১৯৭২-৭৫ সালে শেখ মুজিবের শাসনকালে
পরলোকগত সাংবাদিক নির্মল সেন দৈনিক বাংলায় এই শিরোনামে কলাম লিখেছিলেন, ‘সত্য বলা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে’। সে সময়ের সংবাদপত্রে সত্য প্রকাশিত
হলেই আওয়ামী শাসক মহলে একেবারে হৈ হৈ রৈ রৈ পড়ে যেত। এরা রাজাকার, এরা পাকিস্তান ও চীনের এজেন্ট। এদের মুজিববাদের নিড়ানি দিয়ে উপড়ে ফেলতে হবে।
সেরকম উপড়ে ফেলার জন্য নানা ধরনের বাহিনী তৈরি করেছিলেন। লাল বাহিনী, নীল বাহিনী গঠিত হয়েছিল শাসক দলের নেতৃত্বে। আর সরকারিভাবে গঠিত হয়েছিল রক্ষীবাহিনী।
শুনেছি, আগের দিনে শিশু কাঁদলে মায়েরা তাদের এই বলে থামাবার চেষ্টা করতেন
যে, চুপ চুপ, বর্গি আসবে। আওয়ামী লীগের প্রথম শাসনকালে শিশুদের
কান্না থামাতে বলা হতো, চুপ চুপ, রক্ষীবাহিনী আসবে। হাজারো মায়ের
বুক খালি করে, বহু বোনকে বিধবা করে, বহু শিশুকে পিতৃহারা করে এসব
বাহিনী বাংলাদেশে হাজার হাজার মানুষকে খুন করেছে।
এমন সব
ঘটনার প্রতিবাদের সহজ কোনো পথ সে সময় আর অবশিষ্ট ছিল না। পত্রিকা অফিসে তালা, যখন তখন হামলা, সাংবাদিকদের ওপর বর্বর পুলিশি নির্যাতন এগুলো ছিল সেই শাসনকালে দৈনন্দিন ঘটনা। ১৯৭২ সালে যখন নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাসদ
দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকা প্রকাশ করল, তখন থেকেই পত্রিকাটির ওপর খুব রুষ্ট ছিলেন তখনকার
সরকারপ্রধান। রেসকোর্সের জনসভায় দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘৩০ বচ্ছর রাজনীতি করলাম, একটা পত্রিকা বের করতে পারলাম না। টাকা কোথা হইতে
আসে?’ ওই গণকণ্ঠ পত্রিকা অফিসে হামলা তখন নিত্যদিনের ব্যাপার
হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তখন জাসদের গণকণ্ঠ, মওলানা ভাসানীর হক কথা, সাপ্তাহিক হলিডে, স্পোক্সম্যান, মুখপত্র ও চট্টগ্রামের ইস্টার্ন
এক্সামিনার এগুলোই ছিল বিরোধী সংবাদপত্র। এগুলোর মধ্যে প্রচার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল
গণকণ্ঠ ও হক কথা’র। সে সময় হেন নির্যাতন নেই, যা এসব পত্রিকার বিরুদ্ধে করা
হয়নি। এসব পত্রিকার সম্পাদকদের গ্রেফতার করে জেলে পোরা হয়েছে। জাতীয় সংসদ থেকে শুরু
করে সব ফোরামে এদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করা হয়েছে এবং এখনকার মতোই অশোভন ভাষায় তাদের
গালাগাল করা হয়েছে। তারা এখনো যা করছেন, সে সময়ও তাই করেছিলেন। ৪০ বছর
পরেও তাদের ভেতরে নতুন শিক্ষা কিংবা বয়সের প্রাজ্ঞতার পরিচয় দেখতে পাচ্ছি না। ‘ফরগিভ’ না পাওয়া এক মন্ত্রী ফরগিভ না কিসের আশায় এমন ভাষায় কথা বলছেন
যে, যেগুলো মাতারিদেরও হার মানায়। কেউ যখন যুক্তিতে পারে না, তখন সে গালিগালাজের আশ্রয় নেয়। ভদ্রলোকেরা গালিগালাজ করতে পারে না। তাদের সুরুচিতে
বাধে। ফলে ভদ্রলোকেরা অনেক সময়ই হেরে যায়। এখনো পরিস্থিতি তেমনি আছে। পৃথিবী বদলে গেলেও
ঠ্যাঙাড়ে চরিত্র কখনো বদলাবার নয়।
সম্প্রতি
বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দু’টি বক্তব্য নিয়ে এমনই এক পরিস্থিতির
সৃষ্টি হয়েছে। প্রথম দফায় তারেক রহমান বলেছেন যে, জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের
প্রথম প্রেসিডেন্ট। দ্বিতীয় বক্তব্য হচ্ছে, শেখ মুজিব ১৯৭২ সালে অবৈধভাবে
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এ কথাগুলো না বললে চলত কি না সে প্রসঙ্গ ভিন্ন।
কারণ আমরা দেখি, আওয়ামী লীগ নন-ইস্যুকে অবিরাম ইস্যু বানিয়ে মূল ইস্যু থেকে মানুষের
দৃষ্টি ভিন্ন দিকে সরিয়ে নেয়। এর মধ্যে মতলব আছে। মতলবের ফাঁদে আমরা ধরাও দিই। আর আড়ালে
আওয়ামী লীগ তার অপকর্মগুলো চালিয়ে যেতে থাকে। তখন আলোচনার শোরগোল উঠতে শুনি না। জিয়াউর
রহমান যে বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন সেটি এখন একটি বিশেষ আলোচিত প্রসঙ্গ।
তার ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা যারা শুনেছেন, তারা জানেন। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর প্রধান ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে
সে ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতারা তাকে বোঝান যে, ঘোষণাটি শেখ মুজিবের নামে দিলে তা অধিকতর কার্যকর হবে। সেটিও যৌক্তিক ছিল।
ফলে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ তিনি যে ঘোষণাটি দেন, তা দিয়েছিলেন শেখ মুজিবের পক্ষে।
সে ক্ষেত্রে
আওয়ামী লীগ নেতারা জিয়াউর রহমানের বদলে নিজেরা ঘোষণাটি দিতে চাননি। কারণ তারা এটা উপলব্ধি
করেছিলেন যে, যুদ্ধের জন্য পেছনে একজন সেনা কর্মকর্তা থাকা ভালো। এ নিয়ে পরবর্তী
সময়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি। কার্যত ১৯৭১ সালে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার
আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব জিয়াউর রহমানের হাতেই
ছিল। প্রেসিডেন্টই বলি, স্বাধীনতাযুদ্ধই বলি, রাষ্ট্রের চালিকাশক্তিই বলিÑ সব কিছুর দায়িত্বই পালন করেন
তিনি। সেটি বই লিখে স্বীকার করেছেন জেনারেল সফিউল্লাহ, আবুল মাল আবদুল মুহিতসহ আওয়ামী লীগ নেতারা।
এখন কেউ
কেউ বলছেন, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন বলেই পাকিস্তান বাহিনী
তাকে গ্রেফতার করেছিল। এটি ডাহা মিথ্যা কথা। এ কথা সত্য যে, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে তার ভাষণে বলেছিলেন
যে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের
সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এটিই যদি তার স্বাধীনতার ঘোষণা হয়ে থাকে তাহলে পাকিস্তান
সরকার ২৩ মার্চ পর্যন্ত তার সাথে এক টেবিলে বসে আলোচনায় প্রবৃত্ত হতো না। বরং সে সময়ই
তাকে গ্রেফতার করত এবং গোটা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য তিনি শেষ পর্যন্ত
পাকিস্তান সরকারের সাথে আলোচনা চালিয়ে গেছেন। ১৯৭৩ সালে দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত বেগম
ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের সাক্ষাৎকারে দেখা যায় আরেক চিত্র। ফলে এ চ্যাপ্টারগুলো ওখানেই
শেষ হওয়ার কথা।
এবার নতুন
প্রসঙ্গ। তারেক রহমান গত ৯ এপ্রিল লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার সেন্ট্রাল হলে এক সুধী সমাবেশে
বলেছেন যে, বাংলাদেশের প্রথম ‘অবৈধ’ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। অবৈধ কেন ছিলেন তারও প্রমাণ তিনি উপস্থিত
করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গৃহীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে
লেখা রয়েছে যে, ‘এতদ্বারা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি
যে, সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের
রাষ্ট্রপতি থাকিবেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রজাতন্ত্রের উপ-রাষ্ট্রপতি থাকিবেন।’ সঙ্গতভাবেই তারেক রহমান প্রশ্ন তুলেছেন যে, কিন্তু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি
স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে শেখ মুজিব ১২ জানুয়ারি কিভাবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন? তখনো তো সংবিধান প্রণীত হয়নি।
তিনি এই
প্রশ্ন উত্থাপনের পর জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে সর্বত্র খিস্তি-খেউরের ঝড় উঠেছে তারেক রহমান অর্বাচীন, তারেক রহমানের মস্তিষ্ক পরীক্ষা করা উচিত, ‘তোর বাপ স্যার বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলত’, ‘খালেদা জিয়া আপনার ছেলেকে সামলান’। কোনটি সত্য ইতিহাসই সাক্ষ্য দেবে। কিন্তু সত্যিই তো সংবিধান যখন প্রণীতই
হয়নি, তাহলে দেশে ফিরে সংবিধান প্রণীত হওয়া পর্যন্ত শেখ মুজিবের রাষ্ট্রপতিই
থাকা উচিত ছিল। কী বিধানবলে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র উপেক্ষা করে শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর
দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারলেন। এই সময়টুকুর জন্য স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনাকারী তাজউদ্দীন
আহমদ প্রধানমন্ত্রী থাকলে এমন কোন্ মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত?
সে হিসেবে
কোনো বিধি-বিধানেরই তোয়াক্কা করেনি তখনকার আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। তাদের ইচ্ছা হয়েছে, তিনি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র লঙ্ঘন করেছেন। এই কথা শুধু তারেক রহমান বলেননি।
এটাই ঐতিহাসিক সত্য যে, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি
সম্পর্কে এমন বিধানই ছিল। গত ১০ এপ্রিল ‘স্বাধীন বাংলা সরকার গঠন দিবস
আজ’ শিরোনামে দৈনিক ইত্তেফাক-এর প্রথম পৃষ্ঠার চতুর্থ কলামের শীর্ষে
একটি সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। তাতেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘১৯৭১ সালের এদিন মানুষের প্রতি মমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার
নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়।
সরকার গঠনের পর আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (প্রোকেমেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্স)
পাঠ করা হয়।’ ‘ঘোষণায় বলা হয়, স্বাধীন বাংলাদেশে সংবিধান প্রণীত
না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল
ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি থাকবেন। সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন
বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ভাষণ দেন।’
এবার কি
তাহলে আপনারা সমস্বরে আপনাদের মন্ত্রিসভার সদস্য আনোয়ার হোসেনকে অর্বাচীন, তুই তুকারি করে গালিগালাজ করবেন? স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে আমরা
যদি দলিল হিসেবে মানি, তাহলে হুট করে শেখ মুজিবের প্রধানমন্ত্রী হওয়া অবশ্যই
রীতিসম্মত ছিল না। আওয়ামী লীগের রুচি-বিবর্জিত মন্ত্রীরা এ কথা বলছেন না যে, তারেক রহমান মিথ্যা বলেছেন কোথায়। তিনি সত্য বলেছেন এবং বিপদে পড়েছেন। তিনি
শুধু একা নন, এই সমাজে যারাই সত্য বলে, তারাই সরকারের এরকম কঠোর সমালোচনার
মুখোমুখি হয়। ফলে সত্য বলা আবারো বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন