বৃহস্পতিবার, ১ মে, ২০১৪

হাতখুলে লিখতে মানা, মুখফুটে বলতে মানা


অজানাকে জানার আগ্রহ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। জন্মলাভের পর শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ় ও বার্ধক্যে পদার্পণ অবধি আমৃত্যু জানার প্রবণতা মানুষের অব্যাহত থাকে। প্রকৃতিগতভাবে  কোনো ব্যক্তি স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে অধিক জ্ঞানসম্পন্ন হলে তিনি তার জ্ঞান বিভিন্নভাবে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে সমাজকে বিকশিত করার ক্ষেত্রে নিবেদিত থাকেন। মানুষ অক্ষরজ্ঞানে সমৃদ্ধ হওয়ার পর প্রাথমিক পর্যায়ে পাথরে খোদাই করে অথবা গাছের বাকলে লিখে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করত। কাগজের ব্যবহার শুরু হওয়ার পর হাতের লেখার প্রচলন হয়, যা ছাপাখানা আবিষ্কারের পর যুগান্তকারী পরিবর্তনের মাধ্যমে নব অধ্যায়ের সূচনা করে। এখনকার কম্পিউটার প্রযুক্তি এ নব অধ্যায়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। আগামীতে নতুন কোনো ধরনের আবিষ্কার এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনকে কোথায় নিয়ে যাবে তা এখনো আমাদের অজানা হলেও দেখার জন্য হয়তো আর বেশিকাল অপেক্ষা করতে হবে না। 

জানার পিপাসা পূরণে বর্তমানে বই, খবরের কাগজ, রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট প্রভৃতির ভূমিকা অপরিসীম। এখন এসব মাধ্যমে জ্ঞানের পিপাসা নিবারণে যারা কাজ করছেন তাদের সবাই আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক শিক্ষাদানে যারা নিয়োজিত তারাও শিক্ষার্থীদের জ্ঞানকে একটি নির্দিষ্টপর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার কাজ করছেন।

খবরের কাগজকে এখন বলা হয় কাগুজে গণমাধ্যমে। অপর দিকে রেডিও ও টেলিভিশনকে বলা হয় ইলেকট্রিন গণমাধ্যম। আর ইন্টারনেট হলো রেডিও ও টেলিভিশনের ক্ষেত্রে গণযোগাযোগ এবং ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ প্রভৃতির ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। ইন্টারনেটের বদৌলতে বিভিন্ন খবরের কাগজ এখন ইন্টারনেট সংস্করণ বের করছে এবং প্রতিটি খবরের কাগজের ক্ষেত্রেই পরিলক্ষিত হচ্ছে ইন্টারনেট সংস্করণের পাঠক সংখ্যা কাগুজে সংস্করণের চেয়ে অনেক বেশি। 

সংবাদপত্রে একজন সাংবাদিকের লেখার দৃষ্টিভঙ্গি এবং একজন কলামিস্টের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। একজন সাংবাদিক সাধারণ পাঠকের কাছে সহজে বোধগম্য হয় এমন বিষয়টিকে সামনে রেখে সংবাদ পরিবেশনের প্রয়াস নেন। অন্য দিকে একজন কলামিস্ট একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধ লিখে পাঠকের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে সচেষ্ট থাকেন। এমন অনেক সাংবাদিক আছেন যারা একই সাথে সাংবাদিক ও কলামিস্ট। সংবাদপত্রের সব সাধারণ পাঠক কলাম পাঠক নয়। সাধারণ পাঠকের তুলনায় কলাম পাঠকের সংখ্যা অনেক কম হলেও কলামিস্টদের বিশ্লেষণধর্মী লেখনী জনমতের ওপর ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে দেখা যায়। কলামিস্টদের নিবন্ধের অনুরূপ বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের টেলিভিশন টকশো বেশ কিছুকাল ধরে দর্শকপ্রিয় হয়ে জনমত গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে। 

একজন কলামিস্ট ও টেলিভিশনের টকশোর আলোচক দেশের সংবিধান অনুযায়ী চিন্তা, বিবেক,  বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করলেও তা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা,  বৈদেশিক সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে নিয়ন্ত্রিত। এ নিয়ন্ত্রণের পরিধি আইন দ্বারা নির্ধারিত। এ বিষয়ে প্রধান দুটি আইন হলো (১) অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট, ১৯২৩ ও (২) তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ । উভয় আইনের পরিপন্থী কাজকে অপরাধগণ্য বিবেচনায় শাস্তিযোগ্য করা হয়েছে। 

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সরকার সময় সময় আইনের দোহাই দিয়ে চিন্তা, বিবেক, বাক ও ভাব প্রকাশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলেও এ ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশে প্রবণতাটি বেশি পরিলক্ষিত হয়। এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশও ব্যতিক্রম নয়। তবে অবাক হতে হয় যখন দেখা যায় এ নিয়ন্ত্রণ খবরের কাগজ বা বেসরকারি টেলিভিশন কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে আসছে। 

অনেক সময় খবরের কাগজ বা বেসরকারি টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ সরকারের চাপের কারণে নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী হয়। আবার অনেক সময় দেখা যায় নিজ ব্যবসায়িক স্বার্থে নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস নেয়া হচ্ছে।

অতীতে সাংবাদিকতা পেশার সাথে সংশ্লিষ্টরা খবরের কাগজের মালিকানা, প্রকাশনা ও সম্পাদনার দায়িত্বে থাকতেন। এখন শেষোক্ত দায়িত্বটি সাংবাদিকদের কাছে অর্পিত থাকলেও প্রথমোক্ত দুটি দায়িত্ব খবরের কাগজের শিল্পপতি মালিক বা তার প্রতিনিধি হিসেবে পরিবারের অপর কেউ পালন করছেন। 

শিল্পপতিরা খবরের কাগজের মালিকানা ও প্রকাশকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ব্যবসায়িক স্বার্থ বিঘিœত হবে এ অজুহাতে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন ও তথ্যসমৃদ্ধ বিশ্লেষণাত্মক নিবন্ধ প্রকাশে নিজেদের নিবৃত্ত রাখছেন। 

খবরের কাগজের মূল আয় আসে বিজ্ঞাপন হতে। এই বিজ্ঞাপন সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দিয়ে থাকে। সরকারি বিজ্ঞাপন বিতরণের ক্ষেত্রে নীতিমালা থাকলেও দেখা যায় যেসব খবরের কাগজ সরকারের গুণকীর্তনে ব্যস্ত তাদের অন্য খবরের কাগজকে বঞ্চিত করে অধিক হারে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। বেসরকারি বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে সরকারি নীতিমালাসংক্রান্ত বাধ্যবাধকতা না থাকলেও বিজ্ঞাপনদাতা শিল্পমালিকের ইচ্ছার ওপর  নির্ভর করে থাকে তিনি কোন ধরনের খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেবেন। এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনদাতা শিল্পমালিকের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থেকে থাকলে খবরের কাগজ কর্তৃপক্ষের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা প্রাধান্য পায়। 

তা ছাড়া কিছু কিছু খবরের কাগজ ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন যেমন- বাড়ি ভাড়া, বাড়ি বিক্রয়, পড়াতে চাই, পাত্র-পাত্রী চাই, হারানো বিজ্ঞপ্তি, গাড়ি বিক্রয়, জমি বিক্রয় প্রভৃতি থেকে উল্লেখ্যযোগ্য পরিমাণ অর্থ আয় করে থাকে। ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনদাতা সাধারণত পত্রিকার বহুল প্রচারণার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে থাকে। 

খবরের কাগজের বিক্রয়লব্ধ অর্থ কাগজ প্রকাশের সামগ্রিক ব্যয়ের কিয়দংশ নির্বাহ করে। অবশিষ্ট বেশির ভাগ ব্যয়ের জন্য বিজ্ঞাপনকে অবলম্বন হিসেবে দেখা হয়। 

আমাদের দেশে দুই ধরনের খবরের কাগজ রয়েছে। এর একটি হলো ডান ধারার খবরের কাগজ আর অপরটি হলো বাম ধারার খবরের কাগজ। এর বাইরে একটি মধ্যম ধারার সন্ধান পাওয়া যায় যাকে বলা হয় নিরপেক্ষ। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রেখে খবরের কাগজ প্রকাশ অনেক সময় দুরূহ হয়ে ওঠে।

রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দলের  নীতি ও আদর্শের প্রতি সহানুভূতিশীল খবরের কাগজ পড়ার পাশাপাশি দলের ব্যর্থতা জানার জন্য বিরোধীভাবাপন্ন খবরের কাগজ পড়ে থাকেন। রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা ক্ষমতায় থাকাকালে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিভিন্ন কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় বিরোধীভাবাপন্ন খবরের কাগজ পড়ে তারা জনসমর্থন অনুধাবন করা বা নিজেদের ব্যর্থতা সম্পর্কে ধারণা পেতে পারেন। সফল রাজনীতিবিদেরা সবসময় বিরোধীভাবাপন্ন খবরের কাগজ অধিক মনোযোগসহকারে পড়ে থাকেন। নিরপেক্ষ খবরের কাগজের আবেদন সার্বজনীন। 

বেসরকারি টেলিভিশনের শতভাগ আয় আসে বিজ্ঞাপন হতে। বর্তমানে বিভিন্ন শিল্পপতি দৈনিক খবরের কাগজের মতো বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলেরও মালিক। টেলিভিশনের অন্যান্য অনুষ্ঠানের তুলনায় টকশোর ব্যয় অনেক কম। কিন্তু দর্শকপ্রিয়তা অন্য যেকোনো অনুষ্ঠানের তুলনায় টকশোর অনেক বেশি। তাই বলে সব টকশো এবং সব আলোচকের গ্রহণযোগ্যতা একই ধরনের নয়। 

দুর্নীতি, অপশাসন, ব্যর্থতা প্রভৃতি কারণে সরকারের জনপ্রিয়তা কমা সত্ত্বেও যদি সরকারের পক্ষাবলম্বনে নিবন্ধ লেখা ও টেলিভিশন টকশোতে বক্তব্য প্রদান করা হয় তা পাঠক বা দর্শকপ্রিয়তা পায় না। নিরপেক্ষ লেখক ও আলোচকের গ্রহণযোগ্যতা সবসময় পক্ষপাতদুষ্টু লেখক ও আলোচকের চেয়ে অধিক হয়ে থাকে। 

খবরের কাগজ ও বেসরকারি টেলিভিশনের মালিকানার সাথে শিল্পোদ্যোক্তারা সম্পৃক্ত হওয়ার পর থেকে তাদের অনেকের কাছে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর সংবাদ ও নিবন্ধের চেয়ে ব্যবসায়িক স্বার্থ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর এই ব্যবসায়িক স্বার্থ দেখতে গিয়ে অনেক সময় জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর সংবাদ ও নিবন্ধ অযাচিত হস্তক্ষেপে ছাপার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে দেখা যায়। 

সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে এমন অনেক কর্ণধার রয়েছেন যারা সরকারি ও বেসরকারি বিজ্ঞাপনকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন। এদের কেউ দুর্নীতিতে নিমগ্ন হলে তাদের ব্যাপারে সংবাদ প্রকাশ, নিবন্ধ লেখা বা টেলিভিশন টকশোতে আলোচনা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অপারগতায় সম্ভব হয়ে ওঠে না, যা প্রকারান্তরে দুর্নীতি প্রতিপালনে সহায়ক হয়। 

আমাদের দেশে বর্তমানে দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে। এ দুর্নীতির কারণে আমাদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। আমরা হাতখুলে লিখতে ও মুখফুটে বলতে পারলে দুর্নীতির মাত্রা বহুলাংশে কমানো সম্ভব। দুর্নীতি কমানো গেলে আমরা অতি অল্প সময়ে জাতি হিসেবে যে একটি সম্মানজনকপর্যায়ে পৌঁছে যাবো সে ব্যাপারে কারো মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। তাই দুর্নীতি নির্মূলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক স্বার্থে আবদ্ধ না হয়ে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে সবার একাত্ম হয়ে ভূমিকা গ্রহণের কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর তাতেই নিহিত রয়েছে দেশ ও জাতির মঙ্গল।

একজন সাংবাদিক, নিবন্ধ লেখক বা কলামিস্ট এবং টকশোর আলোচক যদি হাতখুলে লিখতে আর মুখফুটে বলতে না পারেন তবে পাঠক ও দর্শক বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ এবং তথ্যসমৃদ্ধ বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধ পাঠ থেকে বঞ্চিত হবেন। অপর দিকে ঠিক তেমনি সুষ্ঠু, সুন্দর  ও নিরপেক্ষ আলোচনা উপভোগে ব্যর্থ হবেন। সব ক্ষেত্রেই লেখক, আলোচক ও পাঠকের লেখার, বলার ও জানার অপূর্ণতা থেকে যাবে যা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি অজানাকে জানার আগ্রহে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা দেবে।

ইকতেদার আহমেদ


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads