বুধবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৪
ধাপে ধাপে ঘটে চলেছে রাজনৈতিক ক্যু দেতা
Posted on ৬:৪৪ PM by Abul Bashar Manik
সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও বর্তমানে
তাত্ত্বিক উইলিয়াম বি মাইলামকে ধন্যবাদ জানাতে হয়, ৫ জানুয়ারি ভোটার-বঞ্চনার নির্বাচনের
পর তার প্রদত্ত পর্যবেক্ষণ আবারো স্মরণ করতে হচ্ছে। ১৬ জানুয়ারি নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার
সহযোগী প্রকাশনা এক্সপ্রেস ট্রিবিউনে তিনি মন্তব্য করেছিলেন : “রাজনৈতিকভাবে (ইতিহাসের) এক পুরো চাকা ঘুরে বাংলাদেশ এখন এমন ফাঁপরে পড়েছে
যার মুখোমুখি সে হয়েছিল প্রায় চল্লিশ বছর আগে। ৫ জানুয়ারির (লোকদেখানো) নির্বাচনের
মাধ্যমে একদলীয় সরকারব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। ইতিহাস বলে, পরবর্তী সম্ভাব্য পদপে হবে একদলীয় সরকারকে একদলীয় রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা; কিন্তু ইতিহাস সর্বদা রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। (কথায় আছে) দম শেষ
না হওয়া পর্যন্ত শেষ নেই। আর বাংলাদেশের ধরনটাই এমন, যার ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনা করে
কোনো পণ্ডিত পার পাননি। মনে আছে ১৯৭২ সালের সেই বিখ্যাত বচন, বাংলাদেশ সব সময় (সাহায্য ভিক্ষার) ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ই থেকে যাবে?
‘তবে রাজনীতির কথা বাদ দিলেও বাংলাদেশ এখন ২০১৪ সালে। ১৯৭৫ সালে যে অস্থিতিশীলতা
ও নৈরাজ্যপ্রবণতার দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিল বাংলাদেশ, যার সাথে দানা বেঁধেছিল চরম দারিদ্রা, সে অবস্থা আর নেই। বাংলাদেশ এখনো
দরিদ্র এবং তার উন্নয়নশীল অর্থনীতির অর্জনগুলো হয়তো সহজেই বিপন্ন হতে পারে। তবে সে
এখন বিশ্ব অর্থনীতির সুতোয় বাঁধা। তার তৈরী পোশাক ও অন্যান্য রফতানি শিল্প টগবগে তাজা।
গত দু’দশক ধরে প্রবৃদ্ধি ছিল পাকাপোক্ত এবং সব মিলিয়ে দেশ সমৃদ্ধির পথে।
তার চেয়েও বড় কথা, এ দেশের মানুষ এখন আগের চেয়ে বেশি শিতি ও স্বাস্থ্যবান; গণশিক্ষার বিস্তার ও জেন্ডার বৈষম্য নিরসনে অগ্রগতি হয়েছে।’
“ইতিহাসের স্যা, একদলীয় রাষ্ট্রগুলোর শাসকগোষ্ঠী বেশির ভাগই মতায়
এসেছে (এক ধরনের) নির্বাচনের মধ্য দিয়ে; সেটা বৈধ প্রক্রিয়া হোক বা না
হোক। ফলে জনসমর্থনের তুলনায় অনেক গুণ বেশি মতা হাতে পেয়েছে। তারপর তারা দলীয় অবস্থান
নিরঙ্কুশ করার জন্য প্রধানত বিরোধী শক্তিগুলোকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করেছে; বিরোধীদলীয় নেতাদের জেলে বা নির্বাসনে পাঠিয়েছে; খুঁজে খুঁজে শত্র“ভাবাপন্নদের ওপর এবং যেকোনো প্রতিবাদ সভার ওপর প্রবল
হামলা চালিয়েছে, আর অন্যদের মতাশ্রয়ী বৈষয়িক প্রাপ্তির লোভ দেখিয়ে বশে এনেছে; প্রায়ই ‘রাষ্ট্রের শত্র“’ আবিষ্কার করেছে স্বৈরাচারের সাফাই
গাওয়ার তাগিদে। (বাংলাদেশে) আওয়ামী লীগ সরকার এই প্রক্রিয়া শুরু করেছে নির্বাচনের আগে
থেকেই; বিএনপির বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে জেলে পাঠিয়েছে, আর নির্বাচনের পর আরো বেশি করে ধরপাকড় করেছে। নির্বাচনী প্রচারে মূলত ধুয়া
তুলেছে, ‘ক্ষমতাসীন দলই মাত্র ইসলামি উত্থান রোধের, বিশেষ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর শরিয়া শাসনের কবল থেকে দেশকে রক্ষা করার
ব্যূহপ্রাচীর।’ এখনো সেই ঢাকের বাদ্য বেজে চলেছে। আদপে যে ব্যূহরচনা প্রয়োজন সেটা
একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর দলটিকেই ঠেকানোর জন্য, তার থাবা থেকে রাষ্ট্রযন্ত্রকে দখলমুক্ত রাখার জন্য। প্রজাতন্ত্রে আবারো নির্বাচন
হবে। তবে কার্যত বিরোধী দলের শিরোñেদের আগে সে সুযোগ আসবে কি? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যেই অনতিবিলম্বে আরেকটা (গ্রহণযোগ্য) নির্বাচন
অনুষ্ঠানের প্রশ্নে সুর বদলেছেন। কবে হবে সেই নির্বাচন, সেই অনিশ্চয়তার ফাঁকে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিরোধী দলকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন ও
ফলত ধ্বংস করে দেয়া হবে, নাকি বিরোধী ভূমিকার যোগ্য কেউ থাকবে?”
উল্লেখ্য, দিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সূত্রের বরাত
দিয়ে নির্বাচনের আগে ও পরে ভারতীয় সংবাদভাষ্যকারেরা লিখেছিলেন, ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন একটা ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ও আভ্যন্তরীণ তাগিদ’; দশম সংসদের নির্বাচনী প্রশ্নবিদ্ধতা
সংশোধন করতে অনতিবিলম্বে সবার অংশগ্রহণে আরেকটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যেমন ঘটেছিল ১৯৯৬ সালে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ১৯ দলীয় (তৎকালীন ১৮ দলীয়)
বিরোধী জোটনেত্রী খালেদা জিয়া ঢাকার পাশ্চাত্য-কূটনীতিবিদদের সাথে দীর্ঘ বৈঠক করলেন, শাসক দলের নির্বাচনোত্তর সরকার গঠনে কোনো কার্যকর বাধার সৃষ্টি করলেন না। পাশ্চাত্য
কূটনীতিবিদেরা এমনকি ব্রিটিশ কমনওয়েলথ সচিবালয় পর্যন্ত প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়েই বলেছেন, নির্বাচন ‘গ্রহণযোগ্য’ হয়নি, আরেকটি নির্বাচন দিয়ে সবার অংশগ্রহণে জনসাধারণের প্রকৃত প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার
গঠনের লোক্ষ্য অবিলম্বে রাজনৈতিক সংলাপের উদ্যোগ প্রয়োজন। খালেদা জিয়া ১৫ জানুয়ারি
তার জোটের পক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে জনগণকে অভিনন্দিত করলেন ৫ জানুয়ারি সর্বাত্মকভাবে
‘প্রহসনের নির্বাচন’ বর্জন করে ‘নীরব বিপ্লব’ সাধনের জন্য, আর জনগণের ‘নীরবে’ সেই ‘না’ বলাকে পুঁজি করে রাজনৈতিক সঙ্কট
নিরসনে আবারো অবিলম্বে সংলাপের আহ্বান জানালেন। বললেন : ‘আলোচনাই সঙ্কট সমাধানের একমাত্র পথ। বিনাভোটে নির্বাচিত ঘোষিত দশম সংসদ অবৈধ
প্রমাণিত হয়েছে। কারসাজি, সন্ত্রাস, অন্তর্ঘাত ও অপপ্রচার এই চার অস্ত্রে গণতন্ত্রকে হত্যা করে রাষ্ট্রীয় মতার দখল প্রলম্বিত করা হয়েছে।
শাসক দল ও তাদের মুষ্টিমেয় দোসরের বাইরে উল্লেখযোগ্য কোনো রাজনৈতিক দলই নির্বাচনের
নামে আওয়ামী প্রহসনে শরিক হয়নি। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে কোথাও ভোটারেরা ভোটকেন্দ্রে
যায়নি। বর্তমান সংসদ জনপ্রতিনিধিত্বহীন। দেশ পরিচালনার ব্যাপারে সরকারের পেছনে জনগণের
কোনো অনুমোদন নেই। কাজেই এ সরকার বৈধ সরকার নয়। একটি অবৈধ সরকারের জনগণের প্রতি কোনো
দায়িত্ববোধ থাকে না। এমন একটি সরকার দীর্ঘায়িত হওয়া খুবই বিপজ্জনক। তাই অবিলম্বে এই
বিপজ্জনক সরকারকে সরিয়ে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার
ব্যাপারে পুনরায় সমঝোতা ও সংলাপের আহ্বান জানাচ্ছি।’
তারপর ২০ জানুয়ারি সরকারের শর্ত
মেনে জামায়াতকে বাদ দিয়ে বিএনপি, ইসলামপন্থী ব্যতীত ১৮ দলীয় জোটের অন্যান্য শরিক
এবং খণ্ডিত জাতীয় পার্টির কাজী জাফরকে নিয়ে বেগম খালেদা জিয়া বিশাল জনসভা করেছেন ঢাকার
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সেখানে উদাত্ত ভাষণে তিনি বলেছেন : ‘বর্তমান সরকার মতায় আছে জনগণের ভোটে নয়, অস্ত্রের জোরে। এরা স্বৈরাচারের
বাপ। দুই স্বৈরাচার (শেখ হাসিনা ও এরশাদ) এক হয়ে এখন দেশকে গিলতে বসেছে। ৫ জানুয়ারির
নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, গায়ের জোরে ভোট করা যায় না। অস্ত্রের
জোরে বেশি দিন মতায় থাকা যায় না। অল্প সময়ের মধ্যে এই সরকার বিদায় নেবে, জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। সরকারকে বলব, তাদের ২, ৩ বা ৪ শতাংশ ভোট আছে। এ জনসমর্থন বজায় রাখতে হলে দ্রুত নির্বাচন দিন। না হলে
এ সমর্থনও হারাবেন। জনগণ অন্যায়ের প্রতিবাদ করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে
বাধ্য করবে।’
জবাবে একই দিনে নির্বাচন-পূর্ব
সহিংস সঙ্ঘাত ও যৌথ অভিযানে ‘রক্তাক্ত’ সাতীরায় আওয়ামী লীগের জনসভায়
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যঙ্গ করলেন : ‘বিএনপি গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে
না এসে ভুল করেছে; সে জন্য তাকে আগামী পাঁচ বছর এ ভুলের খেসারত দিতে হবে। তিনি (খালেদা
জিয়া) এখন জামায়াতের আমিরের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। বিএনপি নেত্রী যুদ্ধাপরাধীদের
নিয়ে নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। যারা হরতাল অবরোধের নামে রাস্তা
কেটে, গাছ কেটে, মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছে পুড়িয়েছে, তাদের এসব কর্মকাণ্ডের বিচার বাংলার মাটিতেই হবে। বাংলার মাটিতে তাদের কোনো
স্থান নেই।’
পাশ্চাত্য কূটনীতিবিদদের পরামর্শ
গ্রহণ করে ‘কঠোর কর্মসূচি’ থেকে বিরত থেকেছে বিরোধী জোট।
বিপরীতে ‘কঠোর দমননীতি’ কঠোরতর করেছে মতাসীন সরকার। যেন
অরে অরে ফলছে মাইলাম বর্ণিত ‘বিরোধী শক্তিগুলোকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন’ করে ‘বিরোধীদলীয় নেতাদের জেলে বা নির্বাসনে’ পাঠানোর ছককাটা খনার বচন। বিশ্বায়নবাদীদের সন্তুষ্টির জন্য আন্দোলন বিরতি দিয়ে
খালেদা জিয়া জামায়াত ও হেফাজত গোষ্ঠী থেকে খানিকটা দূরত্বে সরিয়ে নিলেন নিজেকে, উপজেলা নির্বাচনে যোগ দেয়ার ঘোষণা দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, ‘নীরব বিপ্লব’-এর কারিগর হয়েও আদপে বিপ্লবী নয় তার দল বিএনপি, নিয়মতান্ত্রিক ধারাবাহিকতারই ধ্বজাধারী তিনি। আর সেই আন্দোলনবিরতির সুযোগে
মফস্বলের ‘নীরব বিপ্লবী’দের বেছে বেছে শায়েস্তা করতে
র্যাব-পুলিশের রক্তচু চিরুনি অভিযান চালাল শেখ হাসিনার বাধ্য প্রশাসন। রাজধানী পাহারা
দিতে অতিরিক্ত পুলিশের আর প্রয়োজন না থাকায় সশস্ত্র ‘যৌথবাহিনী’ (র্যাব-পুলিশ-বিজিবি) গ্রামে গ্রামে হানা দিয়ে ফিরল
গ্রেফতার তালিকা হাতে কিংবা নাম উহ্য রাখা গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে। অত্যাচার-গ্রেফতার-ক্রসফায়ার
আতঙ্কে গ্রামকে গ্রাম জনশূন্য থেকেছে দিনের পর দিন। মফস্বলে এমন অঘোষিত জরুরি অবস্থা
উপজেলা নির্বাচনের মধ্যেও সমানে চলেছে। তার বিপরীতে রাজধানীতে কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থার
বাহ্যিক চেহারা ফিরিয়ে আনতে সরকার জামায়াত-শিবির বাদে বিরোধী জোটের অন্যান্য শীর্ষ
নেতাদের জামিনে মুক্তির ছাড় দিয়েছিল। অবাধ সভা-সমাবেশ বা মিছিলের সুযোগ দেয়নি। তারপর
উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি শামিল হতে না হতেই আবারো বিএনপির শীর্ষ নেতা কয়েকজনের জামিন
বাতিল করে জেলে পাঠানো হয়েছে। উপজেলা নির্বাচনে শামিল হতে রাজপথের আন্দোলন স্থগিত রাখার
পে ১৯ দলীয় জোটের নেতারা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন : ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে প্রমাণ
হয়েছে মতাসীন গোষ্ঠী জনসমর্থনরহিত। এখন মতার পটপরিবর্তনের জন্য বিশ্বায়নবাদী ভূরাজনৈতিক
মুরব্বিদের কাছে এ কথা জাহির করা প্রয়োজন যে, ১৯ দলীয় জোটের নেতৃত্বের প্রতি
এ দেশের জনসমর্থন রয়েছে। প্রশাসনিক পক্ষপাত সত্ত্বেও স্থানীয় নির্বাচনে স্থানীয় শ্যেনচু
নজরদারিতে থাকবে। তাই উপজেলা নির্বাচনে শামিল হয়ে প্রমাণ দেয়া সম্ভব হবে যে, বিরোধী দলই সর্বাধিক জনসমর্থনপুষ্ট।
কার্যত সেটা সম্ভব হয়নি। প্রথম
দফায় ছাড় দিয়ে বিরোধী দলের জিতের বহর দেখে দ্বিতীয় দফা উপজেলা নির্বাচন থেকেই শুরু
হয়েছিল সরকারের জবরদস্তি, হুমকি-ধমকি, ভোট কারচুপির কারসাজি। তাতে সুবিধা
না হওয়ায় তৃতীয় দফা থেকে সরাসরি পুলিশ, ভাড়াটে গুণ্ডা আর নির্বাচন কর্মকর্তাদের
ভোট ডাকাতির কাজে লাগিয়েছে মতাসীন দল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার সরকারের বাড়াবাড়িতে
বিব্রত বোধ করে লম্বা ছুটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন
কমিশনারের দলীয় আনুগত্যে আর পুলিশরাজের নির্লজ্জ পপাতিত্বে বাকি তিন দফা যে উপজেলা
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে বেশির ভাগ কেন্দ্রে ভোট শুরু হওয়ার আগেই সরকার
মনোনীত প্রার্থীর পে ব্যালট বাক্স পূর্তি সম্পন্ন হয়ে গেছে। উপজেলা নির্বাচনে ‘চূড়ান্ত বিজয়’ পাকা করতে সরকারি মহল মহাদাপটে প্রকাশ্যেই ভোট ডাকাতি, ব্যালট কারচুপি, ভোটার বিতাড়ন, কর্মী গ্রেফতার ও হুমকি ধমকির
সব কৌশল প্রয়োগ করেছে। পঞ্চম ও শেষ দফা ভোটগ্রহণ নিয়ে প্রকাশিত একটা নমুনা খণ্ডচিত্র
:
ভোটারদের পিটিয়ে কেন্দ্র ফাঁকা
করল পুলিশ। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোট না দিয়ে উপজেলা নির্বাচনে ভোট দিতে আসায় প্তি
হয়ে ভোটারদের পিটিয়ে কেন্দ্র ফাঁকা করেছেন সাতীরার তিন ওসি। পঞ্চম পর্বের ভোট গ্রহণ
চলাকালে ৩১ মার্চ বেলা পৌনে ১১টায় সাতীরা সদর উপজেলার আগরদাঁড়ি কামিল মাদরাসা কেন্দ্রে
শ’ দুয়েক নারী লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। এ সময় পুলিশের দু’টি গাড়ি এসে থামে মাদরাসার গেটে। গাড়ি থেকে নামলেন সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা
(ওসি), কালীগঞ্জ থানার ওসি ও শালিখা থানার ওসি। তাদের সাথে নামলেন লাঠি-রাইফেল
হাতে ১০ জন পুলিশ কনস্টেবল। ভোটারদের সামনে গিয়ে তিন ওসি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোরা ৫ জানুয়ারি ভোট দিয়েছিস?’ উত্তরে ভোটাররা বলেন, ‘না’। সাথে সাথে ওসিদের পাশে থাকা কনস্টেবলরা লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে যান
ভোটারদের দিকে, আর চিৎকার করে বলেন, ‘ভাগ, ৫ জানুয়ারি ভোট দেয়নি। এখন আইসে ভোট দিতি।’ কয়েকজন কনস্টেবল রাইফেলের বাঁট
দিয়ে পেটাতে লাগলেন ভোটারদের। শুরু হয় দিগি¦দিক ছোটাছুটি। কেন্দ্রে থাকা
সাংবাদিকদেরও ধমক দেন পুলিশ সদস্যরা। বলেন, ‘তোরা ছবি তুলবি না।’ ধাওয়া খেয়ে খানিকটা দূরে গিয়ে সংগঠিত হন ভোটাররা। চিৎকার করতে থাকেন : ‘ভোট দিতি দিবে না, তো আসতি বললি ক্যান? রাজার ভোটে (৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচন) জামাতিরা ভোট দিতি দেয়নি। আর এবার দিলো
না পুলিশ।’
একদলীয় শাসন নিরঙ্কুশ করতে আরো
একধাপ এগোলেন শেখ হাসিনা। বিরোধী জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জন্য সান্ত্বনা : সশস্ত্র
ভাড়াটে গুণ্ডা রাস্তায় মোতায়েন করে আর ভোটকেন্দ্রে পুলিশ বসিয়ে ভোটার বিতাড়ন ও ব্যালট
চুরির মাধ্যমে শেষ তিন দফায় পাকাপাকিভাবে উপজেলা নির্বাচনের ‘বিজয়’ ছিনিয়ে নিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেই প্রমাণ করল যে, শেখ হাসিনা সরকারের ‘তত্ত্বাবধানে’ কোনো সুষ্ঠু নিরপে নির্বাচন অনুষ্ঠান
অসম্ভব। ‘নীরব বিপ্লব’-এর নেতৃত্বকে টেক্কা দিয়ে এভাবেই ধাপে ধাপে ‘একদলীয় শাসন’ কায়েমের রূপকারেরা বাংলাদেশে রাজনৈতিক ক্যু দেতা
বা পেশিশক্তির অভ্যুত্থান ঘটিয়ে চলেছেন। কে ধার ধারে জনমতের, গণতান্ত্রিক আচরণবিধি নিয়ে কেনই বা মাথাব্যথা? মাছিমারা কেরানিরা ঠিকই সার্টিফিকেট লিখে দেবেন, ফলাফল ‘নিয়মতান্ত্রিক’ হয়েছে।
৩ এপ্রিল বাংলাদেশে সফররত যুক্তরাজ্যের
আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী অ্যালান ডানকান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ
পান। আগের দিন তিনি ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন
ছিল অস্বাভাবিক। ওই নির্বাচনে একটি প অংশ নেয়নি। সংসদের বর্তমান বিরোধী দল সরকারে আছে, বিরোধী বেঞ্চেও আছে এমন অস্বাভাবিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথায় মন্ত্রী
হেসে, রওশন এরশাদকে ‘অফিশিয়াল বিরোধী দল’ আখ্যা দিয়ে বলেন, তার সাথে আমার বৈঠক হয়েছে। তিনি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে
পালনে চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী
বেগম খালেদা জিয়ার সাথে বৈঠকে দেশের জনগণের স্বার্থে একসাথে কাজ করার আহ্বান জানাবেন
বলেও উল্লেখ করে ব্রিটিশ উন্নয়নমন্ত্রী বলেন, ‘নির্বাচন অস্বাভাবিক হলেও সরকার
বৈধ। ব্রিটেন সরকারের সাথে কাজ করছে, তবে আমরা এখানে প্রকৃত গণতন্ত্র
দেখতে চাই। জনগণের স্বার্থে পরিচালিত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া দেখতে চাই।’ প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতে একই কথা বলে তৃতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায়
শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান তিনি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গার্মেন্ট শিল্পের নারী শ্রমিকদের উন্নয়ন ও নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের
সাথে আরো ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে আগ্রহ দেখান। তবে সদ্যসমাপ্ত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে
জালভোট ও সহিংসতায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হতাশার কথাও সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন
ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রী। জবাবে শেখ হাসিনা সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে সরকারের চেষ্টার
কথা বলেছেন। দাবি করেছেন, স্থানীয় নির্বাচনে অনেক কারণে অনাকাক্সিত ঘটনা ঘটে; এটাই বাস্তবতা।
৩১ মার্চ আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে
বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের প্রতিনিধিদল ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া
সরেজমিন পর্যবেণ করেছে। আমি নিজেও ভোটকেন্দ্র পর্যবেণ করেছি। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন
দূতাবাসের পক্ষ থেকে যথাযথ কর্তৃপকে দেয়া হবে। সংসদ নির্বাচনের প্রশ্নে আগের অবস্থানেই
রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। নির্বাচনের পর পরই মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র আনুষ্ঠানিকভাবে
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তুলে ধরেছেন। দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী
পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল বাংলাদেশের ওপর মার্কিন কংগ্রেসে অনুষ্ঠিত শুনানিতেও
এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলেছেন। যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই বলে আসছে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিরোধী মতের সুযোগ থাকা প্রয়োজন। আর এ সুযোগকে দায়িত্বশীলতার
সাথে ব্যবহার করাও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকবে।
সরকারের সাথে আমরা অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করব। যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে
গত আগস্টে ওপেন স্কাই (মুক্ত বিমান পথ), অক্টোবরে সন্ত্রাস দমন এবং নভেম্বরে
টিকফা (বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা রূপরেখা চুক্তি) সই হয়েছে। এপ্রিলে (চলতি মাসে)
দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা সংলাপ ও টিকফার প্রথম বৈঠক, জুনে অংশীদারিত্ব সংলাপ ও এর পর সামরিক সংলাপ হবে। দুই দেশের সম্পর্ক এই ধারাবাহিকতায়
অগ্রসর হচ্ছে।’ ৬ জানুয়ারি মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিবৃতিতে এবং ১১ ফেব্র“য়ারি মার্কিন সিনেটে দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই
বিসওয়ালের জবানবন্দীর শুনানিতে এ কথাই বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল ‘নিদারুণভাবে ত্র“টিপূর্ণ’ এবং যুক্তরাষ্ট্র চায় অবিলম্বে রাজনৈতিক সংলাপ শুরু হোক, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সমঝোতার মাধ্যমে যথাসত্বর একটি নতুন নির্বাচন দেখতে
চায়, যাতে অবাধ, পপাতমুক্ত ও শান্তিপূর্ণভাবে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত
করা হবে। বাংলাদেশের ভুক্তভোগী সাদাসিধে মানুষ ভাবছে, এসব আপ্তগরজি মিশ্র বার্তায় তাদের ফায়দা কোথায়?
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন