বিদ্যুৎ করিডোর কী? ভারত তার এক রাজ্যের উৎপাদিত বিদ্যুৎ অন্য রাজ্যে নিয়ে যাবে বাংলাদেশের ভূখণ্ড
ব্যবহার করে। আরো পরিষ্কার করে বললে, ভারত তার অরুণাচল প্রদেশের উৎপাদিত
জলবিদ্যুৎ আসামের রাঙ্গুনিয়া বা রাওতা থেকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে
বাংলাদেশের জামালপুর বা দিনাজপুর (বড়পুকুরিয়া) দিয়ে পঞ্চিমবঙ্গের বনগাঁও নিয়ে যাবে।
বিনিময়ে বাংলাদেশকে কিছু (?) দেয়া হবে। অল্প কথায় একেই বলা হচ্ছে বিদ্যুৎ করিডোর।
গত বৃহস্পতিবার
ঢাকার রূপসী বাংলা হোটেলে অনুষ্ঠিত ভারত-বাংলাদেশ যৌথ স্টিয়ারিং কমিটির মিটিংয়ে ভারতকে
বিদ্যুৎ করিডোর দেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার নীতিগতভাবে রাজি হয়েছে। বৈঠক-পরবর্তী সাংবাদিকদের
প্রশ্নের জবাবে জানানো হয়, প্রাথমিকভাবে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালন
হবে, বাংলাদেশ অংশে পিজিসিবি (পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ) উচ্চ
ক্ষমতাসম্পন্ন এই সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করবে এবং ভারত অংশে সে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান
পিজিসিআই (পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব ইন্ডিয়া) সঞ্চালন নির্মাণ করবে। আগামী ছয় মাসের
মধ্যে টেকনিক্যাল কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করবে। ২০১৭ সাল নাগাদ এ লাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ
সঞ্চালন শুরু হবে বলে বৈঠকে আশা প্রকাশ করা হয়। এই বিদ্যুৎ করিডোরের মাধ্যমে আমরা কী
পাবোÑ এমন প্রশ্নের খুব সহজ-সরল লাভক্ষতির হিসাব এখনো কষা হয়নি।
সচিবপর্যায়ের
বৈঠকে এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণে মানুষের মাঝে বিরাট প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। আমরা বাংলাদেশের
প্রজন্ম এরূপ একটি জাতীয় সংবেদনশীল বিষয়ে দুই দেশের সরকারের কর্মকাণ্ডে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন।
কারণ বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বিদ্যুৎ যাবে ভারতে আর বাংলাদেশের কর্তাব্যক্তিরা এখনো জানেন
না বিনিময়ে আমরা কী পাবো। মনে হচ্ছে যেন, আমরা বিদ্যুৎ করিডোর দিতে পারছি
এটাই আমাদের গর্বের বিষয়, আর কী প্রয়োজন। আমরা মনে করি, বিষয়টি আমাদের জাতীয় সার্বভৌমের বিষয়, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত বা জাতীয় পার্টির দলীয় কোনো এজেন্ডা নয়। আমরা আশা করি, আমাদের সরকার জাতীয় সার্বভৌমত্বের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত
নেবে। সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কথা নিশ্চয় বিবেচনা করতে হবে, কৌশলী পদক্ষেপ নিতে হবে, কোনো রকম লুকোচুরি এ দেশের জনগণ মানবে না।
ভারত আমাদের
নিকটতম প্রতিবেশী। আমরা চাই ভারতের সাথে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে এ অঞ্চলের মানুষের
অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য কাজ করতে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, ভারত সবসময় তার আগ্রাসী আচরণ দ্বারা আমাদের ইংরেজ আমলের, পাকিস্তান আমলের দুঃশাসন শোষণের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষের
অনেক ন্যায্য হিস্যা তারা এখনো দেয়নি। অনেক দিন আগের কথা নয়, গত বছরের কথা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির
স্বাক্ষর করতে এসেও চুক্তি না করে ঘুরে গেলেন। পুরো বিষয়টি আমাদের কাছে ভারতের সাজানো
নাটক মনে হয়েছে। সীমান্তে বাংলাদেশের মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে ভারত। সারা বিশ্ব
তা প্রত্যক্ষ করল নির্মম ফেলানী হত্যার দৃশ্য দেখে। বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠল। অথচ
এরূপ একটি অমানবিক হত্যা বিষয়ে সে দেশের আদালত যে রায় দিয়েছে তা রীতিমতো আমাদের সাথে
ঠাট্টা-মশকারার মতো। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভারত এ দেশের গণমানুষের মতামতকে সম্পূর্ণরূপে
অগ্রাহ্য করে একতরফা নির্বাচনের পথে আওয়ামী লীগকে ইন্ধন জুগিয়েছে, একটা অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে। বাংলাদেশের মানুষের মনে তাই
ভারতকে নিয়ে অবিশ্বাসের প্রশ্ন আরো ঘনীভূত হয়েছে।
ধরে নিলাম
২০১৭ সালে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালন হবে এবং বাংলাদেশ ১০% অর্থাৎ ৬০০ মেগাওয়াট
পাবে। ২০১৭ সালে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎপ্রাপ্তির আশায় আমরা আমাদের সার্বভৌমত্ব হুমকির
মধ্যে ফেলব। আমাদের এ-ও মনে রাখতে হবে, ভারতের পানি আগ্রাসনের কারণে
আমাদের উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হতে চলেছে, পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে।
ভারত যে বিদ্যুৎ বাংলাদেশের ওপর দিয়ে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা করছে তা-ও উৎপন্ন হবে নদীতে
বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে। এর অনেক নদীই আমাদের দুই দেশের অভিন্ন নদী।
এ সব নদীতে বাঁধ দেয়ার কারণে বাংলাদেশকে মরুভূমিকরণের পথ আরো সুগম হবে। অর্থাৎ জলবিদ্যুৎ
প্রকল্পের মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে প্রকারান্তরে
আমরা ভারতকে বাংলাদেশকে মরুভূমিকরণের লাইসেন্স দিচ্ছি কি না তা ভেবে দেখতে হবে। তা
ছাড়া ভারতের এক রাজ্যের বিদ্যুৎ অন্য রাজ্যে পরিবহনের করিডোর দিয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট উৎপাদক
রাজ্যের রোষানলে পড়ছি কি না।
আমরা মনে
করি, এসব বিষয়ের চুলচেরা ভূ-রাজনৈতিক ও টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ করবেন, জাতিকে অবহিত করবেন। নতুন কোনো সিদ্ধান্তের আগে ভারতের সাথে দীর্ঘ দিন ঝুলে
থাকা বিষয়গুলোর সম্মানজনক সমাধান হবে। তার আগে লুকোচুরি করা কোনো চুক্তিই এ দেশের মানুষ
মানবে না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন