ধরনের বিপদ ডেকে এনেছে। ফলে সরকার খুব ক্ষুব্ধ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে আওয়ামী নেতা-নেত্রীরা অনেক টিপ্পনী কেটেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জাতীয় ট্রেন মিস করে গোলাপী এখন উপজেলা ট্রেনে উঠেছে। আওয়ামী লীগের সভ্যতা বিবর্জিত নেতারা বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়া ‘নাকে খত দিয়ে, থুথু চেটে’ উপজেলা নির্বাচনে গিয়েছেন।
নির্বাচনী আচরণ বিধি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ইসি কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় সঙ্গত কারণে বিএনপি নেতারা তার সমালোচনা করেছে। শুধু বিএনপি নেতারাই নন, দেশের মিডিয়া, সুশীল সমাজ সবাই নির্বাচন কমিশন নিষ্ক্রিয়তার কঠোর সমালোচনা করেছেন। তার জবাবে নির্বাচনকে আরও সুষ্ঠু করার বদলে এই কমিশনার মোবারক এক নিম্নমানের ইতরজন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কে তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়া নাকি নাকে খত দিয়ে এই উপজেলা নির্বাচনে এসেছে। এই ভাষা আর আওয়ামী ষ-াদের ভাষার মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। নির্বাচনকালে নির্বাচন কমিশনের হাতে ক্ষমতা থাকে সরকারের চেয়েও অনেক উপরে। পুলিশ-প্রশাসন, নিয়োগ-বদলি, পুরস্কার-তিরস্কার সব চলে যায় কমিশনের হাতে। তাদের কথার বাইরে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট এলাকায় কারও কোনো কিছু করার ক্ষমতা থাকে না। এমনকি নির্বাচনের দিন বা তার আগের দিন যখন বিরোধীদলীয় প্রার্থী ও তার সমর্থকদের গ্রেফতার করা শুরু হলো তখন এই ঢিল ছোঁড়া সরকারদলীয় কর্মীর মতো মোবারক বলে বসলেন যে, গ্রেফতার করা পুলিশের কাজ। পুলিশ গ্রেফতার করছে। আমাদের কাজ নির্বাচন করা। আমরা নির্বাচন করছি। পঞ্চম দফা নির্বাচন হয়েছে আরও ভয়াবহ। সেখানে বলতে গেলে কোথায়ও বিরোধীদলীয় প্রার্থীর নেতা-কর্মীদের ঢুকতেই দেয়া হয়নি। এর আগের নির্বাচনগুলোতে নির্বাচন কমিশন সকাল-বিকাল দু’বেলা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। পঞ্চম দফা নির্বাচনের দিন আর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়ার কোনো নৈতিক বলই সম্ভবত তাদের অবশিষ্ট ছিলো না। আর তাই মোবারকসহ সকল কমিশনার পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যান। সাংবাদিকদের সামনে আসেননি। দুই-একজন তাই ঠাট্টা করে মন্তব্য করেছেন, ‘হৈ হৈ রৈ রৈ মোবারক তুই গেলি কই’।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন