বাংলাদেশ এনভাইরনমেন্টাল ল’ইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন (বেলা)-এর নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক গত বুধবার দুপুরে অপহৃত হয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার ভূঁইগড় এলাকা থেকে। যে কায়দায় বিএনপির অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীকে অপহরণ করা হয়েছিলো, ঠিক একই কায়দায় অপহরণ করা হয় আবু বকর সিদ্দিককেও। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বেলা অত্যন্ত সুনাম ও নিষ্ঠার সঙ্গে জনকল্যাণে পরিবেশ রক্ষার জন্য আন্দোলন করে আসছে। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন অত্যন্ত খ্যাতিমান পরিবেশ বিশেষজ্ঞ মঈনউদ্দিন আহমদ। এক পর্যায়ে রিজওয়ানা হাসান এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার সততা, কর্তব্য নিষ্ঠা ও দৃঢ়তার কারণে বেলা দেশে-বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে তার অসামান্য অবদানের জন্য সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান অত্যন্ত সম্মানজনক ম্যাগসাইসাই পুরস্কার লাভ করেন। ফলে রিজওয়ানা এখন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক ব্যক্তিত্ব।
আর তাই আবু বকর সিদ্দিক অপহৃত হওয়ার পর শুধু বাংলাদেশ নয় সারা পৃথিবীতে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়। স্বামী অপহৃত হওয়ার পর তার মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাংলাদেশের অন্যান্য পরিবেশ আন্দোলনকারী সংগঠনে টেলিফোন, ই-মেইল করতে থাকেন। দেশের ভেতরে সকল গণমাধ্যম ও বিদ্বৎসমাজ একযোগে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে। দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। এমনকি আইনজীবীরাও সরকারকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন আবু বকর সিদ্দিককে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য।
ইলিয়াস আলীর অপহরণের ঘটনার সঙ্গে আবু বকর সিদ্দিকের অপহরণ ঘটনাকে একই রকম বলেছি, তার কারণ ঘটনা পরম্পরায় একই ছিলো। কেবল ইলিয়াস আলী অপহরণ ঘটনা ঘটেছিলো রাতের বেলায়। আর আবু বকর সিদ্দিক অপহরণ হয়েছিলেন প্রকাশ্য দিবালোকে। ইলিয়াস আলীর বাসার কাছাকাছি একটি মাইক্রোবাস পেছন থেকে তাকে বহনকারী গাড়িকে ধাক্কা দেয়। ইলিয়াস আলীর চালক গাড়িটি থামালে পেছনের মাইক্রোবাস থেকে ৭/৮ জন লোক নেমে এসে ইলিয়াস আলী ও তার ড্রাইভারকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে নিতে উদ্যত হয়। তখন ধস্তাধস্তি হচ্ছিলো। রাতে টহলরত এক পুলিশ কর্মকর্তা গিয়ে অপহরণকারীদের একজনের কলার চেপে ধরেছিলো। তখন তারা নিজেদের র্যাবের লোক পরিচয় দিলে ঐ পুলিশ কর্মকর্তা সেখান থেকে সরে আসে। আশপাশের নির্মাণাধীন দালান থেকে একজন গার্ড ও ডাব বিক্রেতা এই দৃশ্য দেখে ফেলেছিলেন। পরে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। খোঁজ খবর করে জানতে পারলাম, প্রথমে ঐ পুলিশ কর্মকর্তাকে রাজারবাগে ক্লোজ করা হয়েছিলো। পরে তাকে ‘পাগল’ অভিহিত করে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরের দিন গার্ড ছুটিতে যায়। এরপর গার্ড ও ডাবওয়ালার আর খবর নেই।
ইলিয়াস আলী অপহরণ ঘটনার তদন্ত কাজ বহু আগেই থেমে গেছে। থামবার কথাও বটে কারণ প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছিলেন, ইলিয়াস আলী বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে আত্মগোপন করে আছেন এবং খালেদা জিয়ার নির্দেশ পেলে আবারও জনসম্মখে চলে আসবেন। তাতেই বোঝা গিয়েছিলো ইলিয়াস আলীর ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে। একটি নির্দিষ্ট পর্যায় গিয়ে সে মামলার তদন্ত কাজ আর অগ্রসর হয়নি। গত দুই বছরেও ইলিয়াস আলীর সন্ধান মেলেনি। এভাবেই হাওয়া হয়ে গেছেন বিএনপির ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলম। হাওয়া হয়েছেন আরও প্রায় সাড়ে তিন হাজার লোক। আর আশ্চর্যজনক ঘটনা হলো এই যে, এর কোনো একটি ঘটনারও তদন্ত কাজ পুরো হয়নি। মাঝপথে থেমে গেছে। একটি ঘটনায়ও অপহরণকারীরা ধরা পড়েনি। রাষ্ট্রচিন্তক কবি ফরহাদ মজহার এমনও বলেছিলেন যে, হতে পারে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ আবু বকর সিদ্দিককে ধরে নিয়ে গেছে।
এ সন্দেহও এই জন্য অমূলক নয় যে, এর মাত্র কয়েকদিন আগে ঢাকা থেকে এক ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে যায় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’। সে ঘটনাও বেশ কৌতুহলদ্দীপক, উদ্বেগজনক। কারণ সেই ব্যক্তি নাকি ছিলেন ভারতের কোনো জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর সদস্য। আর যে গল্প আমাদের শোনানো হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, ঐ ব্যক্তিকে নাকি পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা ‘আইএসআই’ একটি পাসপোর্ট দিয়েছে। সেই পাসপোর্ট দিয়ে প্রথম নেপালে যেতেন। সেখান থেকে পাকিস্তান। এই গল্পের আরও মাজেজা এই যে, আইএসআই তাকে যে পাসপোর্ট দিয়েছিলো তাতে নাকি কোনো এন্ট্রি স্ট্যাম্প ছিলো না। সেটি দেখে বাংলাদেশের বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের সন্দেহ হয় এবং তারা ঐ ব্যক্তিকে আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দিতে উদ্যত হন। আর এই ঘটনা দেখে ফেলেন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর লোকেরা। এরপর ‘র’ তাকে ভারতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। কীভাবে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো তার বর্ণনা অবশ্য আমরা জানতে পারিনি। ভারতীয় পত্রিকায় এ খবর ছাপা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এর কোনো প্রতিবাদ করেনি। তা থেকে মনে হয়, ঘটনা সত্য।
এর আর একটি অর্থ দাঁড়ায়। তা হলো ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র এখন বাংলাদেশ। তারা বাংলাদেশের মতো একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ থেকে যেকোন সময় যেকোন ব্যক্তিতে ধরে নিয়ে যাবার ক্ষমতা রাখে। কিংবা গোটা বাংলাদেশই হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতের ঘাতক গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। তারা নিজ দেশের মতোই বাংলাদেশেও অবাধে যা খুশি তাই করতে পারবে।
সরকারের ভেতরে এখন এক অদ্ভূত প্রবণতা কাজ করছে। কোনো ব্যক্তি সরকারের অপকর্ম সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করলে তার বিরুদ্ধে সরকার একেবারে হৈহৈ রৈরৈ করে উঠছে। সরকার টকশোওয়ালাদের অবিরাম চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করছে। বিদ্যুৎ নেই বলে যারা সমালোচনা করছে তাদের বাসার বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়ার কথা বলছে। পরিস্থিতি এমন নীচুতার পর্যায়ে পৌঁছেছিলো যে, ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত খ্যাতিমান সাংবাদিক এবিএম মূসার মৃত্যুর পর রেওয়াজ অনুযায়ী সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় সরকার তার জানাযাও হতে দেয়নি। তাকে সমাহিতকরণে রাষ্ট্রীয় মর্যাদাও দেয়া হয়নি। সরকারের নীচতা, সংকৃর্ণতা এই মাত্রায় পৌঁছেছে। সেজন্য কেউ যদি এমন সংশয় প্রকাশ করেন যে, প্রতিশোধ স্পৃহায় অন্ধ অতি নিম্নরুচির এই সরকার সত্যি সত্যি আবু বকর সিদ্দিকের অপহরণের সাথে জড়িত থাকে তবে তাকে বোধকরি দোষ দেয়া যায় না।
আবু বকর সিদ্দিকের অপহরণের সঙ্গে সরকার কেনো জড়িত হতে যাবে, এ প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়া স্বাভাবিক। এটি আমরা দেখেছি নারায়ণগঞ্জের ত্বকী হত্যা মামলার বেলায়। ত্বকীর বাবা রফিউর রহমান শামীম ওসমানের সমর্থক নন। সেই কারণে শামীম ওসমানের পারিবারিক টর্চার শেলে রফিউর রহমানের কিশোর পুত্রকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়। তারপর বস্তাবন্দী করে তার লাশ ফেলে দেয়া হয় নদীতে। রফিউর রহমানও আওয়ামী লীগ করেন। কিন্তু তিনি মেয়র আইভির সমর্থক। ফলে তার পুত্রকে হত্যা করে পিতার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়া হলো। এ রকম ঘটনা নারায়ণগঞ্জে অহরহ ঘটছে। তারপরও শেখ হাসিনা সরকার কবরীকে বাদ দিয়ে শামীম ওসমানকেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করে নিয়ে আসেন। কেননা আইভির চাইতে বহুল বিতর্কিত শামীম ওসমানকেই তার প্রয়োজন বেশি।
বেলার সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বহু প্রভাবশালী ভূমিদস্যু ও পরিবেশদস্যুর বিরুদ্ধে জনস্বার্থে মামলা করে উচ্চ আদালত থেকে রায় পেয়েছেন। সন্দেহ নেই তাতে ঐ ভূমিদস্যুরা অসৎ অর্থ উপার্জন থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অনেক ভূমি ও পরিবেশদস্যুই সরকারের ঘনিষ্ঠ মিত্র। আবু বকর সিদ্দিককে অপহরণ করার পর রিজওয়ানা তার সন্দেহের তালিকা থেকে এসব দস্যুকে বাদ দেননি। সর্বশেষ রিজওয়ানার অপরাধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ধানমন্ডি মাঠের মামলা পরিচালনা। এই মাঠ সবার জন্য উন্মুক্ত রাখতে বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন আদালতে একটি রিট দায়ের করেন। মামলাটি পরিচালনা করেন বেলার রিজওয়ানা হাসান। ফলে আদালত এই মর্মে আদেশ জারি করেন যে, ঐ মাঠ সবার জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। আর সেখানে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। কিন্তু একদল প্রভাবশালী ভূমিদস্যু এর নাম পরিবর্তন করে ‘লে. শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব’ রাখে। তারপর উঁচু দেয়াল তুলে, দেয়ালের উপর কাঁটাতার দিয়ে মাঠের গেটে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেয়া হয়-সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ। এই মামলা পরিচালনাই কি রিজওয়না পরিবারের জন্য কাল হয়েছে? ঘুরে ফিরে এ ক’দিন ধরে সারা দেশে আলোচ্য বিষয় ছিলো তাই।
আবু বকর সিদ্দিককে শুক্রবার রাতে অপহরণকারীরা মুক্তি দেয়। রিজওয়ানা পরিবারে কিছুটা হলেও স্বস্তি নেমে আসে। সবচাইতে বড় কথা রিজওয়ানা ফিরে পেয়েছেন তার স্বামী। আর তার সন্তানরা ফিরে পেয়েছে তাদের পিতাকে। কিন্তু স্বস্তিতে নেই তারা কেউই। শিগগির আবু বকর সিদ্দিক তার কর্মস্থলে ফিরতে পারবেন এমন আশা করা যায় না। রিজওয়ানাও খুব দ্রুত পূর্ণোদ্দমে তার পরিবেশ কার্যক্রম চালাতে পারবেন সেটাও মনে হয় না। যদিও তাকে যতোটা চিনি-জানি, তাতে দেখেছি, তিনি অত্যন্ত শক্ত ও দৃঢ়চেতা মানুষ। কিন্তু নিরাপত্তাহীনতা তাদের তাড়া করছে। স্বামী কর্মস্থলে যাবেন, নিরাপদ কি? রিজওয়ানা কাজে বেরোবেন, নিরাপদ কি? সন্তানরা স্কুলে যাবে, নিরাপদ কি? একথা রিজওয়ানাও বলেছেন। আমরাও অনুভব করছি। কিন্তু এই নিরাপত্তার বিধান সরকারকেই করতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে নিজগৃহেই যেনো বন্দী হয়ে আছেন রিজওয়ানা পরিবার। আমরা নাগরিকরা এই অবস্থা থেকে দ্রুত মুক্তি চাই।
তবু কিছু প্রশ্ন এখানে অমীমাংসিতই রয়ে গেলো। অনেক ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, এ ধরনের ক্ষেত্রে অপহৃত উদ্ধার হওয়ার পরও পুলিশী তৎপরতা চলেছে। কিন্তু আবু বকর সিদ্দিকের ক্ষেত্রে দেখলাম, পুলিশ যেনো সম্পূর্ণ তৎপরতাহীন। এখনও তাদের কোনো লক্ষণীয় তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। আর শুক্রবার রাত ১০টায় পুলিশ কী ভিত্তিতে রিজওয়ানাকে এই বলে আশ্বস্ত করেছিলো যে, চিন্তা করবেন না, আপনার স্বামী ভালো আছেন?
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন