অতি কাছাকাছি সময়ে বর্তমান আওয়ামী
লীগ সরকারের কাছ থেকে জাতি দু’টি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন উপহার পেল। প্রথমটি ৫
জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন। আর দ্বিতীয়টি মার্চ, ২০১৪ জুড়ে পাঁচ পর্বে অনুষ্ঠিত
উপজেলা নির্বাচন। এ নির্বাচন দু’টি নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের প্রশ্ন কেমন হলো এই দুই গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন, কী পেল দেশ-জাতি? তবে এরই মধ্যে দেশবাসী তো বটেই, বিদেশীরাও নিশ্চিতভাবে জেনে গেছেন এ নির্বাচন দু’টির একটিও দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
যদি বলা
হয়, বাংলাদেশের ইতিহাসে ভোটারবিহীন, প্রার্থীবিহীন, প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন নির্বাচন কোনটি? তবে উত্তর আসবে ৫ জানুয়ারির জাতীয়
সংসদ নির্বাচন। সাধারণ মানুষের কাছে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এমন অভিধায়ই অভিহিত হবে আগামী
দিনগুলোতেও। আর আওয়ামী লীগের নেতাদের ভাষায় ৫ জানুয়ারির নির্বাচন হচ্ছে সাংবিধানিক
বাধ্যবাধকতার নির্বাচন, নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে
দেশের মানুষকে এমন ধারণা দিয়েই আওয়ামী লীগের নেতানেত্রীরা বলেছিলেন, ৫ জানুয়ারির সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আর নিয়ম রক্ষার নির্বাচনের পর বিরোধী দলগুলোর
সাথে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করে সবার অংশগ্রহণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের
আয়োজন করা হবে; কিন্তু ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন, প্রার্থীবিহীন ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন
নির্বাচন সম্পন্ন করে জাতীয় পার্টিকে সরকারে আবার বিরোধী দলেও রেখে অদ্ভুত ধরনের সরকার
গঠনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের এক কথা পরবর্তী সংসদ নির্বাচন হবে পাঁচ
বছর পর। বিএনপিকে ওই পরবর্তী নির্বাচনের জন্য পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে। কারণ বিএনপি
৫ জানুয়ারির নির্বাচনী ট্রেন মিস করেছে; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছেÑ জাতীয় সংসদের অর্ধেকেরও বেশি আসনের ভোটারেরা ভোট দেয়ার কোনো সুযোগই পেল না।
তাদেরকে যে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলো অস্বাভাবিক এক নির্বাচনের মাধ্যমে, তাদের ভোটের অধিকারের কী হবে?
যুক্তরাজ্যের
আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী অ্যালান ডানকান সম্প্রতি ঢাকা সফরকালে তার সফর
সমাপনী সংবাদ সম্মেলনে বলে গেছেন ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল অস্বাভাবিক। ওই নির্বাচনে
একপক্ষ অংশ নেয়নি। সংসদের বর্তমান বিরোধী দল সরকারে আছে, বিরোধী বেঞ্চে তো আছেই। এ নির্বাচন অস্বাভাবিক হলেও সরকার বৈধ। ব্রিটেন বাংলাদেশে
প্রকৃত গণতন্ত্র দেখতে চায়। আমরা আলোকিত সরকার দেখতে চাই।’ ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রীর এই বক্তব্য সুস্পষ্ট। দেশের মানুষের প্রত্যাশাও তাই।
এ বক্তব্যের মর্মকথা আওয়ামী লীগ সরকার বোঝে না, তা নয়। এর পরও সরকার সব দলের
অংশগ্রহণে নির্বাচন আয়োজনের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার স্বপ্নে
বিভোর, বেঘোর। এ সরকার যেন কিছুতেই বুঝতে চায় না ৫ জানুয়ারির নির্বাচন
ছিল গণতন্ত্রের প্রতি এক চরম আঘাত। যেকোনো মূল্যে তা শোধরানোর পথ খোঁজা আজ অপরিহার্য
হয়ে পড়েছে। এর জন্য প্রয়োজন সমঝোতার সড়কপথে হাঁটা, একগুঁয়েমির পথে নয়।
একগুঁয়েমির
পথরেখা ধরেই ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের ভুল শোধরানোর কোনো উদ্যোগ না নিয়ে সরকার
পরিস্থিতিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য দেশে প্রথমবারের মতো মার্চব্যাপী পাঁচ দফায়
উপজেলা নির্বাচন সম্পন্নের অপকৌশল নিয়ে মাঠে নামে। সরকার ধরে নিয়েছিল ক্ষমতায় থেকে
আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচনে গেলে আন্দোলনে ও সরকারের দমনপীড়নে কোণঠাসা বিএনপি-জামায়াত
হয় এ নির্বাচনে যাবে না, আর গেলেও জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করবে; কিন্তু প্রথম দফা উপজেলা নির্বাচনে দেখা গেল জনগণ উল্টো আওয়ামী লীগকেই প্রত্যাখ্যান
করল। পক্ষান্তরে বিএনপি-জামায়াত আলাদা আলাদাভাবে প্রথম দফা উপজেলা নির্বাচনে ব্যাপক
সাফল্য পেল। এ সাফল্যে সরকারপক্ষ রীতিমতো হতবাক। এর পর শুরু হলো সরকারের ব্যাপক প্রভাব
বিস্তার; কিন্তু দ্বিতীয় দফা নির্বাচনেও বিএনপি ও জামায়াতের সাফল্যধারা
অব্যাহত রইল। তৃতীয় দফা নির্বাচন থেকে সরকার মরিয়া। পরবর্তী তিন দফা নির্বাচনে একটির
চেয়ে আরেকটিতে চলল আরো বেশি মাত্রায় কেন্দ্র দখল, ভোটের বাক্স ও ব্যালটপেপার ছিনতাই, প্রতিপক্ষের এজেন্টদের বের করে দিয়ে ইচ্ছেমতো সিল মেরে ব্যালটবাক্স বোঝাই করা।
পুরো এই মহাযজ্ঞ এরই মধ্যে গণমাধ্যম সূত্রে সুপরিচিতি পেল ‘ভোট ডাকাতির মহোৎসব’ নামে। এই মহোৎসব চরম মাত্রায় পৌঁছে পঞ্চম দফা উপজেলা
নির্বাচনের সময়। এভাবে ভোট ডাকাতির মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ এ নির্বাচনে সর্বাধিক সংখ্যক
আসন নিশ্চিত করল। বিএনপি ও জামায়াতের অনুমিত সুস্পষ্ট বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হলো।
পঞ্চম
দফার নির্বাচন প্রসঙ্গে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ’ (ইডব্লিউজি) বলেছে উপজেলা নির্বাচনের পঞ্চম ও শেষ ধাপে বেশ কিছু কেন্দ্রে ভোট শুরুর আগেই ব্যালটবাক্স
সিল মারা ব্যালটপেপারে ভরা ছিল। এ নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও জালিয়াতি হয়েছে। তাদের
পর্যবেক্ষকেরাও নিরাপদে কাজ করতে পারেননি। অনেক কেন্দ্র ও বুথ থেকে তাদের বের করে দেয়া
হয়েছে। তাদের দেয়া তথ্যানুসারে ৫০ শতাংশ ভোটকেন্দ্রের ভেতরে সহিংসতা চলেছে। ভোট
জালিয়াতি হয়েছে ৫৩ শতাংশ। ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে ৭৬ শতাংশ উপজেলায়। ৫৯
শতাংশ কেন্দ্রে পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। ভোট চলার সময় প্রতিপক্ষকে
হয়রানি করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কেন্দ্রের ভেতর থেকে ২৯ শতাংশ উপজেলায় গ্রেফতারের
ঘটনা ঘটেছে। ইডব্লিউজিকে গণনাপ্রক্রিয়া দেখতে দেয়া হয়নি ৩৮ শতাংশ উপজেলায়। ইডব্লিউজির
পর্যবেক্ষণ এলাকায় ভোটদানের গড় হার ৬৩.৭ হলেও জালভোটের কারণে এ হার প্রকৃত ভোটের প্রতিফলন
নয়। আইন অমান্য করে নির্বাচনী প্রচারণা হয়েছে ৬৫ শতাংশ উপজেলায়। ইডব্লিউজির প্রতিবেদনে
বেশ কিছু কেন্দ্রে সরেজমিন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে সংস্থাটির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন
করে; এতে ভোট জালিয়াতির সুস্পষ্ট প্রতিফলন রয়েছে। এর পরও সরকারি দলের
নেতানেত্রীরা এবং ভারপ্রাপ্ত সিইসি এ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন; কিন্তু উপজেলা নির্বাচনে এবার যে অভূতপূর্ব ভোট ডাকাতি আর জাল-জালিয়াতি চলেছে
তা সারা দেশের মানুষ বাস্তব অভিজ্ঞতায় আর মুদ্রণ ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম সূত্রে ভালো
করেই আঁচ করতে পেরেছে। ফলে সরকার ও ইসির সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার কল্পলোকের গল্পকথা কেউ
বিশ্বাস করছে না। ফলে সরকারি দলের ও জোটের কোনো কোনো নেতা মিন মিন করে হলেও প্রকারান্তরে
ভোট ডাকাতি আর জালিয়াতির কথা স্বীকার করছেন। কারণ ভোট ডাকাতি আর জালিয়াতি সম্পর্কে
জনধারণা সুস্পষ্টভাবে এরই মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। তাই আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের
সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে প্রকাশ্যে বলতে শোনা যায়Ñ ‘উপজেলা নির্বাচনে সরকারের হস্তক্ষেপ
যে একেবারেই হয়নি তা বলা যাবে না।’ অপর দিকে উপজেলা নির্বাচনে অনিয়ম
হওয়ার বিষয়টি প্রকারান্তরে স্বীকার করলেও বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী এবং ওয়ার্কার্স
পার্টির চেয়ারম্যান রাশেদ খান মেনন এ অনিয়মের দায় সরকারের বলে মেনে নিতে চাননি। তিনি
বলেছেন ‘উপজেলা নির্বাচনে অনিয়মের দায় নির্বাচন কমিশনের।’ কী অবাক করা কথা, ভোট ডাকাতি করবে সরকারি জোটের প্রার্থীরা, সে দায় শুধু এককভাবে নির্বাচন কমিশনের, সরকারের নয়।
উপজেলা
পরিষদ নির্বাচনে ভোট ডাকাতি আর জালিয়াতির বিষয়টি কোনো মতেই লুকাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত
নিরঙ্কুশ জয় পেয়েও স্বস্তিতে নেই আওয়ামী লীগের নেতানেত্রীরা। এ কারণে অনেক নেতাকর্মী
এ ব্যাপারে মুখ খোলা থেকে বিরত রয়েছেন। অবলম্বন করছেন নীরবতা পালনের নীতি। বিবেকবান
নেতাদের বক্তব্য সহিংসতা ও ভোট জালিয়াতির মাধ্যমে এভাবে বিরোধী দলের জয় ছিনিয়ে
নেয়ার কোনো দরকার ছিল না। উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগ কম আসন পেলেও আওয়ামী
লীগকে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে হতো না; বরং জনমনে এমন একটি ধারণা জন্মাত আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করেছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন
১৯ দলীয় জোট ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিলে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুই হতো; কিন্তু ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচনে যেমনটি ঘটেছে, তাতে করে বেগম জিয়ার অবস্থানই সঠিক বলে সুপ্রতিষ্ঠিত হলো : অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন
অন্তত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে চলতে পারে না। অতএব নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা
কর্তৃপক্ষের অধীনেই সব দলের অংশগ্রহণে দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রয়োজন। কারণ
৫ জানুয়ারির একতরফা সংসদ নির্বাচন ও মার্চব্যাপী পাঁচ দফার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে
দেশের গণতন্ত্রের কফিনে এ সরকার শেষ পেরেকটুকু ঠুকে দিয়েছে। এর পরও সরকারি দলের নেতানেত্রীরা
দেশবাসীকে প্রতিদিন ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে শোনাচ্ছেন : আগামী পাঁচ বছর তারা ক্ষমতায় থাকবেন
এবং দেশকে উন্নয়নের চরম পর্যায়ে নিয়ে যাবেন; কিন্তু তারা ভুলে গেছেনÑ গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। আর দেশকে উন্নয়নের সড়কে
নিয়ে দাঁড় করানোর জন্য প্রয়োজন গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করা। প্রয়োজন সবার অংশগ্রহণে
দেশী-বিদেশী সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এই অলঙ্ঘনীয় সত্য ভুলে আজ আমরা কোন অজানা
গন্তব্যের দিকে চলেছি, সরকারের কাছে এর সদুত্তর নেই।
৫ জানুয়ারি
ও মার্চব্যাপী কয়েক দফায় সম্পন্ন নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে আরেকটি বিষয় সুপ্রতিষ্ঠিত
হলো, একটি বিশ্বাসযোগ্য ও সবার জন্য গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য একটি
শক্তিশালী নির্দলীয় নির্বাচনী ব্যবস্থা তথা ইলেকটোরাল সিস্টেম গড়ে তোলা অপরিহার্য হয়ে
দাঁড়িয়েছে। যে নির্বাচন কমিশন আলোচ্য এ দুই নির্বাচনকে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার দাবি
করে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে, সেই দলবাজ নির্বাচন কমিশন দিয়ে আর যাই হোক অবাধ
ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আর এ-ও প্রমাণিত হয়ে গেছেÑ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করার মতো বিন্দুমাত্র পরিবেশ
আমরা সৃষ্টি করতে পারিনি। বর্তমান অথর্ব নির্বাচন কমিশন ও সরকারÑ এ দুয়ে মিলে এরই মধ্যে ৫ জানুয়ারির সংসদ ও মার্চের উপজেলা নির্বাচনের মাধ্যমে
দেশের গণতন্ত্রের ওপর যে দু’টি নির্মম আঘাত হানল, সে আঘাতে দেশের গণতন্ত্র এখন সম্পূর্ণ ধরাশায়ী। এ অবস্থা থেকে কখন কিভাবে আমরা
উত্তরণ ঘটাব, সেটাই এখন লাখো কোটি টাকার প্রশ্ন।
এর পরও
নির্বাচন কমিশন এখনো ফুরফুরে মেজাজে। এখন তিন নির্বাচন কমিশনার তৈরি হচ্ছেন বিদেশ সফরের
জন্য। তাদের হাতে এখন নয়া প্রকল্প, বায়োমেট্রিক ডাটাবেজ ম্যানেজমেন্ট
সিস্টেম। এই সিস্টেম সম্পর্কে সরেজমিনে জ্ঞান লাভ করার জন্যই শোনা যাচ্ছে তারা এই সফরে
যাচ্ছেন। বলা হচ্ছে, তারা এই সফরে যাবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী
রকীব উদ্দিন দেড় মাসব্যাপী বিদেশে অবকাশ যাপনের পর দেশে ফিরলেই। এমনকি তাদের সফরের
দিন-তারিখও ঠিক হয়ে আছে। নির্বাচন কমিশনার জাবেদ আলীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল
১৮-২৭ এপ্রিল সময়ে সফর করবেন অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুর। নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজের
নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ২-১১ মে সময়ে সফর করবে যুক্তরাজ্য ও সুইজারল্যান্ড।
অপর দিকে নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজের নেতৃত্বে আরেকটি চার সদস্যের প্রতিনিধিদল ১৬-২৫
মে সফর করবে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। বলা হচ্ছে, এ সফরের সময় নির্বাচন কমিশনত্রয়
সংশ্লিষ্ট দেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে মতবিনিময় করবেন সিটিজেন ডাটা ম্যানেজমেন্ট
সিস্টেম এবং বায়োমেট্রিক আইডি কার্ড তৈরি ও বিতরণসহ আরো কিছু বিষয়ে। এ বিষয়ে নির্বাচন
কমিশনের হাতে এখন নতুন প্রকল্প আইডিইএ (আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহেন্সিং অ্যাক্সেস
টু সার্ভিস)। প্রকল্প থেকে এর খরচ বহন করা হবে। এক দিকে আমরা যখন দেখছি হাজার কোটি
টাকা ব্যয়ে তৈরি ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা যেখানে ঠেকাতে পারেনি ভোটের জাল-জালিয়তি, কেন্দ্র দখল আর ভোট ডাকাতি, সেখানে দলবাজ বর্তমান নির্বাচন
কমিশন নতুন বায়োমেট্রিক ফিচারের আইডি কার্ড দিয়ে জাতিকে নতুন করে কী ধরনের ভোট ডাকাতির
উদাহরণ সৃষ্টি করবে, সে প্রশ্নও উঠছে। তাই বিবেকবানদের তাগিদ আগে নির্বাচন কমিশন থেকে দলবাজ নির্বাচন কমিশনারদের তাড়াতে হবে, এরপর প্রয়োজনে নতুন কিছু ভাবতে হবে। এর আগে আর কিছু নয়।
আওয়ামী
লীগ সরকার দেশ-বিদেশের প্রায় সব মহলের মতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ একগুঁয়েমি প্রদর্শন
করে সম্প্রতি সম্পন্ন করল ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন একতরফা সংসদ নির্বাচন এবং মার্চব্যাপী
পাঁচ পর্বের উপজেলা নির্বাচন। প্রশ্ন আসেÑ এই দুই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে
আওয়ামী লীগ কী পেল? অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই এ দুই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হলো আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন
অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে পারে না। অতীত ইতিহাসও তেমন সাক্ষীই দেয়।
আর সর্বসাম্প্রতিক এ দু’টি নির্বাচন আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় জনসংশ্লিষ্ট
দলের ইতিহাসে রচিত হলো দু’টি ততোধিক বড় মাপের কলঙ্কতিলক। এ কলঙ্ক ভোট ডাকাতি
আর কেন্দ্র দখল করে ভোট জালিয়াতি করার কলঙ্কতিলক। ব্যালটপেপার ছিনিয়ে নিয়ে প্রকাশ্যে
সিল মেরে ব্যালটবাক্স বোঝাই করার নতুন কলঙ্কের ইতিহাসও সৃষ্টি হলো এবার। এ দু’টি নির্বাচনের মধ্য দিয়েই আওয়ামী লীগ কার্যত গণতন্ত্রের সড়ক ছেড়ে পা দিয়েছে
স্বৈরতন্ত্রের মহাসড়কে। আওয়ামী লীগের মতো একটি দলের জন্য এমনটির কোনো প্রয়োজন ছিল না।
এ নির্বাচন দু’টি প্রমাণ করল আওয়ামী নেতৃত্ব আর জনগণের ওপর আস্থা রাখতে পারছে
না। আস্থাহারা হয়েই ক্ষমতাসীন এ দল আজ সবার অংশগ্রহণে অবাধ, নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচনে যেতে ভয় পায়। এর ফলে দলটির নেতানেত্রীরা একের পর
এক এমন সব কূটকৌশলী অনৈতিক ও অযৌক্তিক পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছেন, যার ফলে সাধারণ বিবেকবান মানুষ এখন আর দলকে গণতান্ত্রিক বলে ভাবতে পারছে না।
বরং মানুষ দলটির ধীরে ধীরে একটি স্বৈরতান্ত্রিক দল হয়ে ওঠার আলামতই দেখতে পাচ্ছে। এর
ফলে দলটির অতীত সব অর্জন যেন আজ ম্লান হতে চলেছে। বাংলাদেশের মানুষের স্বাধিকার আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী
দলটিকে আজকে এই ভূমিকায় দেখে দলটির বেশির ভাগ নেতাকর্মী ও সমর্থক তো বটেই, দেশের বিবেকবান সাধারণ মানুষও মর্মাহত। কারণ আজকের এই দিনে দলটি সময়ের সাথে
একটির পর একটি পেরেক যেন ঠুকে চলেছে গণতন্ত্রের কফিনে, যা কারো কাম্য নয়। অতএব আজ দলটির সামনে বড় তাগিদÑ ফিরে আসতে হবে গণতন্ত্রের মহাসড়কে। সেই সাথে দল ও অঙ্গসংগঠনের বদনামের কর্মতৎপরতাও
বন্ধ করতে হবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন