আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে নতুন পর্যায়ে প্রশ্ন ও তীব্র আপত্তি উঠেছে। তিস্তার পানি নিয়ে রীতিমতো শত্রুতাপূর্ণ কার্যক্রম এসেছে প্রধান একটি কারণ হিসেবে। ওই নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার এবং উজানে বাঁধের মাধ্যমে আটকে দেয়া পানি ছেড়ে দেয়ার দাবিতে দেশজুড়ে যখন আন্দোলন জোরদার হচ্ছিল, বিএনপি যখন তিস্তা অভিমুখে লং মার্চ করছিল তখনও ভারত নোংরা ও ধ্বংসাত্মক খেলাই খেলেছে। পানি ছেড়ে দেয়ার অভিনয় করেছে দেশটি। লং মার্চকে ব্যর্থ করার লক্ষ্য নিয়ে ভারত হঠাৎ সাত-আটশ কিউসেক পানি ছেড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট সকল সূত্রে এ সম্পর্কে জানা গেলেও আমাদের সরকার ভারতের বিরুদ্ধে কোনো শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি। ক্ষমতাসীন কোনো কোনো নেতা বরং এমনভাবে বিএনপির সমালোচনা করেছেন যেন লং মার্চের কারণে ভারতের সঙ্গে পানি সংক্রান্ত আলোচনা নস্যাৎ হতে চলেছে! অন্যদিকে প্রমাণিত সত্য হলো, পশ্চিম বঙ্গের আপত্তি ও বিরোধিতার অজুহাত দেখিয়ে ভারতই তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর করা থেকে বিরত রয়েছে। এর ফলে কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটসহ বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চাষাবাদ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, পুরো এলাকা মরুভূমির পরিণতিও বরণ করতে যাচ্ছে। তিস্তার পানি নিয়ে সর্বনাশা এই রাজনীতির পাশাপাশি অন্য একটি কারণও সম্প্রতি দেশপ্রেমিকদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া ঘটিয়েছে। সে কারণ ভারতের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা সুব্রামনিয়াম স্বামীর বাংলাদেশ বিরোধী কিছু বক্তব্য। মূলকথায় তিনি বলেছেন, ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ মুসলমান ভারতে অনুপ্রবেশ করেছে। তারা এখনো অবৈধভাবে ভারতে বসবাস করছে। তারা যেহেতু মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ সেহেতু বাংলাদেশকেও তার এক-তৃতীয়াংশ ভূমি ভারতকে দিতে হবে। ফর্মুলাও দিয়েছেন বিজেপির এই নেতা। বলেছেন, খুলনা থেকে সিলেট পর্যন্ত সমান্তরাল রেখা টেনে বাংলাদেশের সম্পূর্ণ ভূমি ভারতের হাতে তুলে দিতে হবে। যুক্তি দেখাতে গিয়ে মিস্টার স্বামী শুধু এক-তৃতীয়াংশ বাংলাদেশী মুসলমানের অনুপ্রবেশ ও বসবাসের তথ্য তুলে ধরেননি, একই সঙ্গে আরো বলেছেন, দেশ বিভাগের সময় ভারতকে ঠকিয়ে নাকি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে অনেক বেশি অঞ্চল দেয়া হয়েছিল! সে কারণেও বাংলাদেশের কাছ থেকে ভূমি আদায় করতে হবে।
আমরা মনে করি, বিজেপির এই কেন্দ্রীয় নেতার দাবি ও বক্তব্যকে হাল্কাভাবে নেয়ার পরিণাম বাংলাদেশের জন্য ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু সব জেনে-বুঝেও আওয়ামী লীগ সরকার যথারীতি মুখ বন্ধই রেখেছে। অথচ রাষ্ট্রের ক্ষমতায় রয়েছে বলে সরকারের উচিত ছিল দাবিটির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং ভারত সরকারের কাছে সুব্রামনিয়াম স্বামীকে গ্রেফতার করার এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানানো। কারণ, কথায় কথায় ক্ষমতাসীনরা ভারতের সঙ্গে তথাকথিত বন্ধুত্বের যে দোহাই দিয়ে থাকেন সুব্রামনিয়াম স্বামী সে বন্ধুত্বে ফাটল ধরানোরই উদ্যোগ নিয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপির লং মার্চ কর্মসূচির মধ্যে বন্ধুত্ব নস্যাতের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করলেও বিজেপি নেতার বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ দখলের দাবির মধ্যে সরকার কোনো অসতোদ্দেশ্যই দেখতে পায়নি! সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর এবং তথাকথিত সুশীল সমাজের নীরবতাও জনগণকে নিরাশই করেছে। এ ব্যাপারে ব্যতিক্রম ঘটিয়েছে কেবল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে বিজেপি নেতার দাবি ও বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থ ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণেই বিজেপির নেতা বাংলাদেশের ভূমি দাবি করার ঔদ্ধত্য দেখাতে পেরেছেন। আমরা জামায়াত নেতার সঙ্গে সম্পূর্ণ একাত্মতা প্রকাশ করি। আমরা একই সঙ্গে ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগকালীন বঞ্চনার ইতিহাসও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। কারণ, ঐতিহাসিকরা তো বটেই, আবুল মনসুর আহমদের মতো রাজনীতিক-সাহিত্যিকও ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখে গেছেন। এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের অসাধারণ গ্রন্থ ‘আসমাপ্ত আত্মজীবনী’তেও পূর্ব পাকিস্তানের বিভাগকালীন বঞ্চনা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্যের উল্লেখ রয়েছে। ঐতিহাসিকদের বিভিন্ন গ্রন্থের পাশাপাশি এ দুটি গ্রন্থ থেকেও জানা যায়, কোলকাতা এবং দার্জিলিং পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে পড়ার কথা ছিল। কোনো কারণে না দেয়া গেলে কোলকাতাকে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম বঙ্গের ‘কমন’ শহর করার ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এছাড়া কোলকাতা সংলগ্ন চব্বিশ পরগণার বারাকপুর, বারাসত, ভাঙ্গর, বশিরহাট ও মুর্শিদাবাদসহ বেশ কিছু এলাকা এবং করিমগঞ্জসহ আসামের বিরাট অঞ্চলও পূর্ব পাকিস্তানকে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে জওয়াহেরলাল নেহরু ও সরদার বল্লভভাই প্যাটেলদের কূটকৌশল এবং ইংরেজ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেনের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে পূর্ব পাকিস্তান বঞ্চিত হয়েছিল সর্বাত্মকভাবে। শেখ মুজিবুর রহমান জানিয়েছেন, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা হওয়া সত্ত্বেও যশোর জেলার বনগাঁ জংশন অঞ্চল, নদীয়ার কৃষ্ণনগর ও রানাঘাট জংশন, সম্পূর্ণ মুর্শিদাবাদ জেলা, মালদহের অর্ধেক অংশ, দিনাজপুরের বালুরঘাট মহকুমা এবং জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং ভারতকে দিয়েছিলেন মাউন্টব্যাটেন। অথচ শেখ মুজিব মনে করতেন, ‘উপরোক্ত জেলাগুলি কিছুতেই পাকিস্তানে না এসে পারতো না।’ ওদিকে সিলেটের গণভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও মাউন্টব্যাটেন মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ মহকুমা করিমগঞ্জকেও তুলে দিয়েছিলেন ভারতের ভাগে। এই বঞ্চনা শুধু অঞ্চল বা ভূমি না দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, ক্ষতিপূরণ বাবদ নগদ অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রেও পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। কথা ছিল, কোলকাতার বিনিময়ে পূর্ব পাকিস্তানকে নগদে ৩৩ কোটি টাকা দেয়া হবে। ঢাকাকে আন্তর্জাতিক মানে রাজধানী হিসেবে সাজিয়ে তোলার খরচ হিসেবে তখনকার দিনে ৩৩ কোটি টাকা যথেষ্ট ছিল। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে নেহরু-প্যাটেলরা চানক্য হিসাবের কূটচাল চেলেছিলেন। বাজার দরের পরিবর্তে ‘বুক ভ্যালু’র ভিত্তিতে মূল্য নির্ধারণ করায় এবং ইংরেজ সরকার সে দাবি মেনে নেয়ায় পূর্ব পাকিস্তানেরই উল্টো দেনা দাঁড়িয়েছিল ছয় কোটি টাকা। এভাবে ভৌগোলিক এবং অর্থনৈতিকÑ সবদিক থেকেই পূর্ব পাকিস্তানকে তথা আজকের বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। সুতরাং বাংলাদেশের কাছে ভূমি দাবি করার আগে সুব্রামনিয়াম স্বামীদের উচিত ইতিহাস স্মরণ করা। কারণ, অতীতের দিকে যদি ফিরতেই হয় তাহলে মুর্শিদাবাদ ও দার্জিলিং হয়ে কোলকাতার পাশাপাশি আসাম ও ত্রিপুরা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা উল্টো বাংলাদেশকেই দিতে হবে। এটাই ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য, এমন এক দল দেশের ক্ষমতায় রয়েছে যার কাছে দেশপ্রেমিক কোনো নীতি-অবস্থান ও ভূমিকাই আশা করা যায় না। সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে দিন দিন দেশের ভবিষ্যৎই বরং অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। এই সরকার দেশের মানচিত্রকেও অক্ষত রাখতে পারবে কি না সংশয় দেখা দিয়েছে এমনকি সে ব্যাপারেও।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন