গত মঙ্গলবার হঠাৎ করেই ভারত তিস্তা নদীর কিছু পরিমাণ পানি ছেড়েছে। এর ফলে বেড়ে গেছে পানির গতিপ্রবাহ এবং পরিমাণ। বছরের এই সময়ে তিস্তার বাংলাদেশ অংশে যেখানে আট থেকে দশ হাজার কিউসেক পানি থাকার কথা সেখানে বিগত বেশ কিছুদিন ধরে পানির পরিমাণ ছিল চারশ’ থেকে পাঁচশ’ কিউসেক মাত্র। এর কারণ সম্পর্কে নিশ্চয়ই নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশকে পানিপ্রতিবন্ধী রাষ্ট্রে পরিণত করার সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য থেকে এ বছরও তিস্তার উজানে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করেছিল ভারত। বাংলাদেশকে প্রাপ্যবঞ্চিত করে সে দেশের অন্য কিছু অঞ্চলে পানি সরিয়ে নিয়েছে ভারত সরকার। পরিণতিতে বাংলাদেশে শুকিয়ে গেছে তিস্তা। মাইলের পর মাইল জুড়ে বালু জমে চরতো পড়েছেই, চাষাবাদও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশেষ করে। পানির অভাবে কৃষকরা বোরোসহ কোনো ফসলেরই আবাদ করতে পারেনি। এক লাখ ১১ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদের লক্ষ্য নিয়ে তৈরি তিস্তা সেচ প্রকল্পে জমির পরিমাণ কমতে কমতে এবার মাত্র ১০-১২ হাজার হেক্টরে নেমে এসেছিল। কিন্তু সেটাও সম্ভব হচ্ছিল না। নদীতে পানি না থাকায় কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটসহ তিস্তার তীরবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানিতেও টান পড়েছিল। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, ডিপটিউবওয়েল দিয়েও পানি ওঠানো যাচ্ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই হাহাকার উঠেছিল ভীত-আতঙ্কিত কৃষকদের মধ্যে। ‘কোনঠে আছেন দেশদরদী, হামাক বাঁচান’Ñ বলে চিৎকার করেছে তারা। কিন্তু সব জেনে-শুনেও আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেনি। তিস্তায় পানি আনার জন্য কোনো চেষ্টা করতেও দেখা যায়নি সরকারকে। ঠিক এ সময়ই সোচ্চার হয়েছেন দেশপ্রেমিক প্রধান জাতীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তিস্তা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। সে অনুযায়ী ২২ এপ্রিল শুরু করে গতকাল ২৩ এপ্রিল তিস্তা ব্যারেজের ডালিয়া পয়েন্টে জনসমাবেশের মধ্য দিয়ে লংমার্চ শেষ করেছে বিএনপি। কিন্তু এরই মধ্যে নাটকীয়ভাবে লংমার্চের প্রথমদিনই তিস্তায় পানি ছেড়েছে ভারত সরকার।
বলা বাহুল্য, লংমার্চকে ব্যর্থ করাসহ ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গড়ে উঠতে থাকা আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করাই ভারতের প্রধান উদ্দেশ্য। না হলে বেছে বেছে ঠিক লংমার্চ শুরুর দিনটিতেই দেশটি পানি ছাড়তো না। কারণ, তিস্তা শুকিয়ে যাচ্ছে বহুদিন ধরে। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিও তোলা হয়েছে অনেক আগে থেকে। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং যখন বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন তখন তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরই তার প্রধান কর্মসূচি ছিল। সে ঘোষণাও ভারতের পক্ষ থেকেই দেয়া হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকারও বলেছিল, তিস্তা চুক্তি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে সমস্যা তৈরি করেছিলেন পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তিনি শুধু পরিকল্পিত চুক্তির বিরোধিতাই করেননি, একই সঙ্গে বাংলাদেশ সফরে আসতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বাংলাদেশকে কতোটা পানি দেয়া হবে সে বিষয়ে তার সঙ্গে নাকি ‘প্রতারণা’ করেছেন মনমোহন সিং। কথা নাকি ছিল বাংলাদেশকে ২৫ হাজার কিউসেক দেয়া হবে। কিন্তু চুক্তির খসড়ায় ৩৩ হাজার কিউসেক দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। এতেই বেঁকে বসেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। ভারতের নেতারা মমতাকে রাজি করাতে পারেননি। কারণ, তিস্তা তার কাছে তাদের রাজ্যের উত্তর বঙ্গের কৃষির জন্য ছিল ‘লাইফ লাইন’। এজন্যই এক ইঞ্চি পরিমাণ ছাড় দেননি মমতা। একই কারণে তিস্তা চুক্তিও স্বাক্ষরিত হতে পারেনি। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ওপারে তিস্তার ৪৫ কিলোমিটার উজানে ভারত এমন এক গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করেছে যার ফলে কোনো চুক্তি হলেও বাংলাদেশ খুব একটা পানি পেতো না। ৪১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা নদীর মাত্র ৪৫ কিলোমিটারের পানি ভাগাভাগি নিয়েই এতো কিছু ঘটেছে। মমতা ব্যানার্জি ঘাড় না বাঁকালেও এবং সত্যি সত্যি কোনো চুক্তি হলেও বাংলাদেশ লাভবান হতে পারতো না। এর কারণ শুধু মোট পানির পরিমাণ নয়, ভারতীয়দের চাণক্য কৌশলও। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভারতীয়দের বাংলাদেশ নীতি। কারণ, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারত পানি আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে বহুদিন ধরে। তিস্তার পানি আটকে দেয়া সে আগ্রাসনেরই একটি অংশ মাত্র।
আমরা মনে করি, এ কথা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করা দরকার যে, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে কখনো, কোনো পর্যায়েই সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করেনি। অদূর ভবিষ্যতেও ভারতীয়দের নীতি-মনোভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। সে জন্যই বাংলাদেশকেও তার স্বার্থে নীতি-অবস্থান নির্ধারণ করতে হবে। এ ব্যাপারে বিএনপি’র তিস্তা অভিমুখীন লংমার্চ থেকে শিক্ষা নেয়া যেতে পারে। বিএনপি আন্দোলন শুরু করেছিল বলেই সাময়িক কৌশল হিসেবে হলেও ভারত তিস্তায় পানি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা মার্চের কথাও স্মরণ করা দরকার। গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে ১৯৭৬ সালের ১৬ মে তিনি রাজশাহীর কানসাট পর্যন্ত লংমার্চ করেছিলেন। মওলানা ভাসানীর সে লংমার্চ ব্যাপক প্রচারণা পেয়েছিল। মূলত এই মিছিলের জনপ্রিয়তা এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এর ব্যাপক প্রচারণার ফলেই ভারতকে বহুদিন পর বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসতে হয়েছিল। জনগণের ঐক্য প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে সাহস যুগিয়েছিল। ১৯৭৬ সালেই তিনি জাতিসংঘে ফারাক্কা বাঁধের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের রাজনৈতিক কমিটির ২৪ নভেম্বরের সর্বসম্মত বিবৃতির ভিত্তিতে ভারত ও বাংলাদেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক শুরু হয়েছিল এবং এই প্রক্রিয়ায় ১৯৭৭ সালের ৫ নবেম্বর ঢাকায় স্বাক্ষরিত হয়েছিল ‘ফারাক্কা চুক্তি’। আমরা মনে করি, বর্তমান পর্যায়ে তিস্তার বিষয়টিকেও যদি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে উত্থাপন করা যায় তাহলে ভারতের পক্ষে একতরফাভাবে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করা এবং বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এটা অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে আশা করা যায় না। যা কিছু করার সবই বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ দেশপ্রেমিক দলগুলোকেই করতে হবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন