রবিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৪

নববর্ষে চাই নতুন অভিযাত্রা


কাল হারিয়ে যায় মহাকালের আবর্তে। জীবনের প্রয়োজনে আমরা কালের গণনা করি। এই গণনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বর্ষপঞ্জি। বর্ষপঞ্জিতে রয়েছে নানা বৈচিত্র্য। কোনো বর্ষপঞ্জিতে লক্ষ্য করা যায় সৌর সন, কোনটাতে আবার চান্দ্র-সন। বাঙ্গালী মুসলমানের জীবনে দু’রকম সনেরই রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব, তাই দু’রকম সন গণনাতেই আমরা অভ্যস্ত। আমাদের যে বাংলা সন তাতে ‘চান্দ্র’ ও ‘সৌর’ এই উভয় সনেরই প্রভাব রয়েছে। মূলতঃ বাংলা সনের উৎপত্তি হয়েছে হিজরী সন থেকে। মুঘল স¤্রাট আকবরের নির্দেশে জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমীর ফতেহুল্লাহ সিরাজী স¤্রাটের মসনদে আরোহণের কাল চান্দ্রসন ৯৬৩ হিজরীকে সৌর গণনায় এনে বাংলা সনের উদ্ভব ঘটান। প্রশাসনিক প্রয়োজন তথা রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা বিধানের জন্য স¤্রাট আকবর এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। রাজস্ব আদায়ের সাথে সম্পর্ক রয়েছে ফসলের। তাই বাংলা সনকে ফসলি সন হিসেবেও অভিহিত করা হতো। বাংলা সনের উৎপত্তির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে ধর্ম, সংস্কৃতি, উৎপাদন ও কৃষক সমাজের প্রসঙ্গ চলে আসে। এভাবে বাংলা সনের সাথে উঠে আসে একটি সমাজ চিত্র। গভীরতর এমন ব্যঞ্জনার কারণেই বাংলা সন আমাদের কাছে এতটা প্রিয়। আজ বাংলা ১৪২০ সালকে বিদায় জানিয়ে আমরা স্বাগত জানাবো নতুন বর্ষ ১৪২১ক। নতুন এই বর্ষে আমরা সবাইকে জানাই শুভ-নববর্ষ।
নতুন বছরে মানুষের মনে জাগে নতুন আশাবাদ। অতীতের ভুল-ভ্রান্তি, হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে মানুষ নবপ্রেরণায় নতুন করে জীবনকে বিকশিত করতে চায়। এমন ইতিবাচক চেতনার কারণে নানা দুঃখ-বেদনা ও যন্ত্রণার মধ্যে এখনও টিকে আছে আমাদের সমাজ। তবে সমাজকে, জীবনকে প্রগতির কাক্সিক্ষত পথে এগিয়ে নিতে হলে অতীতের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এই বিশ্লেষণে ত্রুটি থাকলে প্রগতির স্বপ্ন পূরণ হবার নয়। এক্ষেত্রে সরকার ও রাজনীতিবিদদের আত্মজিজ্ঞাসা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আমরা জানি যে, বাংলাদেশ একটি কৃষিভিত্তিক দেশ। কিন্তু কৃষক সমাজের স্বার্থরক্ষার চেতনা এখানে দুর্বল। দেশের ৮০ ভাগ গ্রামীণ মানুষের স্বার্থ ও সংস্কৃতি চিন্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভোগবাদী গুটিকয় মানুষ কী করে দেশকে প্রগতির কাক্সিক্ষত পথে নিয়ে যাবে? এদের বৈশাখ উদযাপনেও গণবিচ্ছিন্ন চেতনার আলামত প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। বৈশাখ উপলক্ষে খুব ঘটা করে বের করা হয় মঙ্গল-শোভাযাত্রা। বিশাল আয়োজনের এ শোভাযাত্রায় ময়ূর, পেঁচা, কুমিরসহ নানা পশু-পাখির প্রতিকৃতি ও মুখোশের সমাবেশ ঘটানো হয়। এই মঙ্গল মিছিলের যে রূপ ও আবহ তা গ্রামবাংলার ব্যাপক জনগোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনার সঙ্গে মিলে না। কৃত্রিম এ শোভাযাত্রায় বিশেষ ঘরানার রাজনৈতিক চেতনাও লক্ষ্য করা যায়, যা সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনার সঙ্গে যায় না। আর যে বিষয়টি প্রকট হয়ে ধরা পড়ে তা হলো, এদেশের ৯০ ভাগ মুসলমানের মনে আল্লাহর একত্ববাদ বা তাওহিদের যে চেতনা, তার বিপরীত ধারায় পরিচালিত হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। মঙ্গল শোভাযাত্রায় পশু-পাখির যে প্রতিকৃতি বা মুখোশ তার সাথে টোটেম-বিশ্বাসের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী পশু-পাখির প্রতিকৃতি বা মুখোশের মাঝে কোনো মঙ্গল বা কল্যাণ খুঁজে পায় না। সমাজবিজ্ঞানের ইতিহাসেও বলা হয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কহীন ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ একসময়ে বিভিন্ন পশু-পাখিকে পুজা করতো এবং তাদের কাছে মঙ্গল বা কল্যাণ ভিক্ষা করতো। বাংলাদেশের মানুষ তো বহু আগেই চিন্তার সে স্তরটা পেরিয়ে এসেছে। তাহলে তাদের আবার মঙ্গল-শোভাযাত্রার মাধ্যমে পেছনের দিকে ডাকা হচ্ছে কেন? পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, এদেশের ইসলামবিদ্বেষী কিছু মানুষ সরাসরি ইসলামের তাওহিদ বা ‘একত্ববাদ’ চেতনার বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস না পেলেও নববর্ষ উপলক্ষে বাঙালীয়ানার নাম করে পশু-পাখির প্রতিকৃতি নিয়ে মঙ্গল-শোভাযাত্রার আড়ালে ভিন্ন সংস্কৃতির একটি মিশ্রণ ঘটাবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কৌশলে। তাই বিষয়টিকে তারা গণবিরোধী সংস্কৃতির আগ্রাসন হিসেবেই বিবেচনা করেন।
পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রায় মঙ্গল ও কল্যাণের অনেক কথাই বলা হয়। কিন্তু তার প্রভাব এই শোভাযাত্রার সমর্থকদের অনেকের মধ্যেই তেমন লক্ষ্য করা যায় না। পশু-পাখির অর্চনা বা টোটেম-বিশ্বাসের অন্তসারশূন্যতার কারণে মঙ্গল শোভাযাত্রার নানা বুলি ইতোমধ্যেই কাগুজে বুলি হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। নয়তো বৈশাখের বর্ষবরণ উৎসবকে কেন্দ্র করে হামলা, শ্লীলতাহানি ও চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটে কেমন করে? বৈশাখ তো আমাদের অজাচার, অনাচার ও সব আবিলতা দূর করে নতুন অভিযাত্রায় পথ চলার আহ্বান জানায়। যারা বৈশাখের এই আহ্বানকে উপলব্ধি করে সমাজকে অনাচার ও কুসংস্কারমুক্ত করে জনগণকে উন্নয়ন ও আলোর পথে চলতে সাহায্য করবে, তাদের হাতেই উড্ডীন রইবে বৈশাখের পতাকা। বিষয়টি বৈশাখপ্রেমীরা উপলব্ধি করলেই মঙ্গল।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads