নির্বাচন কমিশনার আব্দুল মোবারককে
সাহস ও আনুগত্যের জন্য মোবারকবাদ। তিনি অবকাশে যাওয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী
রকীব উদ্দিন আহমদ বা তার আগের নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদার মতো নিরপেক্ষতার
মুখোশ পরার চেষ্টা করেননি। তিনি তার রাজনৈতিক আনুগত্য যেমন সরাসরি প্রকাশ করেছেন, তেমনি তাকে যে দায়িত্ব পালনে বসানো হয়েছে তা নিষ্ঠার সাথে পালন করে চলেছেন।
সম্প্রতি তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, বিএনপি নাকে খত দিয়ে নির্বাচনে এসেছে। এই বক্তব্য
এর আগে ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাও দিয়েছেন। সেই বক্তব্যের তিনি প্রতিধ্বনি করেছেন মাত্র।
৫ জানুয়ারি ১৫৩ আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী ঘোষণার মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন
দেশে যে গণতন্ত্রের জয়যাত্রা শুরু করেছিল, তার বহুমাত্রিক সুফল এখন দেশের
মানুষ পাচ্ছে। উপজেলা নির্বাচনে কষ্ট করে মানুষকে ভোটকেন্দ্রে যেতে হচ্ছে না। ভোটের
আগের রাতেই ব্যালটবাক্স ভরে ফেলা হয়েছে। পোলিং ও প্রিজাইডিং অফিসারদের কাজও কমে গেছে।
উপজেলা
নির্বাচনে ভোট ডাকাতির যেসব নজির স্থাপিত হয়েছে তাতে বিএনপি নয়, গণতন্ত্রের নাকে খত দেয়াতে সক্ষম হয়েছে নির্বাচন কমিশন। নাকে খত দেয়ায় ব্যথায়
গণতন্ত্র ককিয়ে উঠছে আর নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য শুকরিয়া আদায় করছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিজয় উল্লাসে মত্ত। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন ছাড়াই ৫ জানুয়ারি
দেশের মানুষকে যে অভিনব গণতন্ত্র উপহার দিয়েছিল সেই গণতন্ত্রে জনগণ কিভাবে সম্পৃক্ত
হবে, তার মহড়া সম্পন্ন হলো উপজেলা নির্বাচনে।
প্রথম
ও দ্বিতীয় দফার উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ফলাফল খারাপ হওয়ায় নির্বাচন কমিশনের
জন্য সুষ্ঠু নির্বাচনের অর্থ অন্যরকম মনে হয়েছিল। তারা যেভাবে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন
করেছিল, তার থেকে ভিন্নমাত্রায় নির্বাচন হওয়ায় তারা মনে করেছিল এই দুই
দফার নির্বাচনে গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতিফলন ঘটছে না। মানুষ স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার
প্রয়োগ করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে বাধা সৃষ্টি করছে। এ কারণেই এই ভোট দেয়ার স্বাধীনতা
কিভাবে হরণ করা যায় তার কিছু কৌশল প্রয়োগ করা হয়। এর পরই উপজেলা নির্বাচনের চিত্র পাল্টে
যেতে থাকে। অদৃশ্য এক নতুন গাইডলাইন অনুযায়ী নির্বাচন সম্পন্ন হতে থাকে। আওয়ামী লীগের
প্রার্থীরা অধিকসংখ্যক উপজেলায় বিজয়ী হতে থাকেন। অনেক স্থানে প্রিজাইডিং অফিসার নিজেই
ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর পক্ষে ভোটের বাক্স ভরিয়েছেন। মন্ত্রী, এমপি, ডেপুটি স্পিকার নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। পুলিশ নিজেই
ভোটারদের ভোটকেন্দ্র থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। ৫ জানুয়ারি ভোট দিতে আসেনি, এখন কেন ভোট দিতে এসেছেÑ এই অপরাধে অনেককে গ্রেফতার করা হয়। বিএনপি চেয়ারপারসন
বেগম খালেদা জিয়ার নির্বাচনী এলাকা ফেনীর ছাগলনাইয়ায় অনেক কেন্দ্র ভোটের আগেই ভোট প্রদান
শেষ হয়ে যায়। সকালে ভোটারেরা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখেন ভোট দেয়ার কাজ শেষ হয়ে গেছে। এখানে
আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ৫৯ হাজার ৭৭৭ ভোট আর বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী পেয়েছেন
মাত্র ১০ হাজার ভোট। ফেনীর এসব নির্বাচনী এলাকায় খালেদা জিয়া তো বটেই, বিএনপির কোনো প্রার্থী কখনোই হারেননি। নির্বাচন কমিশন এই নির্বাচনের মাধ্যমে
প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে, দেশে শুধু নয়, খালেদা জিয়ার নির্বাচনী এলাকাতেও
তার কোনো জনপ্রিয়তা নেই। ক্ষমতাসীন দলের জন্য এর চেয়ে আর কী সাফল্য এনে দিতে পারে নির্বাচন
কমিশন!
পরিসংখ্যান
দেখলে আমরা বুঝতে পারব কিভাবে নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের বিজয়ী করে
সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে এগিয়ে গেছে। প্রথম দফার নির্বাচন হয়েছিল ৯৮টি উপজেলায়। এই দফায়
কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। তবে ৬৪টি কেন্দ্রে দখল, দখলের চেষ্টা বা জালভোট দেয়ার
অভিযোগ পাওয়া যায়। এই নির্বাচনে বিএনপি ৪৫টি উপজেলায়, আওয়ামী লীগ ৩৪টি উপজেলায় এবং জামায়াত ১২ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়।
দ্বিতীয় দফায় ১১৬টি উপজেলায় নির্বাচন হয়। এ দফায় ৯৮টি কেন্দ্রে দখল, ছিনতাই বা জালভোট দেয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। সহিংসতায় মারা যান একজন। নির্বাচনে
বিএনপি ৫২, আওয়ামী লীগ ৪৬ এবং জামায়াত ৮ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়।
তৃতীয় দফায় ৮১ উপজেলায় নির্বাচন হয়। এ দফায় ১৭৫ কেন্দ্রে দখল, জালভোট ও ব্যালট ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটে। মারা যান তিনজন। ফলাফল আগের দুই ধাপের
চেয়ে ভিন্ন হয়। আওয়ামী লীগ পায় ৩৭ বিএনপি ২৬ এবং জামায়াত ৮ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে
বিজয়ী হয়। চতুর্থ দফায় ৯১ উপজেলায় নির্বাচন হয়। ২২০টি কেন্দ্রে দখল, ব্যালট ছিনতাই ও জালভোট দেয়ার ঘটনা ঘটে। সহিংসতায় মারা যান চারজন। আওয়ামী লীগ
৫০টি উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়। বিএনপি পায় ২৩টি, জামায়াত ৫টি উপজেলায় বিজয়ী হয়। পঞ্চম দফায় ৭৩টি উপজেলায় নির্বাচন হয়। এবার
আর কেন্দ্র দখল, জালভোট ও ব্যালটবাক্স ছিনতাইয়ের কোনো হিসাবের দরকার নেই। রাতেই
৩৫ কেন্দ্রে ভোট শেষ হয়ে যায়। অর্থাৎ প্রার্থীর পক্ষে সিল মেরে ব্যালটবাক্স ভরা হয়ে
যায়। সকালে আর কষ্ট করে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে হয়নি। এ দফায় সহিংসতায় মারা গেছেন
একজন। ফলাফল আওয়ামী লীগ ৫৪টিতে, বিএনপি সমর্থিতরা ১৩টিতে আর জামায়াত সমর্থিত উপজেলা
চেয়ারম্যান বিজয়ী হয়েছেন তিনটিতে, বাকিরা অন্যান্য। দেখা যাচ্ছে সহিংসতা, কেন্দ্র দখল, ব্যালটবাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনা যত বেড়েছে, সেভাবে পাল্লা দিয়ে আওয়ামী লীগের জয় বেড়েছে। পঞ্চম দফা নির্বাচন শেষে উপজেলা
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২৫, বিএনপির ১৫৬, জামায়াতের ৩৬। উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এই
সাফল্যের কৃতিত্ব অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের। ভোট ডাকাতির সুযোগ দেয়া না হলে প্রথম ও
দ্বিতীয় দফার মতোই ফলাফল পেতো ক্ষমতাসীন দল। আর তা হলে সার্চ কমিটির মাধ্যমে খুঁজে
পাওয়া নির্বাচন কমিশনাররা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে যেতেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন আয়োজন করে
যে সাফল্য তারা অর্জন করেছেন, তার ধারাবাহিকতা বজায় থাকত না।
পঞ্চম
দফার নির্বাচনের পর নির্বাচন কমিশনার আব্দুল মোবারক ছিলেন উত্তেজিত। সিইসি কাজী রকীব
উদ্দিন আহমদ অবকাশে থাকায় গণমাধ্যমে তাকে ভারপ্রাপ্ত সিএইসি হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে।
এর আগে তিনি খালেদা জিয়ার দল বিএনপি নাকে খত দিয়ে নির্বাচনে এসেছে বলে মন্তব্য করেছিলেন।
বিএনপি এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এবার তিনি বললেন, ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়। এত দিন ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের মধ্যে আমরা
ইটপাটকেলের ব্যবহার দেখেছি। এবার নির্বাচন কমিশন নিজেই এই লড়াইয়ে নেমে পড়েছে। ক্ষমতাসীন
দলকে এখন আর বিরোধী দলগুলোকে মোকাবেলা না করলেও চলবে। এ দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন নিজেই
নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশন অসীম ক্ষমতার অধিকারী। তারা
যদি এবার পাটকেল মারা শুরু করেন তাহলে বিএনপির রাজনৈতিক অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়তে
পারে।
বিএনপি
নেতারা নির্বাচন কমিশনারের এই বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেছেন, তার এই বক্তব্য রাজনৈতিক। আলবত রাজনৈতিক। মানুষ রাজনৈতিক জীব। নির্বাচন কমিশনারও
রাজনীতির বাইরে থাকেন কী করে? সাংবাদিকেরা আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানককে
জিজ্ঞেস করেছিলেন, বিএনপি নাকে খত দিয়ে নির্বাচনে এসেছেÑ একটি রাজনৈতিক দল সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনার এমন মন্তব্য করতে পারেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, তিনি রাষ্ট্রবিচ্ছিন্ন বা ভিন
গ্রহের মানুষ নন। বিএনপির চালচলন ও সমাজজীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে তিনি এমন মন্তব্য
করেছেন। তার এই বক্তব্য দেশবাসীর বক্তব্য। চমৎকার। নির্বাচন কমিশন দেশবাসীর কথা বিবেচনা
করে বিএনপির বিরুদ্ধে পাটকেল মারার অংশ হিসেবে এখন কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। নির্বাচন
কমিশনারের কায়েন্ট বা মক্কেল হচ্ছে রাজনৈতিক দল। বলা হয়, কায়েন্টকে সন্তুষ্ট রেখে নির্বাচন কমিশনকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। কায়েন্ট বিগড়ে
গেলে আর কাজটি করা সম্ভব না-ও হতে পারে। নির্বাচন কমিশন বিএনপিকে রাজনৈতিক দল হিসেবে
মনে করে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা প্রায়ই বলে
থাকেন, বিএনপি কোনো রাজনৈতিক দল নয়। হতে পারে নির্বাচন কমিশনার আব্দুল
মোবারকও এমনটাই ভেবে থাকতে পারেন।
আওয়ামী
লীগের অনেক নেতা বলেছেন, জামায়াতের মতো বিএনপির রাজনীতিও নিষিদ্ধ হওয়া উচিত।
আর নির্বাচন কমিশনারের উচিত বিএনপির নিবন্ধন বাতিল করে দেয়া। কারণ বিএনপি ৫ জানুয়ারির
নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়ে সহিংসতা করেছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের এই মতের সাথে হয়তো আব্দুল
মোবারকও একমত। এ কারণে বিএনপি কী বলল আর কী মনে করল তাতে তার কিছুই যায়-আসে না। অর্থাৎ
বিএনপিকে হয়তো নির্বাচন কমিশন কায়েন্ট হিসেবে মনে করে না। এ কারণে আব্দুল মোবারক নাকে
খত দিয়ে বিএনপির নির্বাচনে আসায় মজা পেয়েছেন। এখন বিএনপি তাকে নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য
করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করছে কি না তা দেখার বিষয়। তিনি যদি বিএনপির নিবন্ধন বাতিল করেন
তাহলে পাটকেল মারার কাজটি সুসম্পন্ন হয়। এতে দেশ গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথে অনেকখানি
এগিয়ে যেতে পারবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের মতো সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব
নির্বাচন কমিশন নিতেই পারে। জয় হোক এমন সুষ্ঠু নির্বাচনের। আব্দুল মোবারকসহ সব নির্বাচন
কমিশনার এ জন্য দেশবাসীর পক্ষ থেকে মোবারকবাদ পাবেন।
আলফাজ আনাম
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন