স্বাধীন সুলতানী আমলে বাংলাদেশ শিক্ষা-দীক্ষায় এক ঐশ্বর্যশালী দেশ হিসেবে বিশ্বসমাজে সমাদৃত হতো। ১৭৫৭ সালে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বৃটিশ শৃঙ্খলে পরাধীনতার এক দুর্বিষহ জীবন কাটাতে বাধ্য হয়। এরপর বিশেষ করে ধন-ধান্যে প্রাচুর্যে ভরা এদেশটি কলকাতা ও ড্যান্ডির পশ্চাদ-ক্ষেত্র (ঐরহঃবৎষধহফ) হিসেবে “বাঙ্গাল” নামে টিকে ছিল।
১৯৪৭ সালে পাক-ভারত স্বাধীন হলে বাংলাদেশে তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যক্তিত্ব বলতে হিন্দুরা সবকিছু গুটিয়ে ভারতে চলে যান। অপরদিকে ভারত থেকে মুসলিম জনগোষ্ঠী সহায়-সম্বলহীনভাবে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। পূর্ববঙ্গকে এমন কৌশলে ভাগ করা হয় ফলে দীর্ঘদিনের উন্নয়ন অবকাঠামো ও আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংযোগগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাক-সামরিক জান্তা বাংলাদেশকে বৃটিশ আদলে পাকিস্তানের পশ্চাদ-ক্ষেত্র করে রাখে।
আড়াইশ বছরের শোষণ, বঞ্চনা, অশিক্ষা, দুর্নীতি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ সব মিলে আমাদের চরিত্রের ওপর এক বিরূপ প্রভাব পড়ে। এ সময়ে আমাদের রাজনৈতিক পরিচিতি বলতে যতটুকু ছিল তাও কেবল অধিকার আদায়ের রাজপথ-উত্তপ্ত করা আন্দোলন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক এ অবস্থায় চলতে চলতে রক্ত-মাংস-মজ্জায় যেন দাবি আদায়ের আন্দোলনপ্রিয় হয়ে উঠল এদেশের বঞ্চিত সাধারণ জনগণ। আমাদের আরেকটি শ্রেণী স্বার্থান্বেষী যারা আধিপত্য লাভ ও অর্থনৈতিক স্বার্থ আদায়ের জন্য রাজনৈতিক আবরণে সব অপকৌশল জাতির ওপর প্রয়োগ করতে থাকলো। একটা দেশ গঠনের জন্য যে সুস্থ রাজনীতির প্রয়োজন ছিল সে রকম রাজনীতির চর্চা আমরা করতে পারি নাই। হয়তো তাই, সমাজ থেকে জাতীয় পর্যায়ে কোনো সুস্থ রাজনীতি উঠে আসতে পারে নাই। এ পরিস্থিতিতে সুস্থ রাজনীতির ধারার বিশ্বাসী কিছু সমাজ তথা রাজনৈতিক চিন্তাশীল উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন এবং এখান থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে থাকেন। কিন্তু জাতির জন্য সুফল বয়ে আনতে হলে আমাদের সামগ্রিক জাতীয় চরিত্র সংশোধন করে সৎ ও যোগ্য নাগরিক সৃষ্টি করার পরিবেশ প্রয়োজন। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এটা অত্যন্ত কঠিন ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এর জন্য একটা পদ্ধতি জাতিকে দিতে হবে। কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতির মাধ্যমে সে লক্ষ্য পূরণের আভাস ক্রমেই প্রস্ফুটিত হচ্ছিল। এ পদ্ধতির ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমাজে সবার উপর স্বল্প সময়ে যতটুকু সম্ভব প্রভাব ফেলে আসছিল। জনগণের মধ্যে এক স্বস্তির আবহ সৃষ্টি হতো এবং নির্বাচনকে উৎসবমুখর করে ভোটকেন্দ্রে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসে হাজির হতো। সে অল্পসময়টি নির্বাচন উপলক্ষে হলেও জনগণ ও রাষ্ট্রের মধ্যে একটা সুসম্পর্ক পরিলক্ষিত হতো! মনে হতো এ দুটি রাজনৈতিক শক্তি যেন একাট্টা হয়ে এক নীরব বিপ্লব ঘটাচ্ছে। মনে হতো, জনগণ যেন নিজেরাই প্রতিনিধিত্ব করছে। ঠিক যেন, “গ্রীসের নগর রাষ্ট্র”Ñ এর একটা সর্বাধুনিক সংস্করণ। সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এর অবশ্যই একটা মূল্য ছিল। আমাদের প্রচলিত গণতান্ত্রিক পরিবেশে জনপ্রতিনিধিরা ক্ষমতা দখলে রাখতে ষড়যন্ত্র, সন্ত্রাস লালন করে ভোটকেন্দ্র দখল, খুনাখুনি চালিয়ে সে সময়টাকে বিভীষিকাময় করে তুলতো। এছাড়া রাজনীতির কথিত নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজিতো রয়েছেই। এসবের অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। সে সব অভিজ্ঞতা থেকে সর্বপ্রথম জামায়াত এই তত্ত্বাবধায়কের দাবি তোলার পর নব্বই দশকজুড়ে আন্দোলন অতঃপর ১৯৯৬ সালে কেয়ারটেকার সরকারের দর্শন গণদাবিতে পরিণত হয়েছিল। এ দাবি শুধু এরশাদ সরকার বা বিএনপি সরকারকে উদ্দেশ্য করে করা হয় নাই আমাদের সুদূর ও নিকট ইতিহাসও তার সাক্ষী দিবে। বর্তমানে এই পদ্ধতি দেশ-বিদেশে অনেকেরই জন্য এক আদর্শ হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। যা প্রমাণ করে, এ পদ্ধতি একটা সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যন্ত সহায়ক। শুধু তাই নয়, বাড়তি পাওনা হিসাবে আপামর জনগোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের চরিত্রকে জাতীয় পর্যায়ের জন্য উপযোগী করে গড়ে তোলার এক অপূর্ব অনুপম মাধ্যম হিসাবেও প্রত্যক্ষ করেছি। ২০০৭ সালের দৃশ্যপটকে সামনে এনে যে বিতর্ক সৃষ্টি তার প্রেক্ষিতে বলা যায়, সে সময় রাজনৈতিক দল তথা জনপ্রতিনিধিদের চরম ব্যর্থতার পরও, আর যাই হোক, একটা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছিল। কেয়ারটেকার ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের প্রাজ্ঞতা দাবি করে, একে আরো ত্রুটিমুক্ত, সুসংহত ও সুষ্ঠুভাবে কার্যকর করার জন্য চিন্তাভাবনা করা। আমাদের সব সমস্যার শাঁষ (কোর) সমস্যাটি হচ্ছে, রাজনীতি এবং সরকারি দলের আশীর্বাদপুষ্ট রাষ্ট্রযন্ত্র। সুতরাং এ দুটিকে নির্দলীয় করাটাই হবে আমাদের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ।
কিছু প্রতিষ্ঠান, অনির্বাচিত ব্যক্তি দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা ও সংবিধান দেখভাল করার সুযোগ সংবিধানে রাখা আছে। সময় ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে এসব করতে হয়েছিল। মন্ত্রী পরিষদের এক-দশমাংশ, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাবৃন্দ। এমনকি জনপ্রতিনিধিদের সংসদ শিরোমনি স্পিকার এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রপতির পদটিও যেভাবে সংবিধানে আছে, সঠিক অর্থে, জনগণের প্রত্যক্ষ প্রতিনিধিত্ব নাও করতে পারেন। তেমনিভাবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রমাণিত হয়েছে যে, সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা, ফল ঘোষণা এবং নির্বিঘেœ জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় একটি নিরপেক্ষ নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকা অপরিহার্য।
আমাদের সমাজে অসহায়ত্বের একটা প্রকট চিত্র হলো, দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষ দরিদ্র ও হতদরিদ্র। এই শ্রেণীরা জাতির জন্য জটিল সমস্যা হলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে এদের অস্তিত্ব অত্যন্ত লোভনীয়Ñ কেবল এক-দুশ’ টাকার বিনিময়ে ভোট ব্যাংক হিসাবে এরা কেনা হয়ে যায়! সুতরাং আমাদের কাছে গণতন্ত্রের যে খ-িত চিত্র দৃশ্যমান তাও আছে বিকৃত ও লজ্জাজনক আকারে। তাই, এদের ওপর প্রভাবহীন এক নিরপেক্ষ নির্বাচনী পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে রাজনৈতিক লালসাকে নিয়ন্ত্রণ করা আবশ্যক।
পরিশেষে বলবো ’৭২-৯০ এর ইতিহাসে ফিরে যাওয়া নয়, বরং বাস্তবতার নিরিখে আমাদের রাজনৈতিক দিক নিয়ে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। আমরা কি দেশকে ক্রমেই বিভেদ, হিংসা-বিদ্বেষ ও রক্তক্ষয়ী অবস্থার দিকে ঠেলে দিতে থাকবো নাকি জাতির মধ্যে বলিষ্ঠ বিবেক সৃষ্টির জন্য কেয়াটেকার সরকার পদ্ধতির মতো একটা নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানের কথা চিন্তা করবো! তাই, জনগণ যে অবস্থায় থাকতে সবচেয়ে বেশি স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সে অবস্থাকেই প্রকৃত গণতন্ত্র বিবেচনা করা হবে যথার্থ গণতন্ত্র। যোগ্য জনপ্রতিনিধিত্বের জন্য যেমন সুষ্ঠু গণতন্ত্র প্রয়োজন, তেমনি সে সুন্দর গণতন্ত্রের জন্য জনগণের স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যকে প্রাথমিক শর্ত হিসেবে বিবেচনা করাই হবে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতি সঠিক শ্রদ্ধা প্রদর্শন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন