রবিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৪

ট্রাজেডির নির্বাচনের নির্মম শবযাত্রা


রেকর্ড ভঙ্গ-
গ্লানির অনেকগুলো রেকর্ড ভাঙ্গল এবারের নির্বাচন। ৫ জানুয়ারি, ২০১৪ সরকারি দলের একতরফা প্রাণঘাতী নির্বাচনে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত প্রার্থী ১৫৩ জন। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম। আগের রেকর্ড ছিল ৪৯ জন (১৯৯৬ সাল)। ভোট প্রদান থেকে এবার সর্বোচ্চসংখ্যক ভোটার প্রায় ৫ কোটি মানুষকে বঞ্চিত করা হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সংখ্যা ইতিহাসের সর্বনি¤œ রেকর্ড ৫৪৩ জন, এর পূর্বের রেকর্ড ছিল ১২০৯ জন (১৯৭৩ সাল), সে রেকর্ডও ভাঙ্গল এবার। অংশগ্রহণ করেছে মহাজোটভুক্ত ১২টি দল যা দ্বিতীয় সর্বনি¤œ। প্রথম রেকর্ড ছিল ৮টি দল (১৯৮৮ সাল)। মোটেও ভোট হচ্ছে না ৫টি জেলায়। এবারই প্রথম দেশের প্রধান নেতৃবৃন্দ কেউই ভোট দেয়নি। প্রধান মন্ত্রী ঢাকা-১০ আসনের ভোটার। ইতোমধ্যেই এই আসনের প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী। প্রেসিডেন্ট কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের ভোটার। তার আসনের প্রার্থীও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী। বিরোধী দলীয় নেতা যদিও প্রহসনের নির্বাচন বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাছাড়া কার্যত তিনি গৃহবন্দী। কয়েক প্লাটুন পুলিশ আর বালুর ট্রাকে তিনি বেষ্টিত। সম্ভাব্য বিরোধীদলীয় নেতা (হু. মো. এরশাদ) দৃশ্যত তিনি সিএমএইচ-এ আটক। জামায়াতে ইসলামীর আমীর জেলখানায় ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডা. বি চৌধুরী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদ, কর্নেল অলি আহমেদ, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, ড. কামাল হোসেনসহ বাকী সকল বিরোধী মতের দলের প্রধান, ঘৃণাভরে এই ট্রাজেডির নির্বাচন বর্জন করেছেন। স্বয়ং নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) রকিব উদ্দিনও ভোট দিতে পারেননি। এবারই প্রথম নিজস্ব খরচে সম্মানিত নির্বাচন কমিশন পর্যটক আমদানি করেছেন পার্শ্ববর্তী দেশ ভুটান ও ভারত থেকে। সে হিসাবে অনেক ইতিহাস ভেঙ্গে রেকর্ড গড়ার এক অদ্ভূত নির্বাচন করলাম আমরা। তাই দীর্ঘতম মানব জাতীয় পতাকার সাথে গিনেজ বুকে আরেকবার জায়গা পাওয়ার কথা বাংলাদেশের।
ধোঁকাবাজি
ব্যারিস্টার মোঃ রফিকুল হক বেকুবের দেশে বাস করেন বলে একবার আক্ষেপ করেছিলেন। বেকুবের দেশের সাধারণ মানুষগুলোকে ধোঁকা দেয়া হয়তবা সহজ তাই আ’লীগ দেশের মানুষকে বারবার বোকা বানাতে পেরেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ১৯৯৬ সালে ১৭৩ দিন হরতাল করেছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, এখন ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে সেই সরকার ব্যবস্থাটি বিলুপ্ত করলেন। তখন শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “সব দল যেন নির্বাচনে অংশ নিতে পারে, সে জন্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হবে। সমগ্র জাতি চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন”। এখন ১৫তম সংশোধনীতে তিনি সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করলেন। ১৫ আগস্ট-২০১৩ তিনি বলেন, আমি সংবিধানে বিশ্বাস করি। যা হবে সংবিধান অনুযায়ী হবে। তার থেকে একচুল  নড়া হবে না। তিনি এক চুলও নড়লেন না, তাই তার অধীনেই নির্বাচন হল। তত্ত্বাবধায়ক মানে অনির্বাচিত সরকার, সভ্যদেশের উদাহরণ, সংবিধান রাখার তাগিদ, ১৯৯৬ সালে কোথায় ছিল? তাহলে তিনি দেশবাসীকে ১৭৩ দিনের হরতাল হাজার হাজার কোটি টাকার লোকসান ফেরত দিতে পারবেন? জীবন উৎসর্গকারী মানুষগুলোকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন? এ প্রশ্ন তো দেশবাসী করতেই পারে। ২০০৬ সালে বিচারপতি কেএম হাসানকে তিনি মানলেন না। কারণ তিনি বিএনপি মনা ছিলেন এই সন্দেহে। তাকে সরাতে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠার তা-ব ঘটানো হল। লাশের ওপর নৃত্য করা হলো। আর এখন তিনি সর্ব দলীয় সরকারের প্রধান হয়ে নির্বাচন করলেন, দলীয় প্রধানও তিনি। দলীয় প্রধানকে আওয়ামী লীগের সমার্থক বলা নিশ্চয় বেমানান হবে। স্বাধীনতা বিরোধী প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান ১৯৮১ সালে যে যুক্তি দিয়েছিলেন ঠিক একই দোহাই এখন শেখ হাসিনার মুখ দিয়েই বেরুচ্ছে। কথা একই শুধু মুখের পরিবর্তন। শাহ আজিজ বলেছিলেন, “দুনিয়ার সমস্ত গণতান্ত্রিক দেশে প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতায় রেখেই অবাধ নির্বাচন হয়।” মি. সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শাহ আজিজুরের এই বক্তব্যে বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৮১তে তিনি যুক্তি দেখিয়েছিলেন, “রাষ্ট্রপতি যদি প্রার্থী হতে চান তিনি পাওয়ার থেকে রিজাইন করে করবেন। তা না হলে ক্ষমতার অপব্যবহার হয়,
 কারচুপি হয়। (সংসদ বিতর্ক-পৃ-৩৭৫৪)। সেই সুরঞ্জিত সেন বর্তমানে (৩ জুন ১৪) মন্তব্য করেছেন, “শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে নির্বাচন করাটা মাইলফলক হয়ে থাকবে।” সময়ের বিবর্তনে ভোলও পাল্টে গেছে। সংবিধান মানুষের জন্য, সংবিধানের জন্য মানুষ নয়। ইন্ডিয়ার সংবিধান ৯৮ বার সংশোধন করা হয়েছে। প্রয়োজনে আমাদের সংবিধান ১৫ বার সংশোধন করা গেলে আরও একবার হতে পারবে না কেন? আওয়ামী পন্থী বা বুদ্ধিজীবীরা যুক্তি ( ধোঁকা) দেন যে, এই নির্বাচন ’৭১ এর পক্ষ-বিপক্ষের লড়াই। গণতন্ত্র আর মুক্তিযুদ্ধকে তারা মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেশবাসীকে গৃহযুদ্ধের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। গণতন্ত্র হত্যার নির্বাচনকে ’৭১ এর মূল্যবোধের সাথে তুলনা করা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে অবমাননা করা বৈ আর কিছুই নয়। কেননা অনেকেই বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে শেখ হাসিনার জয়লাভ আর আওয়ামী লীগের পরাজয়ের দিন। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় মন্তব্য এসেছে এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতলেও হারবে বাংলাদেশ। আর বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, “আজকের দুটি পক্ষ-গণতন্ত্র বনাম স্বৈরতন্ত্র, বাংলাদেশ পক্ষের শক্তি বনাম অন্যদেশের পক্ষের শক্তি।” তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা আরও একটি যুক্তি (ধোঁকা) দাঁড় করেছেন, “যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হলে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় থাকতে হবে।” প্রধানমন্ত্রী তনয় সজীব ওয়াজেদ জয়ও তেমন ইঙ্গিত দিলেন, “শেখ হাসিনাকে বিএনপি কেন চায় না? জয়ের উক্তি, এই ডিসেম্বরে তাহলে কাদের মোল্লার ফাঁসি হতো না।” অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর করে শেখ হাসিনা পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। কিন্তু, যুদ্ধাপরাধীদের সংখ্যা আর বিচারের সময়কাল তো নির্দিষ্ট করেনি সরকার। তার মানে যুদ্ধাপরাধীর বিচার চলবে অনাদিকালব্যাপী আর সেই বিচার করতে বারবার শেখ হানিাকেই গদিতে থাকতে হবে। দশম, একাদশ, দ্বাদশ......অনন্তকালের সব নির্বাচন এভাবেই চলবে। কি হাস্যকর যুক্তি! তাদের আর একটি ধোঁকাবাজি প্রচার হলো, বিরোধী দলের আন্দোলন, নির্বাচন বর্জন সবকিছু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের জন্য। সরকারের নির্বাচন আয়োজন কেবলই স্বাধীনতার চেতনা রক্ষার জন্য। লুটপাটের ধারক-বাহকদের ছলাকলা, সীমাহীন দুর্নীতি, দুই হাজার গুণেরও বেশি সম্পদ বৃদ্ধি, গণহত্যা, মিথ্যাচার, ক্ষমতার মোহ সব কি স্বাধীনতার চেতনা বলে চালিয়ে দেয়া যাবে? “যুদ্ধাপরাধীদে ফাঁসি চাইলে নির্বাচনী শবযাত্রায় অংশ নিতে হবে এটা মুক্তিযুদ্ধের ভুল ব্যাখ্যা। কারণ গণতন্ত্র ও জনগণের ভোটাধিকারকে দলিত-মথিত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশ ঘটতে পারে না। (মিজানুর রহমান খান, ৫/১/১৪ দৈঃ প্রথম আলো)। অথচ একদল উচ্ছিষ্টভোগী, আ’লীগের সব কিছুতেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোরাস গায়। ভোটের দিন অনেক নন-ভোটারকে লাইন দীর্ঘ করতে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। মানুষ ভোট দিতে আসেননি, অথচ নির্বাচন শেষে দেখা গেল ৫০-৬০%, কোথাও আবার ৯১% ভোট কাস্ট!
নির্বাচনী শবযাত্রা
তফসিল ঘোষণার ৪০ দিনের মধ্যে ১২৩টি লাশের উপর দিয়ে হেঁটে এর আগে কোন ইসি নির্বাচনে যায়নি। অবশ্য লাশের সংখ্যাটি আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের কাছে নিতান্তই নগণ্য তাই মুনতাসির মামুন জনকণ্ঠে লিখেছেন, “পাকিস্তানী ও তার দালালদের আর নয়। এর জন্য যদি আরও কয়েক লাখের মৃত্যু হয়, হবে।” লাখ লাখ মায়ের কোল খালি করে মসনদ রক্ষার আশায় আছে মুনতাসির মামুনরা। এমনিতেই দেশটা একটা মৃত্যু উপত্যকা- অবিলম্বে এই মৃত্যুর খেলা বন্ধ করুন। নির্বাচনের দিনও (৫/১/১৪) রাত পর্যন্ত ২৪ জন মানুষ সরকারের হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেছেন। মানুষ এই ভোটকে না বলে দিয়েছে। নির্বাচন স্থগিত রয়েছে প্রায় ১৫০টি কেন্দ্রের। সারা দেশ পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। ভোটারবিহীন, ভোটবিহীন, প্রার্থীবিহীন এই ভোট উৎসবের পরিবর্তে উৎকণ্ঠা, আস্থার পরিবর্তে আতঙ্ক, উৎসাহের পরিবর্তে উদ্বেগ, গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরাচার, আশার পরিবর্তে তামাশা, নির্বাচনের নামে প্রহসনে পরিণত হয়েছে। অবশ্য জাসদ নেতা আ.স.ম আব্দুর রব বলেছেন, “৫ই জানুয়ারি সরকারের লাশ দাফন, এরপর কুলখানি, আর কয়েকদিন পর হবে চল্লিশা।” অন্যদিকে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, “এই নির্বাচন দিয়ে শেখ হাসিনা ইতিহাসে চেঙ্গিস ইয়াহিলার মত শাসকের খাতায় নাম লেখালেন (৫/০১/১৪, দৈনিক ইনকিলাব)।” অথচ বিকাল ৪টায় দলীয় ভোট সমাপ্তির পরই শাসক দলের প্রেস ব্রিফিং-এ জনাব তোফায়ে আহমেদ সেই পুরনো ক্যাসেটই বাজালেন- “নির্বাচন সফল, গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধের বিজয় হয়েছে।” না জানি কবে তারা বলে বসেন, সাগর রুনি, বিশ্বজিতের হত্যাকা-, হাজার হাজার মানুষের খুন-গুম, পঙ্গুত্ববরণ, শেয়ার বাজার, হলমার্ক, সোনালী ব্যাংক, ডেসটিনি, লুটপাট, পদ্মসেতু দুর্নীতি, গণহত্যা, ফ্যাসিবাদ, স্বৈরাচার সবকিছুই তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন। প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মুসা, একবার আওয়ামী লীগকে চোর বলেছিলেন, এই আওয়ামী লীগের কপালে এখন ভোট চুরি আর স্বৈরাচারের কলঙ্ক তিলক।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads