মানুষ প্রতিমুহূর্তে, প্রতিক্ষণে কামনা করে সুসংবাদ; কিন্তু এর পরও মানুষ শুধু সুসংবাদই
পায় না, তাদের দুয়ারে এসে হানা দেয় দুঃসংবাদও। শুধু ব্যক্তিজীবনেই নয়, ব্যক্তিকে ছাপিয়ে পরিবার, সমাজ ও জাতীয় জীবনের বেলায় এ কথাটি খাটে; কিন্তু সুসংবাদের পরিমাণকে যদি দুঃসংবাদের পরিমাণটা ছাড়িয়ে যায়, তখন সেই দুঃসংবাদের ভার বইতে সত্যিই আমাদের বড় কষ্ট হয়। তা সেই দুঃসংবাদ আসুক
যেকোনো পর্যায়েই ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জাতীয় পর্যায়ে কিংবা অন্য
কোনো পর্যায়েই। আমাদের এই প্রিয় বাংলাদেশ বুঝি আজ সুসংবাদের তুলনায় দুঃসংবাদের মুখোমুখি
অনেক বেশি মাত্রায়। তাই ‘ভালো আছি’ উচ্চারণ করাও যেন আমাদের জন্য
নিষিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। কারণ আমাদের সারাক্ষণই যেন কোনো না কোনো দুঃসংবাদের সাথে বাস করতে
হচ্ছে।
গত শুক্রবার
দেশের প্রায় সব জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছে একটি দুঃসংবাদ। কী ভয়াবহ সংবাদ! গত বছর ৪ ডিসেম্বর
রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে একই রাতে অপহরণের শিকার হন আট যুবক। সেই থেকে এরা
নিখোঁজ। ‘র্যাব’ লেখা পোশাক পরে, ‘র্যাব-১’ লেখা গাড়িতে তাদের র্যাবের লোকেরা উঠিয়ে নিয়ে গেছে বলে স্বজনদের অভিযোগ। নিখোঁজ
ব্যক্তিদের স্বজনেরা গত বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস কাবে সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ প্রশাসনের প্রতি আকুতি জানিয়ে বলেছেন ‘আমাদের সন্তানদের ফিরিয়ে দিন।’ সংবাদ সম্মেলনে কান্নায় ভেঙে
পড়েন এরা। কথা বলতে গিয়ে গলা আটকে আসে এদের। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে পানি। কারো অবুঝ সন্তানের
কান্না থামানোই যাচ্ছিল না। এভাবেই এরা কাঁদছেন পাঁচ মাস ধরে। এদের কেউ হারিয়েছেন ছেলে, কেউ হারিয়েছেন স্বামী, কেউ ভাই, কেউ বাবা। পরিবারের সদস্যদের
প্রশ্ন কী তাদের অপরাধ? কেন তাদের অপহরণ করে গুম করা
হলো? এরা কোনো অপরাধ করে থাকলে এদের বিচার হবে, শাস্তি হবে। অপহরণের শিকার হবে কেন? র্যাবের পরিচয়ে একই রাতে তুলে
নেয়া এই আটজনের মধ্যে আছেন বিএনপির ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম
ও তার খালাতো ভাই জাহিদুল করিম তানভির। সংবাদ সম্মেলনে এদের ‘গুম’ করার অভিযোগ করে অবিলম্বে তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি
তোলা হয়। ব্রিফিংয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল, আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা: জাফরুল্লাহ
চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
না, অপহরণের এই দুঃসংবাদের এখানেই শেষ নয়। গত ১৮ এপ্রিল মানবাধিকার সংস্থা আইন
ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে ২৬৮
জন অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৪৩ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। অপহরণের পর ছেড়ে দেয়া হয়
২৪ জনকে; কিন্তু ১৮৭ জনের কোনো খোঁজ নেই। এরা বেঁচে আছেন, না মারা গেছেন তা কেউ জানে না। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে ৩৯টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে।
এদের মধ্যে ছাত্রলীগের চারজন, জামায়াত-শিবিরের দু’জন, বিএনপির ১১ জন, ব্যবসায়ী তিনজন, চাকরিজীবী চারজন এবং সাধারণ নাগরিক ১১ জন। এই ৩৯ জনের মধ্যে ১২ জনের লাশ পাওয়া
যায়। অপহরণের পর ছেড়ে দেয়া হয় চারজনকে। অন্য ২৩ জনের কোনো খোঁজ নেই।
গত ২৬
মার্চ স্বাধীনতার চেতনা আর দেশাত্মবোধ প্রদর্শনের অন্য ধরনের আয়োজনের মধ্য দিয়ে ‘লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা’ জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টি করে আমাদের
৪৩তম স্বাধীনতা দিবস পালন করলাম, তখন এর আগের দিন একটি জাতীয় ইংরেজি দৈনিকের একটি
সচিত্র সংবাদ আমাদের মর্মে আঘাত হেনে প্রশ্ন জাগায় চার দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে আমাদের
প্রিয় বাংলাদেশ আজ কোথায় দাঁড়িয়ে? ইংরেজি দৈনিক ডেইলি অবজারভারের ২৫ মার্চ ২০১৪ সংস্করণে
‘পুওর মাদার সেলস হার নিউবর্ন’ শীর্ষক সংবাদে জানায় চল্লিশ বছর বয়সী মিনা বেগম থাকেন একটি ভাড়া করা ঘরে। তিনি এক পুত্রসন্তান জন্ম
দেন। তার দুই মাসের ঘরভাড়া দুই হাজার টাকা বকেয়া পড়েছে। কিছুতেই ভাড়ার টাকা শোধ করতে
পারছেন না। বাড়িওয়ালা মাসুদের স্ত্রী তাকে ঘর ছাড়তে বাধ্য করেন। মিনা বেগম এর পরও ভাড়ার
টাকা জোগাড় করতে পারেননি। ফলে বাধ্য হয়ে মিনা বেগম তার নবজাতক সন্তানকে রাশেদা বেগম
নামের এক বন্ধ্যা মহিলার কাছে বিক্রি করেছেন। যে দেশে এখনো একজন মাকে জীবিকার
তাগিদে তার নবজাতককে বিক্রি করতে হয়, সে দেশে আড়াই লাখের মতো মানুষ
জড়ো করে ‘লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা’ গেয়ে ঘটা করে স্বাধীনতা উৎসব
পালন কতটা যুক্তিযুক্ত, সে প্রশ্ন আসে বৈকি। তা ছাড়া আমাদের প্রধানমন্ত্রী
যখন বলেন দেশের মানুষ এখন সুখে আছে, এরা এখন দিনে চারবেলা ভাত খায়; তখন এ সংবাদ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য কতটুকু সমর্থন করে সে প্রশ্নও ওঠে। শুধু মিনা বেগমেই যদি জীবন-জীবিকার তাগিদে তার সন্তান বিক্রির
ঘটনা সীমিত থাকত, তাহলে হয়তো একে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে না হয় চালিয়ে দেয়া যেত; কিন্তু ঘটনাচিত্র ভিন্ন কিছু। প্রায়ই আমরা অভাবের তাড়নায় মা-বাবাকে সন্তান
বিক্রির মতো নিষ্ঠুর পথ বেছে নেয়ার খবর গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পারি। দুধের শিশুকে ডাস্টবিনে
কিংবা অন্য কোনো স্থানে ফেলে যেতে দেখি। অভাবের তাড়নায় বাবা-মা সন্তান হত্যা করে নিজেরা
আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে দেখি। এ ধরনের ঘটনা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জাজনক।
লজ্জাজনক
দুঃসংবাদ নিয়েই যেন বসবাসের নিয়তি আমরা বেছে নিয়েছি। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির বর্ষপূর্তি
গেল গত ২৪ এপ্রিল। এ ট্র্যাজেডির শিকার হয়ে প্রাণহানি ঘটেছে এক হাজার ১৩৫ জনের। আহত
হয়েছেন দুই হাজার ৪৩৮ জন। পরিচয় মেলেনি ১০৫ জনের। পঙ্গু হয়েছেন ৪০০ জন। জীবিতদের ৯০
শতাংশই ট্রমায় আক্রান্ত। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পর্যবেক্ষণ, এদের মধ্যে নানা উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। ভয় পাওয়া, দুঃস্বপ্ন দেখাসহ নানা ধরনের দুঃসহ স্মৃতি এদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে; কিন্তু এই শোকগাথার এক বছর পূর্তির সময়ে আজ আমরা অনেক কথাই শুনছি, জানছি। আহত দুই হাজার ৪৩৮ জন শ্রমিক আজো ভুলতে পারছেন না তাদের সে দিনের দুঃসহ
অভিজ্ঞতার কথা। তবে যাদের ভুলে যাওয়ার কথা ছিল না, তারা ঠিক ভুলে বসেছেন এসব মানুষের
পুনর্বাসনের কথা, নিহত এক হাজার ১৩৫ ও নিখোঁজ ১০৫ জনের স্বজনদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার
বিষয়টি। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার এক বছর পরও হতাহতদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে না পারা
খুবই লজ্জাজনক ঘটনা বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের উপ-মহাপরিচালক গিলবার্ট
হংবু। কতটুকু অমানবিক হলে আমরা ভুলে যেতে পারি রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির শিকার এসব দুর্ভাগ্যপীড়িত
মানুষের কথা। এসব শ্রমিকের ৬৬ শতাংশ জীবনের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ৬৩.৭৪ শতাংশ
শ্রমিক শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। ৯ শতাংশ শ্রমিক কাজের প্রতি অনীহ হয়ে উঠেছেন। এক হাজার
শ্রমিক এখনো কাজে ফিরতে পারেননি। এদের কথা ভুলে যাওয়া সত্যিই লজ্জাজনক।
কিন্তু
যাদের এ নিয়ে লজ্জা পাওয়ার কথা, তারা কি লজ্জা পাওয়ার মতো কোনো বোধজ্ঞান রাখেন? সমালোচকেরা বলেন, এরা যখন ক্ষমতায় থেকে সম্পদ বাড়ানোর প্রতিযোগিতায়
নামেন, তখন তাদের লজ্জাজ্ঞানবোধ না থাকারই কথা। কার্যত ঘটেছে তা-ই। মিনা
বেগমেরা যখন সন্তান বিক্রি করে জীবনের তাগিদ মেটান, রানা প্লাজার শিকার আহত-নিহত-পঙ্গু
মানুষ ও তার স্বজনদের পুনর্বাসন কিংবা ক্ষতিপূরণ নিয়ে চার দিকে যখন কথা ওঠে, তখন এ দেশের মানুষ একই সাথে শোনে অন্য ধরনের দুঃসংবাদ। এ দুঃসংবাদ ক্ষমতাসীনদের
অবৈধ অর্থের পাহাড় গড়ার দুঃসংবাদ।
সুশাসনের
জন্য নাগরিক (সুজন) সম্প্রতি তথ্য দিয়েছে ২০০৮ ও ২০১৩ সালের নির্বাচনের
আগে নির্বাচন কমিশনের হলফনামায় দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে আয়, সম্পদ, দায়দেনা, আয়করবিষয়ক তথ্য এবং পারিবারিক ব্যয়ের তথ্য বিশ্লেষণ
করে দেখা গেছে, ৪৮ প্রার্থীর আয় গড়ে ৫৮ শতাংশ বেড়েছে। এ হার মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে
২৪৩ শতাংশ, প্রতিমন্ত্রীদের ক্ষেত্রে ৪৬৪ শতাংশ এবং জাতীয় সংসদের উপনেতা, চিফ হুইপ ও হুইপদের ক্ষেত্রে ৩০৭১ শতাংশ সম্পদ বাড়ানোর এই অভাবনীয় হার দেখে
বিস্মিত দেশের সর্বস্তরের মানুষ। সুশীলসমাজ ও গণমাধ্যমে এ নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। সব
মহলের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও ওঠে। এ প্রেক্ষাপটে
বিব্রতকর এক পরিস্থিতিতে পড়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সমালোচনার ঝড় থামানোর জন্যই
হোক, কিংবা অন্য কোনো কারণেই হোক জানুয়ারির শেষ দিকে খবর বেরিয়েছে দশম জাতীয় সংসদের হলফনামায় দেয়া তথ্যানুযায়ী মন্ত্রী-এমপিদের অস্বাভাবিক সম্পদ
বাড়ানো বিষয়ে শেষ পর্যন্ত অনুসন্ধান করেছে দুদক। প্রাথমিক ধাপে সাতজনের সম্পদের তদন্তে
নামছে দুদক। এরা হলেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান, সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী মাহবুবুর রহমান, রাজশাহী-৪ আসনের সাবেক এমপি এনামুল
হক, ঢাকা-১৪ আসনের সাবেক এমপি আসলামুল হক, কক্সবাজার-৪ আসনের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি এবং সাতক্ষীরা-২ আসনের সাবেক
এমপি মো: আবদুল জব্বার। খবরে বলা হয়েছে, পর্যায়ক্রমে আরো বেশ কয়েকজন সাবেক
মন্ত্রী-এমপির অস্বাভাবিক সম্পদ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি অনুসন্ধান করবে দুদক। তবে এই তদন্ত
শেষ পর্যন্ত যৌক্তিক পরিণতি লাভ করবে, না তা একান্তই লোক দেখানো হবে সে ব্যাপারে অনেকেই সন্দিগ্ধ। বিশিষ্টজনেরা এই তদন্তের বিষয়কে দুদকের জন্য
জনমনে আস্থা ফিরিয়ে আনার একটি সুযোগ হিসেবে দেখছেন, তেমনি একে দুদকের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ
হিসেবেও মনে করছেন। কারণ বিগত পাঁচ বছরে সরকারদলীয় এমপিরা যে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন, সে পাহাড় ডিঙিয়ে দুর্নীতি নামের দৈত্যের পতন ঘটানো দুদকের পক্ষে সম্ভব হবে
কি না, সেটাও ভেবে দেখার বিষয়। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য মতে, বিতর্কিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে দেয়া হলফনামা মতে এই পাঁচ বছরে এমপিদের
সম্পদ বেড়েছে ৩২৯৮৫ শতাংশ। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ পরিমাণ সম্পদ বাড়াতে এরা এই
পাঁচ বছরে হয়ে উঠেছিলেন একেকটি টাকা বানানোর মেশিন।
জাতীয়
জীবনে রাজনৈতিক দুঃসংবাদ নিয়ে যেন আমাদের বাস করতেই হবে, এমনটিও জনমনে বদ্ধধারণা জমতে শুরু করেছে। বছরের শুরুতেই দেশবাসী পেল ৫ জানুয়ারির
একতরফা ভোটারবিহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যেখানে ৩০০ আসনের
মধ্যে ১৫৩টিতেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এদেরকে কেউ কেউ অটো-এমপি
হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। এদের মধ্যে যারা মন্ত্রী হয়েছেন তাদেরকে বলছেন অটোমন্ত্রী নামে।
আর জাতীয় পার্টি ও এর নেতা জেনারেল এরশাদকে নিয়ে যে নাটক চলেছে, তা সবার জানা। এখনো যা ঘটছে, তা-ও কারো অজানা নয়। অভাবনীয়ভাবে
তার দল এখন সরকারেও এবং বিরোধী দলেও। ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত এ নির্বাচনকে দেশ-বিদেশের
কেউ গ্রহণযোগ্য বলতে চান না। তার পরও সরকারি দলের কথিত নিয়ম রক্ষার এ নির্বাচন সূত্রে
গঠিত দশম সংসদ নিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ ও এর নেতৃত্বাধীন জোটের নেতারা এখন নানা কূটকৌশলে
লিপ্ত আগামী পাঁচ বছর মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার। এ জন্য সরকার যত কঠোর হওয়ার হবে এমন ঘোষণাও আসছে শীর্ষ পর্যায় থেকে। এ কূটকৌশলের অংশ হিসেবে দ্রুত সব দলের
অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে না গিয়ে সরকার দ্রুত মাঠে নামল উপজেলা
নির্বাচন নিয়ে। লক্ষ্য ছিল ৫ জানুয়ারির মতো বিএনপি ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের এ নির্বাচন
বয়কটের প্রেক্ষাপটে স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি দল জোটের অবস্থান আরো শক্তিশালী করা। বিএনপি
ও তার নেতৃত্বাধীন তা হতে দেয়নি। উপজেলা নির্বাচনের প্রথম দুয়েক দফায় বিএনপি-জামায়াত
জানিয়ে দেয় স্থানীয় পর্যায়ে তাদের জনভিত্তি এখনো অনেক শক্ত। ভ্যাবাচেকা খাওয়া বর্তমান
সরকার পরবর্তী কয়েক দফার উপজেলা নির্বাচনে চালায় বেপরোয়া ভোট ডাকাতি কেন্দ্র দখল, ব্যালটবাক্স দখল করে ইচ্ছেমতো সিল মেরে ব্যালটবাক্স
ভরে দেয়। প্রতিপক্ষের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সরকারি দলের প্রার্থীর হয়ে নানাধর্মী অনিয়মে
সহায়তা করা ইত্যাদি কোনোটিই বাদ যায়নি বিশেষ করে শেষের দিকের কয়েক পর্বের উপজেলা নির্বাচনে।
সংবাদপত্রের পাতার পর পাতা ভর্তি হয়ে যায় উপজেলা নির্বাচনের নানা দুঃসংবাদ নিয়ে। ইলেকট্রনিক
মিডিয়ায় ভোট ডাকাতির ভিডিও ফুটেজ দেখে দেশবাসী হতবাক। এসব দুঃসংবাদ নিয়েই যখন দেশের
মানুষ এক ধরনের চাপা ক্ষোভ নিয়ে বাস করছে, তখন হঠাৎ করেই নির্বাচন কমিশন
২০টি জেলার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে ঘোষণা দিলোÑ উপজেলা নির্বাচনে কোনো অনিয়ম
পায়নি নির্বাচন কমিশন। অথচ দেশবাসীসহ বিদেশীরাও জানে, এবারের উপজেলা নির্বাচন ছিল রীতিমতো ভোট ডাকাতির নির্বাচন। এ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রগুলো
কার্যত পরিণত হয়েছিল ভূতকেন্দ্রে। ভোটের সময় এমনকি ভোটের আগের দিন রাতের অনেক ভুতুড়ে
কাণ্ডকারখানা এবার জানা গেছে গণমাধ্যমের সুবাদে। অতএব বলার অপেক্ষা রাখে না, ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন ও মার্চজুড়ে কয়েক দফায় চলা উপজেলা নির্বাচন এ দু’টি বিতর্কিত নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য যেমন কলঙ্কতিলক হয়ে থাকবে, তেমনি জাতির জন্য হয়ে থাকবে দু’টি মহাদুঃসংবাদ। এর পরে খবর আসে
পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার নানামাত্রিক ঘোষণা।
জানি না, এ ধরনের দুঃসংবাদ নিয়ে জাতিকে আর কতকাল বাস করতে হবে। এরপরও দুঃসংবাদ বাংলাদেশের
ওপর ক্রমেই ভারতের শকুনি থাবার সম্প্রসারণ ঘটছে। এমনই দুঃসংবাদ দেখলাম গত ২০ এপ্রিলের
একটি জাতীয় দৈনিকে। খবরটিতে বলা হয়েছেÑ ভারতীয় জনতা পার্টি তথা বিজেপির
অন্যতম শীর্ষনেতা সুব্রামনিয়াম স্বামী বাংলাদেশের কাছে এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড দাবি করেছেন।
তার দাবি মতে, খুলনা থেকে সিলেট পর্যন্ত সমান্তরাল জমি ছেড়ে দিতে হবে ভারতকে।
বিজেপির এই নেতার যুক্তি হলো, দেশভাগের পর অধুনা বাংলাদেশ থেকে এক-তৃতীয়াংশ মুসলমান
ভারতে প্রবেশ করেছে। তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে বাংলাদেশে। অন্যথায় এসব মুসলমান সংস্থাপনের
জন্য বাংলাদেশকে ভারতের কাছে এর এক-তৃতীয়াংশ জমি ছেড়ে দিতে হবে। গত ১৯ এপ্রিল ভারতের
আসাম রাজ্যের শিলচর থেকে প্রকাশিত দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ এ খবর জানায়। পত্রিকাটিতে প্রকাশিত
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ব্রিটেনের হাউজ অব কমন্সে ১৯৪৭ সালের জুনে ভারতের
দেশভাগ নিয়ে বিতর্ক ও ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স অ্যাক্টের মৌলিক প্রসঙ্গ তুলে যে তত্ত্বের
যুক্তিজাল সুব্রামনিয়াম স্বামী উত্থাপন করেন, এক কথায় এর মর্মার্থ হচ্ছে মানুষের বোঝা চাপিয়ে দিলে দিতে হবে জমিও। তার বক্তব্য হচ্ছে, ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়েছিল ভারত। তাই পাকিস্তান বা অধুনা বাংলাদেশ থেকে
যেসব মুসলমান ভারতে অনুপ্রবেশ করেছে তাদের ফিরিয়ে নিতে হবে বাংলাদেশকে। অন্যথায় তাদের
সংস্থাপনের জন্য ভারতকে জমি দিতে হবে বাংলাদেশ ভূখণ্ড থেকে। স্বামীর মতে, যেহেতু বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ভারতে ঢুকে পড়েছে, অতএব বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড ভারতকে ছেড়ে দেয়ার দাবি তুললেন তিনি।
সুব্রামানিয়াম
স্বামীর বাংলাদেশের কাছে এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড দাবি আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের ওপর
সরাসরি আঘাত। এ ধরনের দাবি আমাদের মনে করিয়ে দেয় ভারত বিভাজনকে ভারতীয়দের মেনে না নেয়ার
বিষয়টিকে। ভারতীয়রা এখনো মনে করে, আবার অখণ্ড এক ভারত হবে। তারই অংশ হিসেবে সুব্রামানিয়ামের
এ দাবি উত্থাপন কি না বলা মুশকিল। সে জন্যই ভারত আমাদের অভিন্ন নদীগুলোতে পানির ন্যায্য
হিস্যা দিচ্ছে না। ছিটমহল সমস্যার সমাধান করছে না। দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে ভারতের দখলে
থাকা দুই হাজার বিঘা জমি বাংলাদেশকে দেয়া হচ্ছে না। আমাদের সরকারের সে ভূমি উদ্ধারে
কোনো পদক্ষেপ নেই।
বাংলাদেশের
কোনো দল ন্যায্য হিস্যা দাবি করলে আমাদের ভারতপ্রেমী সরকার তাদের স্বাধীনতাবিরোধী ও
সন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করে নানা ধরনের টিপ্পনী কাটে। এক দিকে ভারত বাংলাদেশের মানুষকে
ভাতে-পানিতে মারার জন্য উদ্যত, অন্য দিকে আমাদের সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল-জোটের
নেতাকর্মীদের ওপর অমানবিক জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে দেশে এক ধরনের ফ্যাসিবাদ কায়েম করছে।
এর সূত্র ধরে দেশে প্রতিদিন আসছে নানা দুঃসংবাদ। আর এসব দুঃসংবাদের মধ্যে আজ বাস করতে
হচ্ছে দেশের মানুষকে। জানি না, কবে হবে এসব দুঃসংবাদের অবসান। মানুষ ফেলবে স্বস্তির
নিঃশ্বাস।
গোলাপ মুনীর
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন