প্রতিবেশীদের মধ্যে সমস্যা থাকলেও সম্পর্ক সাধারণত বন্ধুত্বপূর্ণই হয়ে থাকে। কিন্তু নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ দূরে থাকুক, মোটেই স্বাভাবিক নয়। ভারতের প্রতি এদেশের ১৬ কোটি মানুষের মনোভাবও শত্রুতাপূর্ণ। অর্থাৎ বাংলাদেশের জনগণ ভারতকে বন্ধু নয় বরং শত্রু মনে করে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে অস্বাভাবিক তো বটেই, যথেষ্ট গুরুতরও। এই শত্রু মনে করার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। গত শনিবার সাউথ এশিয়া ইয়ুথ ফর পিস অ্যান্ড প্রস্পারিটি সোসাইটির উদ্যোগে আয়োজিত এক সেমিনারে তারা বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতিই এর কারণ। ‘ভারতের নির্বাচন ও আমাদের আকাংক্ষা’ শীর্ষক ওই সেমিনারে রাজনীতিক এবং সাবেক মন্ত্রী, সেনা অফিসার ও নির্বাচন কমিশনারসহ বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, ভারতকে শত্রু মনে করার জন্য জনগণকে দোষ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকারের দুর্বল ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতিই জনগণের মধ্যে ভারত সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করেছে। এর পাশাপাশি রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন ইস্যুতে ভারতের প্রতারণা, ঘোষিত অঙ্গিকার থেকে সরে যাওয়া, চুক্তি লংঘন এবং বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থবিরোধী ধ্বংসাত্মক কর্মকা-। তারা আরো বলেছেন, ভারতের নির্বাচনকে বাংলাদেশ কোনোভাবেই প্রভাবিত করতে পারে না এবং কখনো পারবেও না। কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভারত শুধু প্রভাবই বিস্তার করে না, নিজের ইচ্ছাও পূরণ করে থাকে। প্রাসঙ্গিক উদাহরণ হিসেবে ৫ জানুয়ারির সর্বশেষ নির্বাচনের উল্লেখ করে বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, ভোটররা ভোটকেন্দ্রে না গেলেও এবং সারাবিশ্বে ভোটারবিহীন, একদলীয় ও একতরফা নির্বাচন হিসেবে নিন্দিত ও প্রত্যাখ্যাত হলেও ভারত সে নির্বাচনকে বৈধতা তো দিয়েছেই, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশকে অস্থিতিশীলও করতে চেয়েছে। একমাত্র ভারতই ভোটারবিহীন নির্বাচনের মধ্যদিয়ে ক্ষমতায় আগত আওয়ামী লীগ সরকারকে বৈধতা দিয়েছে। ভারত প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে নয়, দেশটি কেবল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায়। মূলত এমন মনোভাবের কারণেই ভারতের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীন মর্যাদা শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ রয়েছে। এর কোনো বাস্তবায়ন নেই। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে সমর্থন দেয়ার বিনিময়ে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে শুধু নিয়েই চলেছে। এখনো দেশটি শুধু নিতেই ব্যস্ত রয়েছে। এই একটি বিষয়ে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। ভারতের সব সরকারই বাংলাদেশকে বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সুতরাং ভারতের চলমান লোকসভা নির্বাচনের মধ্যদিয়ে সে দেশে সরকারে কোনো পরিবর্তন ঘটলেও বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সামান্য সম্ভাবনাও নেই। এ জন্যই বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, স্বাধীন দেশ হিসেবে আমাদের মর্যাদা আমাদের নিজেদেরকেই আদায় করে নিতে হবে।
ভারতের স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ও নিরপেক্ষতার মতো নির্বাচন সংশ্লিষ্ট অন্যকিছু বিষয়ে বক্তব্য রাখলেও শনিবারের সেমিনারে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কই প্রাধান্যে এসেছে। আমরাও মনে করি, সেমিনারের মূলকথাগুলোর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার কোনো অবকাশ নেই। তাছাড়া সত্যি বলতে গেলে স্বীকার করতেই হবে যে, বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্রনীতি বলতে শুধু ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককেই বোঝায়। কিন্তু এই একটি মাত্র দেশের সঙ্গেও দ্বিপাক্ষিক সকল বিষয়ে বাংলাদেশ কেবল পিছিয়েই পড়েছে। প্রমাণিত হয়েছে, অতীতের মতো বিগত সোয়া পাঁচ বছরেও ভারত শুধু নিয়েছেই। এখনো নেয়ার ও ইচ্ছাপূরণ করে কেবলই নিজেরটা কড়ায়-গ-ায় আদায় করার ব্যাপারেই ব্যস্ত রয়েছে দেশটি। আওয়ামী লীগ সরকারও বাণিজ্য থেকে ট্রানজিটের আড়ালে করিডোর পর্যন্ত একের পর এক প্রতিটি বিষয়ে কেবল উজাড় করে দিয়ে চলেছে। সরকার এমনকি দেশের নিরাপত্তার চিন্তা না করে ভারতকে বিদ্যুতের জন্যও করিডোর দিতে সম্মত হয়েছে। এভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করে ভারত বাংলাদেশকে সবদিক থেকে নিজের ইচ্ছাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করে ফেলেছে। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে স্বাক্ষরিত ‘ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট’ বা কাঠামোগত চুক্তি থেকে নানা নামের চুক্তি ও সমঝোতার আড়ালে করিডোরসহ একতরফা সুবিধা আদায়ের এতো বেশি বিষয়ের উল্লেখ করা যায় যেগুলোর কোনো একটির মাধ্যমেও বাংলাদেশ সামান্য লাভবান হতে পারেনি। সব মিলিয়েই পর্যালোচনায় দেখা যাবে, এসবের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সর্বাত্মকভাবেই ভারতের ইচ্ছাধীন করা হয়েছে। এসবের মধ্যে ‘ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট’ ধরনের কোনো কোনো চুক্তি এমনকি চুক্তি ১৯৭২ সালের ২৫ বছর মেয়াদী চুক্তির চাইতেও ভয়াবহ। আগের চুক্তিতে তবু ২৫ বছরের মেয়াদ ছিল, যার পর চুক্তি বহাল রাখা না রাখার অধিকার পেয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু কাঠামোগত চুক্তিতে কোনো মেয়াদের উল্লেখ রাখা হয়নি। অর্থাৎ বাংলাদেশ কখনো এই চুক্তি বাতিল বা অকার্যকর করার সুযোগ পাবে না। সে অধিকারই চুক্তিতে দেয়া হয়নি। এ ধরনের চুক্তির মাধ্যমে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক সকল দিক থেকেই বাংলাদেশকে গোলামির জিঞ্জিরে বেঁধে ফেলেছে ভারত। এসব চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ভারতের অভ্যন্তরীণ সকল বিষয়েও বাংলাদেশকে ভারতের পক্ষে ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশ্লেষণের এ দৃষ্টিকোণ থেকেই শনিবারের সেমিনারে ব্যাখ্যাসহ বক্তব্য রেখেছেন বিশিষ্টজনেরা। আমরা তাদের এই অনুমানের সঙ্গেও একমত পোষণ করি যে, চলমান লোকসভা নির্বাচনের মধ্যদিয়ে ভারতে যদি কংগ্রেসের স্থলে বিজেপি বা অন্য কোনো দল বা জোটও ক্ষমতায় আসে তাহলেও ভারতের বাংলাদেশ নীতিতে কোনো পরিবর্তন ঘটবে না। কারণ, প্রমাণিত সত্য হলো, দিল্লির ক্ষমতায় যে দল বা জোটই থাকুক না কেন, তারা বাংলাদেশের কাছ থেকে শুধু নিতেই জানে। নিয়ে থাকেও। বর্তমান পর্যায়ে উদ্বেগ বেড়ে যাওয়ার অন্য এক কারণ হলো, ভারতের প্রত্যক্ষ সমর্থনে লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাসের পথ ধরে ক্ষমতায় আগত আওয়ামী লীগ প্রথম থেকেই ভারতের সব ইচ্ছা পূরণ করে চলেছে। একই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্যই ভারত ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনকে বৈধতা দিয়েছে, যাতে নৈতিকভাবে দুর্বল আওয়ামী লীগ সরকার বিনা বাক্য ব্যয়ে ভারতের সব ইচ্ছা পূরণ করে। এখানেই প্রাধান্যে এসেছে দেশপ্রেমিকদের কর্তব্যের দিকটি। শনিবারের সেমিনারে বিশিষ্টজনেরা সঠিকভাবেই বলেছেন, স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে এবং ধরে রাখতে হলে জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে। জনগণকেই ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের সব ন্যায্য প্রাপ্য আদায় করতে হবে। এজন্য বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর ভরসা করলে চলবে না। কারণ, ভারত যেমন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বলতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ককে বোঝে, আওয়ামী লীগ সরকারও তেমনি ভারতের ইচ্ছা পূরণ করাকেই তার একমাত্র কর্তব্য বলে মনে করে। এই সরকারের কাছে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ এবং জনগণের সামান্যও মূল্য নেই।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন