বর্তমান নির্বাচন কমিশনের চূড়ান্ত
অপদার্থতার মুখে অনেকেই সামরিক সরকারের অধীনে এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচন
কমিশনের প্রশংসা করেছেন। কেউ কেউ তা করেই যাচ্ছেন। তাদের বক্তব্য হলো, শামসুল হুদার আমলে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। অতএব, সে নির্বাচনটি ছিল উত্তম। প্রাণহানি হয়েছে কি হয়নি তার সাথে নির্বাচনের উত্তম
অধমের কোনো সম্পর্ক নেই। সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল মইন ইউ আহমেদের প্রচ্ছন্ন সামরিক
শাসনের অধীনে। সেটি যে পাতানো নির্বাচন ছিল তা এ দেশের মানুষ যেমন উপলব্ধি করেছে, তেমনি দেশ-বিদেশের খেলোয়াড়েরাও গোপন রাখার চেষ্টা করেননি। সেই পাতানো নির্বাচনের
মূল নট ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন সে
কথা শেখ হাসিনাকে ড. ইউনূস ইস্যুতে স্মরণও করিয়ে দিয়েছিলেন। তা ছাড়া ওই নির্বাচনের
সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মরহুম আবদুল জলিল। পরে তিনিও প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি ছিল আঁতাতের। এ কথা বলায় আবদুল জলিলকে
কম নাজেহাল হতে হয়নি। এমনকি শেখ হাসিনা তাকে দলের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে কার্যত গলাধাক্কা
দিয়ে বিদায় করে দিয়েছিলেন।
২০০৮ সালের
ওই নির্বাচনে আমরা অনেক কিছু প্রত্যক্ষ করেছি। ওই নির্বাচনের আগে আমরা লক্ষ করেছি যে, মইন ইউ আহমেদের প্রচ্ছন্ন সামরিক সরকার ক্রমেই জনরোষের শিকার হয়ে পড়ছিল। দুই
বছর ধরে সেনাবাহিনীকে দিয়ে যাচ্ছেতাই পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছিলেন জেনারেল মইন।
সেনাসদস্যদের এমন সব অদ্ভুত ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল যে, তারা একেবারে ‘ধরাকে সরাজ্ঞান’ করছিল। বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদদের ওপর তারা যে ধরনের
নির্যাতন চালিয়েছিল, তা ছিল কল্পনার অতীত। আমরা তখন লিখতে বাধ্য হয়েছিলাম, ‘এই সেনাসদস্য বা কর্মকর্তারা কি আমাদের ভাই, আমাদের সন্তান বা স্বজন নয়?’ যৌথবাহিনীর অভিযানের নামে ব্যাপক দুর্নীতিও হচ্ছিল। সে দুর্নীতি কী মাত্রায়
পৌঁছেছিল, তার একটা সামান্য উদাহরণ দেয়া যায়। তখন বিজিএমইএর সভাপতি ছিলেন
আনিসুল হক। তিনি হঠাৎ করেই দাবি তুললেন, ‘দুর্নীতি রোধ করার জন্য ৫০০ টাকার
সব নোট বাতিল করা হোক।’ অর্থাৎ দুর্নীতির সব নোট দুর্নীতিবাজদের ঘরে ঘরেই
আছে। বাতিল করা হলে তা প্রকাশ হয়ে পড়বে।
এই দাবি
উত্থাপনের সাথে সাথেই যেন এক বিরাট তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছিল। সরকারের তরফ থেকে মুহুর্মুহু
ঘোষণা আসছিল যে, সরকার ৫০০ টাকার নোট বাতিলের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। তখনো এক হাজার
টাকার নোট চালু হয়নি; কিন্তু ওই দাবি উত্থাপনের সাথে সাথেই সরকার কেন
এতটা বিপদে পড়ে গেল যে, কয়েক দিন ধরে অবিরাম রেডিও-টেলিভিশনে প্রচার করতে
হলো, ৫০০ টাকার নোট বাতিল হয়নি। এই প্রচারণার কারণেই মানুষ বিশ্বাস
করতে শুরু করেছিল, ৫০০ টাকার নোট বাতিল হলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে হঠাৎ বিপুল টাকার
মালিক হওয়া ব্যক্তিরা। আর স্বাভাবিকভাবেই সে টাকার মালিক হিসেবে সেনাকর্মকর্তাদেরই
সন্দেহ করা হচ্ছিল। বড় বড় জেনারেলের কাছে শুনেছি, সেনাবাহিনীকে কখনো তিন মাসের
বেশি ব্যারাকের বাইরে রাখতে নেই। যদি রাখা হয় তবে সেখানে দুর্নীতি বাসা বাঁধতে বাধ্য।
মইন ইউ আহমেদের সেনাশাসনকালে তারা দুই বছর ব্যারাকের বাইরে ছিল। কী ঘটেছিল তার সুস্পষ্ট
কোনো পরিসংখ্যান কোনো দিন প্রকাশিত হয়নি; হয়তো হবেও না।
জেনারেল
মইন দেশকে রাজনীতিশূন্য করতে চেয়েছিলেন। প্রাথমিকভাবে তিনি এমন ভাব ধরেছিলেন যে, বিশৃঙ্খলা রোধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে তিনি আপাতত ক্ষমতায় আসীন
রয়েছেন। দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার কোনো অভিপ্রায় তার নেই। এতে ভারতের কিছু আসে যায়
না, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সামরিক শাসনের প্রতি সরাসরি সমর্থন
ভালো দেখা যেত না। আর সে কারণেই শিখণ্ডী হিসেবে সাবেক বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তা ও মার্কিন
নাগরিক ফখরুদ্দীন আহমদকে সামনে রেখে বাংলাদেশে প্রচ্ছন্ন সামরিক শাসন জারি করা হয়েছিল।
কিন্তু ভারত কোনো রাখঢাক করেনি। মইন ইউ আহমেদকে ক্ষমতায় বসানোর পর ভারত তাকে প্রেসিডেন্ট
ও প্রধানমন্ত্রীর সমমর্যাদায় লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়েছিল। তখন আমাদের কাছে অস্পষ্ট
ছিল না যে, ভারতীয় শাসকদের মতলব কী। ভারত মইনকে ছয়টি ট্রয়ের ঘোড়া উপহার দিয়েছিল।
বিনিময়ে মইন ঢাকা-কলকাতা ট্রেন সার্ভিস চালু করেন। আর ভারতকে বহুবিধ বাংলাদেশবিরোধী
সুবিধা দেয়ার অঙ্গীকার করে আসেন।
ভবিষ্যতে
তাদের মতো করে নির্বাচন করতে পারে, সে আশা নিয়ে মইন এ টি এম শামসুল
হুদাকে দিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করেছিলেন। নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান।
একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ভেঙে দেয়ার কতকগুলো নিয়মকানুন আছে। কিন্তু মইন সে নিয়মকানুনের
ধার ধারেননি। নির্বাচন কমিশন ও বিচার বিভাগকে পর্যুদস্ত করার জন্য তিনি এক অদ্ভুত রেওয়াজ
চালু করেন। সেটি হলো রাষ্ট্রপতির চায়ের দাওয়াত। তখন নির্বাচন কমিশন বা বিচার বিভাগ
বা সাংবিধানিক কোনো প্রতিষ্ঠানের কাউকে রাষ্ট্রপতি চায়ের দাওয়াত দিলে আমরা সাধারণ নাগরিকেরাও
বুঝে যেতাম যে, হয় তাকে যেতে হবে নতুবা এই অসাংবিধানিক সরকার যা চায় তাকে তাই
করতে হবে। সে রকম চায়ের দাওয়াত দিয়ে মইন বিদায় করেছিলেন তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার
এবং অন্য কমিশনারদের। তারপর নিয়োগ দিয়েছিলেন শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনকে।
এই নিয়োগ কোনো ভদ্রলোক কিভাবে গ্রহণ করতে পারেন, সেটিও বিবেচনার দাবি রাখে। শামসুল
হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন একবারও ভাবেনি, যারা অসাংবিধানিকভাবে আদর করে
তাদের কোলে তুলে নিলো, তারা লাথি মেরে তাদের বিদায়ও করে দিতে পারে। তখন
স্পষ্টই বোঝা গিয়েছিল যে, নবগঠিত এই নির্বাচন কমিশন মইনরা যা বলবেন, সে আদেশ শিরোধার্য করে নেবে।
জেনারেল
মইন যখন ক্ষমতার স্বাদ পেতে থাকলেন, তখন ক্ষমতা না ছাড়ার হাজারও ফন্দি-ফিকির
করতে লাগলেন। একবার বললেন, রাষ্ট্রক্ষমতায় যেই থাকুক, সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব থাকবে তাদের সবার ওপরে। এমনিভাবে একেক সময় একেক তত্ত্ব
ফখরের মাধ্যমে তিনি ঝেড়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু তত দিনে তার ক্ষমতার ভিত্তি বড় নড়বড়ে
হয়ে গেছে। জনরোষ এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, তার পক্ষে আর ক্ষমতা ধরে রাখা
সম্ভব হচ্ছিল না। অন্য দিকে তার এসব ক্ষমতালিপ্সার কারণে সেনাবাহিনীও সঙ্কটে পড়ার উপক্রম
হয়েছিল। তখন তার প্রভু যুক্তরাষ্ট্র-ভারতও প্রমাদ গুনতে শুরু করেছে। তারা স্পষ্টই বুঝতে
পারলেন, এদের ক্ষমতায় রাখলে জনরোষে বাংলাদেশে তাদের অস্তিত্বও বিপন্ন হয়ে
পড়বে। আর তাই বিকল্প নেতৃত্বের সন্ধান। সেই সন্ধানে আঁতাত হয়ে গেল আওয়ামী লীগের সাথে।
কে কোথায় দাঁড়াবে, কে কোথায় জিতবে তার নীলনকশা প্রণীত হলো। আওয়ামী লীগ কত আসন পাবে, বিএনপিকে ক’টা আসন দেয়া হবে তাও আগে থেকে নির্ধারণ করা হয়ে
গেল।
শামসুল
হুদা কমিশন ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে এক আজব নির্বাচন করল। পেছনে সামরিক সরকার ছিল বলে
রক্তক্ষয় তেমন হলো না। বহু ক্ষেত্রে ভোট পড়ল শতভাগের ওপর। ব্যালটের মুড়ি পাওয়া যেতে
থাকল রাস্তাঘাটে, ভোটকেন্দ্রের পেছনে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা এসব মুড়ি সংগ্রহ
করে মিডিয়ার সামনে তুলে ধরলেন। তখন বশংবদ নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করল, মুড়ি যার কাছে পাওয়া যাবে তাকে গ্রেফতার করা হবে। অর্থাৎ ভোট ডাকাতি যেই করুক
তার প্রমাণ তুলে ধরলেই শাস্তি। সেই কমিশনের এক সদস্য এখন টকশোতে টেলিভিশন কাঁপান। তখন
বলতে পারেননি, এগুলো সঠিক কাজ হচ্ছে না। অর্থাৎ নির্বাচন নিয়ে কারচুপি, ডাকাতির দোসর ছিলেন তারা।
ওই নির্বাচনের
আগে আরো অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটেছিল। মইন গং প্রথমে বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা করে আবদুল মান্নান
ভূঁইয়াকে দিয়ে। মান্নান ভূঁইয়া আর কিছু লাফাঙ্গা নিয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে মাইনাস করে
এক নতুন বিএনপি গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। তখন বেগম জিয়া মান্নান ভূঁইয়াকে দল থেকে
বহিষ্কার করেন। এর প্রতিবাদে একেবারে সোচ্চার হয়ে ওঠেন তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার
এ টি এম শামসুল হুদা। মান্নান ভূঁইয়া বিএনপি সরকারে এই শামসুল হুদাকে বড় চাকরি পাইয়ে
দিয়েছিলেন। তখন হুদার সে কী রুদ্রমূর্তি। তিনি বললেন, ‘কোন এখতিয়ারে মান্নান ভূঁইয়াকে বহিষ্কার করলেন বেগম খালেদা জিয়া? মান্নান ভূঁইয়া এত বছর রাজনীতি করেছেন, চাইলাম আর তাকে বহিষ্কার করে
দিলামÑ সেটি হবে না।’ যেন বিএনপি পরিচালনার দায়দায়িত্ব
তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। তার ভাবখানা এমন ছিল, যেন বিএনপির মহাসচিব হিসেবে মান্নান
ভূঁইয়া সরকারি চাকরি করেন, আর সরকারি চাকরি হিসেবে কে কোথায় থাকবে না থাকবে
নির্বাচন কমিশনার হিসেবে তিনি নির্ধারণ করে দেবেন। সীমানা লঙ্ঘনকারী আর কাকে বলে!
এর পরে
এসেছে কাজী রকিবউদ্দীনের নির্বাচন কমিশন। তারা যে অথর্ব, সেটি আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। তিনি একই সাথে কাণ্ডজ্ঞানহীন ও দায়িত্বহীন।
আর কমিশনে তার যারা সহযোগী, তারা অভব্য ও সংস্কৃতিবির্জিত। উচ্চপদে থাকলে তার
ভুলত্রুটির সমালোচনা তো হবেই। এই তল্পিবাহক যে ভাষায় বিরোধী দলের সমালোচনা করেছেন, তা ভদ্রতার ভাষা নয়। এদের নিয়েই নির্বাচন কমিশন। কার্যত এরা আওয়ামী সরকারের
ধামাধরা। সরকারের চাওয়ার বাইরে যেন এদের কোনো কিছু করার সাহস নেই। প্রথম ও দ্বিতীয়
দফা উপজেলা নির্বাচনের পর যখন দেখলেন যে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি একেবারে নিশ্চিত, জনগণ দলটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তখন রকিব বিনোদনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে
পাড়ি দিলেন। অনেকে বলেন, কিভাবে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে জেতাতে হবে তার একটা
নীলনকশা তৈরি হয়েছিল। সেভাবেই কারচুপি ও ভোট ডাকাতির উৎসব হয়ে গেল পরবর্তী তিন দফা
উপজেলা নির্বাচনে।
কেউ কেউ
বলার চেষ্টা করেছিলেন, রকিবউদ্দীন মনের দুঃখে নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে
সরে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু এ তত্ত্ব সচেতন কেউই বিশ্বাস করেনি। কারণ দেড় মাস পরে, অর্থাৎ ভোট লুটপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে দেশে ফিরে রকিবউদ্দীন বলেছেন, ‘ভোট নিয়ে যে সহিংসতা হয়েছে তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তিনি দেশে থাকলেও এ সহিংসতা
হতে পারত।’ যেন সহিংসতা হলে হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের তাতে কী করার
আছে? তার এক সহকর্মী তো বলেছেনই, আমাদের কাজ নির্বাচন করা। আইনশৃঙ্খলা
রক্ষার কাজ প্রশাসনের। নির্বাচনের আগের দিন প্রার্থীদের কেন গ্রেফতার করা হলো, এজেন্টদের কেন গ্রেফতার করা হলো, তার জবাবে ওই ব্যক্তি বলেছেন, ‘পুলিশের কাজ পুলিশ করেছে। আমাদের কী করার আছে?’ এদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন হয়? শামসুল হুদাকেই উদ্দেশ করে ছি
ছি (সিইসি) বলেছি। এদের শুধু আরেকটি ছি যুক্ত করতে পারি। এদেরকে বলতে পারি ছি ছি ছি।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন