ইতিহাসের এমন কিছু ঘটনা ও অধ্যায় রয়েছে যেগুলোর দিকে মাঝে মধ্যে ফিরে যেতে এবং স্মরণ করতে ও করিয়ে দিতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর কারণ তৈরি করেন অন্যজনরা। যেমন অতি সম্প্রতি করেছেন ভারতের চরম হিন্দুত্ববাদী প্রধান বিরোধী দল বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা সুব্রামনিয়াম স্বামী। ইতিহাসের ব্যাখ্যার আড়ালে একটি দাবি তুলে মূল কথায় তিনি বলেছেন, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় ভারতকে ঠকিয়ে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানকে অনেক বেশি অঞ্চল দেয়া হয়েছিল। তাছাড়া দেশ বিভাগের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ মুসলমান ভারতে অনুপ্রবেশ করেছে। তারা এখনো অবৈধভাবে ভারতে বসবাস করছে। এই মুসলমানরা যেহেতু বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ, সেহেতু বাংলাদেশকেও তার এক-তৃতীয়াংশ ভূমি ভারতকে দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে বিজেপি নেতার ফর্মুলা হলো, বাংলাদেশকে খুলনা থেকে সিলেট পর্যন্ত সমান্তরাল রেখা টেনে সম্পূর্ণ ভূমি ভারতের হাতে তুলে দিতে হবে। এটা নাকি বাংলাদেশের কাছে ভারতের ঐতিহাসিক পাওনা! সে কারণে বাংলাদেশের কাছ থেকে এই ভূমি আদায় করা অর্থাৎ ফেরত নেয়া হবে।
বিজেপি ভারতের কোনো সাধারণ দল নয়। জনসংঘ, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) এবং হিন্দু মহাসভা ধরনের কয়েকটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী দলের সমন্বয়ে গড়ে উঠা এই দলটি অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে ভারতের ক্ষমতায় গেছে। এ সময়ে চলমান নির্বাচনের মধ্য দিয়েও বিজেপি আরো একবার ক্ষমতায় যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী এবং গুজরাটে হাজার হাজার মুসলমান হত্যার প্রধান নায়ক নরেন্দ্রনাথ মোদির নেতৃত্বে দলটি এখনো গুজরাট রাজ্যের ক্ষমতায় রয়েছে। আরো অনেক রাজ্যেই বিজেপি প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে। সুতরাং অমন এক দল বিজেপির কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতা সুব্রামনিয়াম স্বামীর বক্তব্যকে হাল্কাভাবে নেয়ার পরিণতি বাংলাদেশের জন্য মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু সব জেনে-বুঝেও আওয়ামী লীগ সরকার যথারীতি নীরবতা অবলম্বন করে চলেছে। অথচ সরকারের দায়িত্ব ছিল ভারত সরকারের কাছে সুব্রামনিয়াম স্বামীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানানো। নিদেন পক্ষে বিজেপি নেতার দাবিটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করা। কিন্তু সরকার কিছুই করেনি। সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর এবং তথাকথিত সুশীলসমাজের নীরবতাও জনগণকে নিরাশই করেছে। একমাত্র দল হিসেবে প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে বিজেপি নেতার দাবি ও বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থ ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণেই বিজেপির নেতা বাংলাদেশের ভূমি দাবি করার ঔদ্ধত্য দেখাতে পেরেছেন।
বিজেপির নেতা সুব্রামনিয়াম স্বামীর এই উস্কানিমূলক দাবি ও বক্তব্যের কারণে শুধু নয়, কথা উঠেছে সাধারণভাবে ভারতীয়দের বাংলাদেশনীতির কারণেও। বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের নীতি-কৌশল ও কার্যক্রম সবসময় সম্প্রসারণবাদী হিসেবে চিহ্নিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে এসেছে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে প্রথম থেকেই ভারত বাংলাদেশকে বিপুল ঘাটতির মধ্যে রেখেছে। ভারতের সব সরকারই ঘাটতি কমিয়ে আনার দাবি উপেক্ষা করেছে। সৎ প্রতিবেশীসুলভ মনোভাব দেখানোর পরিবর্তে ভারতীয় নেতারা বরং বাংলাদেশের লোকসান বাড়ানোর ধ্বংসাত্মক নীতিরই বাস্তবায়ন করেছেন। এর ফলে বাংলাদেশের রফতানি আয় ক্রমাগত কমছে, অন্যদিকে আমদানি ব্যয় বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। অভিন্ন নদ-নদীর উজানে বাঁধের পর বাঁধ নির্মাণ করে এবং রীতিমতো পানি আগ্রাসন চালিয়ে ভারত বাংলাদেশকে প্রায় পানি-প্রতিবন্ধী রাষ্ট্রে পরিণত করে ফেলেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও ভারতের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ঘটছে। সবমিলিয়ে প্রমাণিত সত্য হলো, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্য যত আন্তরিকভাবেই আমরা চেষ্টা চালাই না কেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের রাজনৈতিক নেতারা সবসময় আধিপত্যবাদী, শোষণমূলক ও ধ্বংসাত্মক নীতি-কৌশলই অনুসরণ করে এসেছেন। ক্ষমতায় পরিবর্তন ঘটলেও এবং উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের স্থলে কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির মতো ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল নামধারীরা সরকার গঠন করলেও বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতীয়দের নীতি-কৌশল ও মনোভাবে কখনো সামান্য এদিক-সেদিক হয়নি; হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। বাস্তবে বাম-ডান নির্বিশেষে ভারতের সকল নেতা, সেনা অফিসার, গোয়েন্দা এবং কূটনীতিক ও সাংবাদিকদের মধ্যেই বাংলাদেশের প্রতি চরম বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণ দেয়ার জন্য ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর একটি ‘উপদেশের’ কথা স্মরণ করা যেতে পারে। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেয়ার আগে পরামর্শের আড়ালে বলেছিলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত ‘নতুন করে’ চিহ্নিত করা দরকার। পিনাক রঞ্জনের কাছে তখন নতুন কিছু ভয়ঙ্কর তথ্যও জানা গিয়েছিল। যেমন তিনি বলেছিলেন, ‘নতুন করে’ সীমান্ত চিহ্নিত করার বিষয়টি নিয়ে দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী নাকি দুইবার বৈঠক করেছেন এবং আলোচনাও নাকি ‘এগিয়ে’ রয়েছে। বাংলাদেশকে নাকি যে কোনো সময় ‘সারপ্রাইজ’ দেখতে হতে পারে। বিষয়টি আসলেও ‘চমকে’ উঠার মতোই ছিল। কারণ, ‘নতুন করে’ সীমান্ত চিহ্নিত করার ব্যাপারে আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে এবং দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে চুক্তি এখন সময়ের ব্যাপারÑ এমন তথ্য পিনাক রঞ্জন না জানালে বাংলাদেশের মানুষ জানতেই পারতো না!
আরো অনেক উদাহরণই দেয়া সম্ভব। কিন্তু উদাহরণের ভিড়ে যাওয়ার পরিবর্তে বলা দরকার, ভারতীয়দের বাংলাদেশবিরোধী ধারাবাহিক কর্মকা-ের সূত্র ধরেই এবার দৃশ্যপটে এসেছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা সুব্রামনিয়াম স্বামী। তিনি কিন্তু মুদ্রার একটি মাত্র দিকই তুলে ধরেছেন। লক্ষ্য করেননি যে, ‘কান টানলে মাথা আসে’ বলেও একটা প্রবাদ রয়েছে। কথাটা বলার কারণ, একদিকে তিনি বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষকেÑ তা-ও আবার মুসলমানদের ভারতে ঢুকিয়ে ছেড়েছেন, অন্যদিকে স্বীকার করেননি যে, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগকালে সবদিক থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল পূর্ব-পাকিস্তানকেÑ আজকের বাংলাদেশকে। দীর্ঘ সে ইতিহাসের আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। পাঠকরা মরহুম আবুল মনসুর আহমদের ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ গ্রন্থটি পড়ে দেখতে পারেন। ইংরেজি দৈনিক ‘স্টার’-এর সম্পাদক মাহফুজ আনামের পিতা এবং প্রখ্যাত রাজনীতিক-সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ ব্রিটিশ ভারতে প্রথমে শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হকের নেতৃত্বে কৃষক-প্রজা পার্টির এবং পরে অল-ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকার একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। পাকিস্তানের রাজনীতিতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। ১৯৫৬ সালে হোসেন মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে প্রধানমন্ত্রী করে সরকার গঠন করার পর তিনি কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রী হয়েছেন। একাধিকবার ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন। তার গ্রন্থ ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ এখনো এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস জানার একটি প্রধান অবলম্বন। গ্রন্থের কোথাও কোনো ভুল তথ্য রয়েছে কিংবা লেখক ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো তথ্য বিকৃতি ঘটিয়েছেনÑ এমন অভিযোগ কখনো কেউ করেছেন বলে জানা যায়নি। পাকিস্তান আন্দোলন সম্পর্কে তো বটেই, বিশেষ করে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগকালীন ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কেও বিস্তারিতভাবে লিখেছেন আবুল মনসুর আহমদ।
‘কলিকাতার দাবি’ শিরোনামে এক উপ-অধ্যায়ে তিনি জানিয়েছেন, ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে পূর্ব-পাকিস্তানের ভাগে অবিভক্ত বাংলার কোনো কোনো এলাকা আসবে সে বিষয়ে ইংরেজ গভর্নর স্যার আর জে ক্যাসির সঙ্গে কথা বলেছিলেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। গভর্নর ক্যাসি প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীকে জানিয়েছিলেন, কলকাতা এবং দার্জিলিং হবে উভয় বাংলার অর্থাৎ ভারতের বর্তমান রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্ব-পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের ‘কমন’ শহর। এছাড়া কলকাতাসংলগ্ন চব্বিশ পরগনার বারাকপুর, বারাসত, ভাঙ্গর ও বশিরহাটসহ বেশকিছু এলাকা পূর্ব-পাকিস্তানের ভাগে পড়ার কথা ছিল। অন্যসব সূত্রেও জানা গেছে, পলাশীর যুদ্ধের জন্য বিখ্যাত মুর্শিদাবাদ এবং করিমগঞ্জসহ আসামের বিরাট অঞ্চলও পূর্ব-পাকিস্তানকে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে জওয়াহেরলাল নেহরু ও সরদার বল্লভভাই প্যাটেলদের মারপ্যাঁচ এবং ইংরেজ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেনের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে পূর্ব-পাকিস্তান বঞ্চিত হয়েছিল সর্বাত্মকভাবে। এই বঞ্চনা শুধু অঞ্চল না দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, ক্ষতিপূরণ বাবদ নগদ অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রেও পূর্ব-পাকিস্তানকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। উদাহরণ দেয়ার জন্য আবারও আবুল মনসুর আহমদের ওই গ্রন্থের সাহায্য নেয়া যায়। তিনি জানিয়েছেন, কথা ছিলÑ কলকাতার বিনিময়ে পূর্ব-পাকিস্তানকে নগদে ৩৩ কোটি টাকা দেয়া হবে। ঢাকাকে আন্তর্জাতিক মানে রাজধানী হিসেবে সাজিয়ে তোলার খরচ হিসেবে তখনকার দিনে ৩৩ কোটি টাকা যথেষ্ট ছিল। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে নেহরু-প্যাটেলরা চাণক্য হিসেবের কূটচাল চেলেছিলেন। তারা বলেছিলেন, কলকাতার বিভিন্ন স্থাপনার দাম নির্ধারণ করা হবে ‘বুক ভ্যালু’র ভিত্তিতে। অর্থাৎ যখন যেটা নির্মিত হয়েছিল, তখন যত টাকা খরচ হয়েছিল সেটাই হবে বিনিময় মূল্য। অন্যদিকে পাকিস্তানপন্থীরা ক্ষতিপূরণ চেয়েছিলেন ওই সময়ের অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের বাজার দরে। এর ভিত্তিতে টাকা দিতে গেলে ভারতকে শত কোটি টাকার ওপর গুনতে হতো। এজন্যই নেহরু-প্যাটেলরা ‘বুক ভ্যালু’র তত্ত্ব এনেছিলেন। বাস্তবে পূর্ব-পাকিস্তান কিন্তু ‘বুক ভ্যালু’র ভিত্তিতেও টাকা পায়নি। কারণ, এরই মধ্যে আবার ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ পূর্ব-পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন শহরের বিনিময়ে অর্থ দাবি করেছিলেন নেহরু-প্যাটেলরা। রীতিমতো অঙ্ক কষে তারা দেখিয়েছিলেন, ভারতের কাছে পূর্ব-পাকিস্তানের পাওনার পরিমাণ মাত্র ৩ কোট টাকা, অন্যদিকে পূর্ব-পাকিস্তানের কাছে ভারতের পাওনার পরিমাণ ৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ শত কোটি বা ৩৩ কোটি টাকা পাওয়া দূরে থাকুক, পূর্ব-পাকিস্তানকেই উল্টো ৬ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে! এমন এক বিচিত্র পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, “সত্য যুগে ছিল : ‘শুভঙ্করের ফাঁকি, তেত্রিশ থনে তিনশ গেলে তিরিশ থাকে বাকি’; আর কলিযুগে : ‘শুভঙ্করের ফাঁকি, তেত্রিশ থনে শূন্য গেলে দেনা থাকে বাকি’! (পৃষ্ঠাÑ ২৫৭-২৬৭)
বলা দরকার, নেহরু-প্যাটেলদের কূটকৌশলই পূর্ব-পাকিস্তানের বঞ্চিত হওয়ার একমাত্র কারণ ছিল না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল অন্য একটি বিশেষ কারণ। পশ্চিম পাকিস্তানের অবাঙ্গালী নেতৃত্বের পূর্ব-বাংলাবিরোধী নীতি-কৌশলের সুযোগে এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন ভারতের শেষ ইংরেজ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন। তার স্ত্রীর সঙ্গে আগে থেকেই নেহরুর প্রশ্নসাপেক্ষ ও রহস্যময় সম্পর্ক ছিল। তার ওপর ‘জাতির পিতা’ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিজেই পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল হয়ে বসায় মাউন্টব্যাটেন খুবই ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তার ইচ্ছা ছিল, তিনি ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রেরই গভর্নর জেনারেল হবেন। ভারত এতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু অস্বীকার করেছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। এ অসন্তোষেরই ঝাল ঝেড়েছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক অনেক তথ্যেরই উল্লেখ করা এবং বিভিন্ন গ্রন্থেরও উদ্ধৃতি দেয়া সম্ভব। এখানে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেয়া যাক। দেশ বিভাগকালীন ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা দিতে গিয়ে শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘বড়লাট মাউন্টব্যাটেন তলে তলে কংগ্রেসকে সাহায্য করছিলেন। (জিন্নাহ নিজেই গভর্নর জেনারেল হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর) মাউন্টব্যাটেন ক্ষেপে গিয়ে পাকিস্তানের সর্বনাশ করার চেষ্টা করলেন।...’ (পৃষ্ঠাÑ ৭৪)
শেখ মুজিব আরো লিখেছেন, ‘অর্থাৎ দার্জিলিংও আমরা পাব। ... মাউন্টব্যাটেন সুযোগ পেয়ে যশোর জেলায় সংখ্যাগুরু মুসলমান অধ্যুষিত বনগাঁ জংশন অঞ্চল কেটে দিলেন। নদীয়ায় মুসলমান বেশি, তবু কৃষ্ণনগর ও রানাঘাট জংশন ওদের দিয়ে দিলেন। মুর্শিদাবাদে মুসলমান বেশি, কিন্তু সব জেলাই দিয়ে দিলেন। মালদহ জেলায় মুসলমান ও হিন্দু সমান সমান তার আধা অংশ কেটে দিলেন, দিনাজপুরে মুসলমান বেশি বালুরঘাট মহকুমা কেটে দিলেন যাতে জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং হিন্দুস্তানে যায় এবং আসামের সাথে হিন্দুস্তানের সরাসরি যোগাযোগ হয়। উপরোক্ত জেলাগুলো কিছুতেই পাকিস্তানে না এসে পারতো না। এদিকে সিলেটে গণভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও (মাউন্টব্যাটেন) মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ করিমগঞ্জ মহকুমা ভারতবর্ষকে দিয়েছিলেন। আমরা আশা করেছিলাম, আসামের কাছাড় জেলা ও সিলেট জেলা পাকিস্তানের ভাগে না দিয়ে পারবে না। আমার বেশি দুঃখ হয়েছিল করিমগঞ্জ নিয়ে।... যে কলকাতা পূর্ব-বাংলার টাকায় গড়ে উঠেছিল, সেই কলকাতা আমরা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলাম।... কলকাতা পাকিস্তানে থাকলে পাকিস্তানের রাজধানী কলকাতায় করতে বাধ্য হতো। কারণ, পূর্ব-বাংলার লোকেরা দাবি করত, পাকিস্তানের জনসংখ্যায়ও তারা বেশি আর শহর হিসেবে তদানীন্তন ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ শহর কলকাতা।...’ (পৃষ্ঠা- ৭৮-৭৯)
দেখা গেল, বয়সে প্রবীণ আবুল মনসুর আহমদ থেকে কিছুটা নবীন নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পর্যন্ত প্রত্যেকেই যে বর্ণনা দিয়েছেন, সে অনুযায়ী দেশ বিভাগকালে পূর্ব-পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে ব্যাপকভাবেই বঞ্চিত হয়েছিল। কথাটা বিশেষ করে সুব্রামনিয়াম স্বামীরা মনে রাখলে সবার জন্যই মঙ্গল। প্রসঙ্গক্রমে এখানে ঐতিহাসিক অন্যকিছু তথ্যেরও উল্লেখ করা দরকার। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ভারতের বঙ্গ নামক কলকাতাকেন্দ্রিক প্রদেশের অংশ ছিল। পরিচিতি ছিল পূর্ববঙ্গ নামে। কিন্তু ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে মুসলিম প্রধান এ অঞ্চলের সঙ্গে মূল ভারতের দ্বন্দ্ব ক্রমাগত বাড়তে থাকে। দু-চারজন ছাড়া জমিদারদের প্রায় সবাই ছিলেন হিন্দু। মুসলমান কৃষকদের ওপর হিন্দু জমিদাররা যথেচ্ছ শোষণ-নির্যাতন চালাতেন। মুসলমানরা এমনকি জমিদার বাড়ির আশপাশ দিয়ে জুতো পরে বা ছাতা মাথায় দিয়ে যাতায়াত করতে পারতেন না। ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরি ছিল হিন্দুদের দখলে। শিক্ষাতেও হিন্দুরাই একচেটিয়াভাবে এগিয়ে ছিল। সবমিলিয়েই মুসলমানরা ছিলেন নির্যাতিত, উপেক্ষিত ও পশ্চাৎপদ অবস্থায়।
হিন্দুদের প্রাধান্য বহাল রেখে মুসলমানদের পক্ষে যেহেতু উন্নতি-অগ্রগতি অর্জন করা একেবারেই সম্ভব ছিল না, সেহেতু মুসলিম প্রধান পূর্ববঙ্গ ও প্রতিবেশী রাজ্য আসামকে নিয়ে পৃথক একটি প্রদেশ গঠনের দাবিতে মুসলমানরা আন্দোলন গড়ে তোলেন। আন্দোলনের চাপে ব্রিটিশ সরকার ১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসামকে নিয়ে নতুন একটি প্রদেশ গঠন করে। ঢাকাকে এর রাজধানী করা হয়। এটাই ইতিহাসে ‘বঙ্গভঙ্গ’ নামে পরিচিত। এর ফলে ঢাকাসহ বর্তমান বাংলাদেশের দ্রুত উন্নতি হতে থাকে। কিন্তু মুসলমানদের এই উন্নতি ও সম্ভাবনার বিরুদ্ধে হিন্দুরা পাল্টা তৎপরতা শুরু করে। কারণ, হিন্দুদের দৃষ্টিতে এটা ছিল তাদের ‘বঙ্গমাতা’কে দ্বিখ-িত করার পদক্ষেপ। কলকাতায় বসবাস করে পূর্ববঙ্গের ওপর যারা শোষণ-নির্যাতন চালাতেন এবং এখানকার অর্থবিত্ত লুণ্ঠন করে নিয়ে গিয়ে সেখানে বসে যারা নাচ-গান ও আনন্দ-ফূর্তি করতেন, সেই হিন্দু জমিদারদের প্রত্যক্ষ সাহায্যে ও উস্কানিতে সন্ত্রাসবাদী কর্মকা- দুর্বার হয়ে উঠে। হিন্দুরা একে সন্ত্রাসবাদী ‘আন্দোলন’ নাম দেয়। এ সময়ই বঙ্গভঙ্গের তথা বাংলাদেশের বিরোধিতা করে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি লিখেছিলেন। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস হলো, যে দেশের বিরুদ্ধে লেখা, সে বাংলাদেশেই গানটিকে তার জাতীয় সঙ্গীত বানিয়েছে! উল্লেখ্য, হিন্দুদের সন্ত্রাসবাদী কর্মকা-ে ভীত হওয়ার অভিনয় করে মুসলিমবিরোধী ব্রিটিশ সরকারও হিন্দুদের ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করে। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়, ঢাকাসহ পূর্ববঙ্গ আবারও কলকাতার এবং হিন্দুদের অধীনস্থ হয়ে পড়ে। হিন্দুদের মধ্যে যে ‘বঙ্গমাতা’র জন্য প্রীতির লেশমাত্র ছিল না এবং মুসলিম বিদ্বেষই যে ‘বঙ্গভঙ্গ’ বিরোধিতার প্রধান কারণ ছিলÑ তার প্রমাণ পাওয়া গেছে একটি বিশেষ ঘটনায়। সন্ত্রাসের অভিযোগে শত বছরের রাজধানী কলকাতাকে পরিত্যাগ করে ব্রিটিশ সরকার এ সময় ভারতের রাজধানী নিয়ে গিয়েছিল দিল্লীতে। কিন্তু হিন্দুরা কোনো প্রতিবাদই করেনি। এ ব্যাপারেও রবীন্দ্রনাথের উদাহরণ না দিয়ে উপায় নেই। ‘বাঙালী’ হিসেবে দায়িত্ব যেখানে ছিল রাজধানী সরিয়ে নেয়ার বিরোধিতা করা রবি ঠাকুর সেখানে উল্টো ইংরেজ রাজার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বিনয় ও ভক্তির ন্যক্কারজনক প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। রাজাকে ভারতের ‘ভাগ্য বিধাতা’ হিসেবে উল্লেখ করে লিখেছিলেন, ‘জয় হে, জয় হে!’ স্মরণ করা দরকার, ‘ভাগ্য বিধাতা’ ও ‘জয় হে’যুক্ত রবীন্দ্রনাথের সে গানটিই এখন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত! বলা দরকার, ‘বাঙালী’ রবীন্দ্রনাথরা মুসলিমবিরোধী ইংরেজের কাছে মাথা নত করে ধন্য হলেও ভারতের মুসলমানদের হিন্দু ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ক্রমাগত আরো শক্তিশালী ও সর্বাত্মক হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে সেটাই মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমির আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ছিল সে আন্দোলনেরই সফল পরিণতি।
পরবর্তীকালে ‘পশ্চিম-পাকিস্তান’কেন্দ্রিক শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করলেও বাংলাদেশের জনমনে ভারত সম্পর্কে মনোভাবে পরিবর্তন ঘটেনি। ভারত নিজেই তা ঘটতে দেয়নি। ভারত বরং শত্রুতাপূর্ণ আচরণ করেছে। ভারতীয়দের নীতি-অবস্থান ও কর্মকা- যে এখনো একই রকম রয়েছেÑ তার সর্বশেষ প্রমাণ পাওয়া গেছে বিজেপি নেতার দাবি ও বক্তব্য থেকে। এখানে শুধু একটি কথা জানিয়ে রাখা দরকার। মিস্টার স্বামীদের কথামতো অতীতের দিকেই যদি ফিরতে হয়, তাহলে মুর্শিদাবাদ ও দার্জিলিং হয়ে কলকাতার পাশাপাশি আসাম ও ত্রিপুরা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা উল্টো বাংলাদেশকেই দিতে হবেÑ এটাই ইতিহাস নির্ধারিত সত্য। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে অবশ্য কিছুই আশা করা যায় না। সুব্রামনিয়াম স্বামীদের দাঁতভাঙা জবাব দেয়াসহ যা কিছু করার সবকিছু দেশপ্রেমিকদেরই করতে হবে। দেশপ্রেমিকরা নিশ্চয়ই অনুধাবন করবেন, স্বাধীন হলেও রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এখনো ভৌগোলিক দিক থেকে অসম্পূর্ণ রয়েছে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন