আজ অধিকার আদায়ের জন্য মার্কিন শ্রমিকদের জীবনদানের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক মে দিবস। ১৮৮৬ সালের এই দিনে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো ও ইলিনয়সহ বিভিন্ন নগরীতে শ্রমিকরা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছিলেন। বিচ্ছিন্নভাবে নয়, সেদিনের আন্দোলন গড়ে উঠেছিল পর্যায়ক্রমে। যুক্তরাষ্ট্রেরও আগে অস্ট্রেলিয়ার শ্রমিকরা কাজের সময়সহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করেছেন। এর কারণ ছিল মালিকপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতা ও শোষণ। সেকালের শ্রমিকদের কাজের যেমন নির্দিষ্ট সময় ছিল না, তেমনি ছিল না বেতন-ভাতারও কোনো পরিমাণ। মালিকরা যাকে যতক্ষণ ইচ্ছা খাটিয়ে নিতেন, পারিশ্রমিকও দিতেন ইচ্ছামতো। সাপ্তাহিক বা মাসিক ছুটিরও তখন কোনো আইন বা নিয়ম ছিল না। শ্রমিকরা এমনকি কঠিন অসুস্থতার সময়ও ছুটি পেতেন না। তাদের বরং চাকরি চলে যেত। প্রতিবাদ করতে গেলেও নির্যাতনের শিকার হতে হতো। সবমিলিয়েই শ্রমিকরা ছিলেন ভীষণভাবে নির্যাতিত ও বঞ্চিত। অন্যদিকে ওই যুগে দ্রুত ঘটছিল শিল্পের বিকাশ। এর ফলে শ্রমিকদের চাহিদা যেমন বাড়ছিল, তেমনি বাড়ছিল শ্রমিকদের সংখ্যাও। ফলে আন্দোলন গড়ে তোলাও সহজ হয়ে উঠছিল। আন্দোলনের অংশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিনদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল শ্রমিক সংগঠনগুলো।
১৮৮৬ সালের পহেলা মে শিকাগো নগরীর ‘হে মার্কেটে’ এক সমাবেশ আয়োজিত হয়েছিল। কিন্তু শান্তিপূর্ণ সে সমাবেশে পুলিশ গুলীবর্ষণ করে। গুলীতে নিহত হয়েছিলেন চারজন শ্রমিক। প্রতিবাদে পরদিন বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সে সমাবেশেও বানোয়াট অভিযোগে পুলিশ গুলী চালিয়েছিল। এতে নিহত হয়েছিলেন ১২ জনের বেশি শ্রমিক। দাবি পূরণের পরিবর্তে মার্কিন সরকার উল্টো বিচারের প্রহসন করেছে এবং চারজন বিক্ষোভকারীকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দিয়েছে। এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও বৃটেনের পাশাপাশি বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোতে। সব দেশেই ৮ ঘণ্টা সময় নির্ধারণ ও সাপ্তাহিক ছুটিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ও অধিকারের দাবিতে আন্দোলন হয়েছে। সব দেশের সরকারই প্রথমে আন্দোলন প্রতিহত ও নির্মূল করার চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ ও বলিষ্ঠ আন্দোলনের মুখে সব সরকারকেই পিছু হটতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও’র মধ্যস্থতায় দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের সময়, একদিন সাপ্তাহিক ছুটি এবং চিকিৎসা সুবিধার মতো দাবিগুলো স্বীকৃত হয়েছিল। এসবের ভিত্তিতেই পরবর্তীকালে শ্রমিক-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা ক্রমাগত বেড়েছে। প্রতিবছর পহেলা মে’কে তাই বিশ্বের সব দেশে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
মে দিবস শুধু সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের জন্য মহিমান্বিত দিন নয়, দিনটির মধ্যে শিক্ষারও নানাদিক রয়েছে। মালিকপক্ষের জন্য শিক্ষার মূলকথা হলো, নিজেদের পুঁজি ও শিল্পের নিরাপত্তা বিধান ও বিকাশ ঘটানোর স্বার্থেই শ্রমিকদের চাহিদা পূরণ করা দরকার। কারণ শ্রমিকরা অসন্তুষ্ট কিংবা রোগাক্রান্ত থাকলে তাদের পক্ষে সম্পূর্ণ শক্তি খাটিয়ে ও মেধার ব্যবহার করে সেবা দেয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে শ্রমিকদের জন্য শিক্ষার মূলকথা হলো, সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার কেবল চাইলে চলবে না, সেগুলো দেয়ার মতো ক্ষমতাও মালিকপক্ষকে অর্জন করে দিতে হবে। এ কথা বুঝতে হবে, লাভ না হলে মালিকের পক্ষে শ্রমিকদের দাবি ও চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হতে পারে না। এভাবে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের মিলিত চেষ্টাতেই একদিকে শিল্পের বিকাশ ঘটানো সম্ভব, অন্যদিকে শ্রমিকদের দাবি ও চাহিদা পূরণ এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করা সহজে সম্ভব হতে পারে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেও মে দিবসের শিক্ষার বিশেষ দিকগুলোকে বিবেচনায় রাখা দরকার। যেমন বিশ্লেষণের এই দৃষ্টিকোণ থেকে গার্মেন্ট শিল্পের প্রায় নিয়মিত ধ্বংসাত্মক কর্মকা-কে সমর্থনযোগ্য বলা যায় না। রফতানি আয়ের প্রধান মাধ্যম এ খাতটির ব্যাপারে উভয়পক্ষকেই যথেষ্ট সংযম দেখাতে হবে। শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যসব শিল্পের ব্যাপারেও একই পরামর্শ প্রযোজ্য। আমরা আশা করতে চাইÑএবারের মে দিবসে শ্রমিকরা শুধু নন, মালিকরাও নতুন করে শিক্ষা নেবেন এবং উভয়পক্ষ মিলিতভাবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকে জোরদার করবেন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন