এক বন্ধুর আমন্ত্রণে তিস্তা ব্যারাজ
দেখার জন্য গিয়েছিলাম, এলাকায় যা ‘ডালিয়ারপুল’ নামে পরিচিত। গ্রীষ্মকাল ছিল। তবুও পানির স্রোতের কারণে নৌকা চালাতে পারছিলাম
না বলে এক মাঝিকে ডেকেছিলাম।
মেঝো ভাই
যখন লালমনিরহাটে ট্রান্সফার হলেন, তখন সেখানে ডালিয়ারপুলের ওপর দিয়েই যাতায়াত করতাম; কিন্তু বাসের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকতাম বলে এই বায়ান্ন গেটবিশিষ্ট পুল ও তিস্তার
ঐশ্বর্যকে দেখার সুযোগ হারাতাম। একবার আগেই ঘুম ভেঙে গেল। পুলের ওপর থেকে দেখি, নদীর উজান-ভাটি কোনো দিকেই পানি নেই। বিশাল এলাকাজুড়ে বালু আর বালু। শুধু দুই
পাশ দিয়ে সঙ্কীর্ণ নালার মতো পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পুলের মাঝখানে এসে নদীর দিকে তাকাতেই
মনে হলো, বিশাল বাহু কেউ যেন নদীটার ওপর শুয়ে কাঁদছেন। দুই দিকে দুই চোখের
পানি কপোল বেয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর নাক ও কপাল সূর্যের আলোয় চিক চিক করছে। আমার পাশের
সিটে এক ভদ্রলোক ঘুমিয়েছিলেন। তাকে ডেকে বললাম Ñ চাচা, নদীর এ অবস্থা হলো কী করে? তিনি নদীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যারা শিবের মূর্তি বানাতে পারে, তারা রাবণকেও বানাতে পারে’। এর অর্থ না বুঝে তার দিকে চেয়েছিলাম কিছুণ। এবার আপে করে বললেন, দাদারা বাঁধ দিয়ে পানি আটকিয়ে রেখেছেন।
তিস্তা
ব্যারাজ প্রকল্পের নির্মাণ ১৯৭৯ সালে এবং ক্যানেল সিস্টেমে নির্মাণকাজ ১৯৮৪-৮৫ সালে
শুরু হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্রে, এ প্রকল্পের আওতায় উত্তরাঞ্চলের
নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ১২টি উপজেলার এক লাখ ১১ হাজার ৪০৬ হেক্টর
জমিতে সেচ দেয়ার ল্েয ১৯৯৮ সালের জুনে প্রথমপর্যায়ের কাজ শেষ হয়েছে; কিন্তু শুরুর দিকে ৭৯ হাজার হেক্টরে সেচ দেয়া গেলেও পরবর্তী সময়ে সব পরিকল্পনা
বিনাশ করে দেয় প্রতিবেশী রাষ্ট্র। তিস্তায় পানির অভাবে প্রতি বছরেই সেচযোগ্য জমির পরিমাণ
কমে আসছে। গত বছর এ প্রকল্পের আওতায় ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হয়। এ বছর সেচের
আওতাধীন জমির পরিমাণ ৬০ হাজার ৫০০ হেক্টর করা হলেও ২৫ হাজার হেক্টরেও সেচ দেয়া সম্ভব
হয়নি। কারণ ৬০ হাজার ৫০০ হেক্টরে সেচ দিতে কমপে সাড়ে তিন হাজার কিউসেক পানির প্রয়োজন।
এ পরিমাণ পানি কিভাবে পাওয়া সম্ভব?
কেউ কেউ
শ্যালোমেশিন কিনে বোরো চাষ অব্যাহত রাখার চেষ্টা করলেও বিপাকে পড়েছেন সাধারণ কৃষকেরা।
কারণ গরু, গয়না ইত্যাদি বিক্রি করে সেচ প্রকল্পের নির্ধারিত ব্যয়ের চেয়ে
১০ থেকে ১২ গুণ বেশি খরচ করে সব জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। কেউ বলছেন, নতুন করে মেশিন কিংবা ডিজেল কেনার মতো টাকা তাদের কাছে নেই। তা ছাড়া অত টাকা
খরচ করে ফসল ফলিয়ে ন্যায্যমূল্যও পান না। লাভের চেয়ে লোকসানই হয় বেশি। তাই তারা হাল
ছেড়ে দিয়ে আকাশের দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে আছেন। এ দিকে ফসল পুড়ে ছারখার।
কবে থেকে
এ সমস্যা হচ্ছে? লণীয়, ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত পানির প্রবাহ অতীতের ধারায় ছিল।
এর গড় মাত্রা ৯০০০ কিউসেক (ডালিয়া পয়েন্ট)। এটি কমতে কমতে এবার এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র
৫০০ কিউসেকে। অবশ্য ১৩ এপ্রিল থেকে একটু বেড়েছিল। যখন ‘তারা’ দেখলেন, তিস্তার পানি আমরা কাজে লাগাতে শিখেছি, এই পানি জমিতে সেচের কাজে ব্যবহারের জন্য ক্যানেল সিস্টেমের মাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ
প্রকল্প গ্রহণ করেছি, ঠিক তখনই তারা কলকাঠি নাড়লেন। বাংলাদেশের পেটে লাথি
মারা শুরু করলেন।
বাংলাদেশ
নদীমাতৃক। নদীর বুক চিরেই কৃষক ভাইয়েরা ফসল ফলান, নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল অনেক
সভ্যতা। পড়শি রাষ্ট্র বিভিন্ন উপায়ে বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দিয়ে, ফারাক্কা, গজলডোবা টিপাইমুখ দিয়ে আমাদের স্রোতস্বিনী নদীগুলোকে হত্যা করছে
কিংবা করতে চায়। এর জন্য কিছুটা দায়ী আমাদের দেশের শাসকগোষ্ঠী। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, যদি কেউ এসব বিষয়ে সোচ্চার হন, আন্দোলনে নামেন, তখন তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে ব্যবহার করা হয়। লংমার্চের জন্য বাস-ট্রাক দিতে
মালিকপকে নিষেধ করা হয়। আবাসিক হোটেলগুলোতে তালা লাগাতে বলা হয়।
জানা যায়, তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে দু’দেশের মধ্যে গত জানুয়ারি থেকে
মার্চ পর্যন্ত পাঁচবার চিঠি চালাচালি করেও সমাধান মেলেনি। আর এ চুক্তিতে ভারত যে সই
করবে, এর নিশ্চয়তাও নেই। শৈশব থেকেই দেখে আসছি তিস্তার পানির ব্যাপারে
ভারত একগুঁয়ে। সে েেত্র জনগণকে নিয়ে আন্দোলনই একমাত্র পথ। জাতীয় স্বার্থেই নদীর পানিতে
আমাদের ন্যায্য দাবি আদায় করতে হবে। দেশের প্রতি যাদের সামান্য মমতা আছে তারাও এ ধরনের
আন্দোলন নিয়ে বিতর্ক করতে পারে না।
চার দিক
থেকে গ্রাস করছে আগ্রাসী শক্তির থাবা। আমরা চাই ন্যায্য হিস্যা এবং শান্তিতে বাঁচতে, কৃষকদের বাঁচাতে। যারা আমার দেশের এক-তৃতীয়াংশ ভূমির অন্যায় আবদার করছে, তাদের সাথে কিভাবে বন্ধুত্ব হবে? যারা তিস্তার ন্যায্য পাওনা না
দিয়ে কৃষকের ফসল পুড়ছে, তারা কেমন বন্ধু? যারা পদ্মাকে শুষ্ক বালুতে পরিণত
করেছে, টিপাইমুখ দিয়ে মেঘনাকে হত্যা করতে চাইছে, তাদের ওপর আস্থা রাখা যায় না। তারা আমাদের বন্ধু মনে করলে এসব আচরণ করত না।
আমরা সখ্য গড়ার ল্েয শুধু দিয়েই গেলাম, কিছুই তো পেলাম না।
কেন আমরা
ঢাকার বদলে দিল্লিকে কিংবা কুমিল্লার বদলে কলকাতাকে প্রণাম করতে যাবো। মায়ের বদলে কেন
মাসিকে নেবো? আসুন, ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং
দেশ ও জাতির অবিচ্ছেদ্য অধিকার রা করি।
মাসুদ আলম
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন