বুধবার, ১৪ মে, ২০১৪

আর কোনো তদন্ত কমিটির প্রয়োজন নেই


তদন্ত কমিটি কাকে বলে, এক কথায় এর জবাব নেই। অন্তত বাংলাদেশের মানুষ তদন্ত কমিটির যে স্বরূপ দেখেছে, সেটা কোনোভাবেই সুখকর নয়। এ বিষয়ে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে তাতে কোনো তদন্ত কমিটির শেষ কেউ দেখে যেতে পারেন না। যেকোনো ঘটনা ঘটার সাথে সাথে সরকার একটি প্রশাসনিক ও বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করার উদ্যোগ নেবেই। তা ছাড়া বিভিন্ন মহল থেকে তদন্ত কমিটি করার দাবিও তোলা হয়। তদন্ত কমিটির সরল অর্থ করা সম্ভব এভাবে একটি ঘটনা বা দুর্ঘটনা কিভাবে ঘটল, কার কারণে ঘটল, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কী দাঁড়াল, তখন করণীয় কী ও পরবর্তী করণীয় কী হতে পারে ইত্যাকার বিষয় খতিয়ে দেখে সুপারিশ করার একটি সনাতনি ব্যবস্থা। বাস্তবে তদন্ত কমিটি মানে ঘটনা ও দুর্ঘটনার পুরো বিষয়টি সরকার বা কর্তৃপক্ষের হাতের মুঠোয় নিয়ে যাওয়ার একটি কৌশলী ব্যবস্থা। এতে প্রত্যক্ষ লাভ কয়েকটি, তাৎক্ষণিক জনরোষ কমে যাবে, জনগণের দৃষ্টি ঘুরে যাবে। পুরো বিষয়টি দীর্ঘ দিনের জন্য ডিপ ফ্রিজে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে। অপরাধীরা আড়ালে থাকবে, কারো কোনো দায়দায়িত্ব চিহ্নিত হবে না। ক্ষতিগ্রস্তরা হাপিত্যেশ করে এক সময় হতাশ হয়ে নীরব হয়ে যাবে। কারো কারো কান্না ও আহাজারি আকাশ-বাতাস ভারী করবে, তাতে কারো টিকিটিও নড়বে না। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ না শোনার ভান করেই যাবে।
বাংলাদেশে পুলিশের বিরুদ্ধে তদন্তভার গ্রহণ করে পুলিশ। প্রশাসনের বিরুদ্ধে তদন্ত করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা। কখনো কখনো বলা হয় তদন্তভার দেয়া হয়েছে কোনো গোয়েন্দা সংস্থাকে। সেই পুলিশের হাতেই থাকল। পুরো ব্যাপারটিতে জনগণের চোখে ধুলো দেয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জনগণ কোনো বাদ-প্রতিবাদ করে না। ভাবে জলে বাস করে কুমিরের সাথে আর কত লড়াই করা যাবে। এ কারণে লীগ পরিবারেরশত শত চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজির কোনো জবাব নেই।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির বিষয়টি সামনে রাখুন। অনেক ন্যায্য প্রশ্নের জবাব পাবেন না। খুনি চক্র সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় না থাকলে এত তদন্ত কোনো ফল বয়ে আনে না কেন? সাতক্ষীরা, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চকরিয়া, গাজীপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ কম করে অর্ধশত বিরোধী দল-প্রভাবাধীন এলাকায় যৌথ বাহিনীর নামে যে তাণ্ডব চলল, তার কোনো জবাব খুঁজে পাবেন না। এত সন্ত্রাস, বাড়াবাড়ি ও পাখির মতো গুলি করে মানুষ মারার পরও কোনো তদন্ত কমিটি করে জনগণকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানানোর মতো সাধারণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি পালনের গরজও হলো না। এক লিমনকে নিয়ে কত দেনদরবার। লিমন বিলম্বে হলেও ন্যায়সঙ্গত আচরণ পাওয়ায় আমরা খুশি। তবে বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশনের সবেধন নীলমণি ড. মিজান তাকে নিয়েই কর্মজীবন সাঙ্গ করলেন তার কী ফলোদয় হলো সেটা সবার জানা।
বাংলাদেশে তদন্ত ও চার্জশিট একধরনের লুকোচুরির ফর্দ। এতসবের পরও সরকারের শপথ ও নৈতিকতা কেন প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকবে সেটাই এক আজব ব্যাপার। একসময় বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটির দাবি উঠত। জনগণ সম্ভবত আস্থা ও ভরসার শেষ জায়গায় নির্ভর করে সান্ত্বনা খুঁজে পেতে চাইত। ভাবত প্রশাসন ও পুলিশি হস্তক্ষেপমুক্ত থেকে বিচারবিভাগীয় তদন্ত স্বচ্ছ কিছু করবে। এখন বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি ওঠে না। এর কারণ হয়তো জনগণের আস্থার জায়গা ও ভরসার কেন্দ্রগুলোর ওপরও আর কোনো নির্ভরতা নেই। আস্থার সঙ্কটও প্রকট। এই আস্থার সঙ্কট কতটা প্রকট তার একটা প্রমাণ নিন, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অত্যাচারে প্রাণ হারানো ছাত্রের বাবা বলেছেন, তিনি বিচার চান না। এর মাহাত্ম্য বোঝার জন্য বুদ্ধিজীবী হওয়ার দরকার পড়ে না।
অতি সম্প্রতি যেসব তদন্ত কমিটির খবর জনগণ জানে তার ভাগ্য কী সেটা একটু আলোকপাত করা যায়। যুবকনিয়ে একটা তদন্ত কমিটি শেষ পর্যন্ত পিঞ্জরবন্দী হয়ে গেছে। যুবকসংশ্লিষ্টরা এখনো আহাজারি করেন দিশা খুঁজে পান না। ডেসটিনির ভাগ্যবিপর্যয় ঘটিয়ে  যে তদন্ত কমিটি করা হলো তার কোনো হদিস নেই। লাখো মানুষ তাদের ভাগ্যবিড়ম্বনার জন্য এখনো কপাল চাপড়াচ্ছে। যুবক ও ডেসটিনির পরিসম্পদ এখন কারা ভোগ করছে এমন প্রশ্ন করা যাবে, জবাব মিলবে না। শেয়ারবাজার লুণ্ঠনের পর অন্তত একটি তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিলো, কোনো পদক্ষেপ নেয়া হলো না। সরকারি হস্তক্ষেপে সরকারের অনুগত লোকদের দেয়া রিপোর্টও আলোর মুখ দেখল না। নিমতলী ট্র্যাজেডির জন্য তদন্ত কমিটির শেষ পরিণতি কেউ জানে না। হলমার্ক ও সোনালী ব্যাংক কেলেঙ্কারির জন্য যেসব তদন্ত কমিটি করা হলো তার শেষ পরিণতির খবর কেউ রাখে না। শাপলা চত্বরে হেফাজত ট্র্যাজেডির জন্য একটা তদন্তেও সরকার রাজি হলো না। রক্তাক্ত এই ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার কত খেলতামাশাই না প্রত্যক্ষ করা গেল। এক মন্ত্রী তেঁতুল তত্ত্বপ্রচারে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। অন্য মন্ত্রী দিলেন লেঙ্গুড় তোলা তত্ত্ব। তদন্তের সামান্য উদ্যোগ নিয়ে অধিকার নাকানি-চুবানি খেলো। আদিলুর রহমান শুভ্র জেলের ঘানি টানলেন। এখনো জনগণ অন্ধকারে রয়েছে। সে রাতে কী ঘটেছিল, বাতি নিভিয়ে কত রক্ত ঝরানো হয়েছিল, এত গুলি কাদের গায়ে বিঁধলÑ জনগণ কোনো জবাব পেল না। আপনারা কেউ কি জেনেছেন পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারির আসল রহস্যটা কী? কেউ কি জানতে পারবেন রেলের কালো বিড়ালের কী হলো? সবাই জানেন দেশপ্রেমিকআবুল হোসেন একদিন দৃশ্যপট থেকে সরে গেলেন। বস্তাবন্দী টাকার গন্তব্য নিয়ে চুপ থেকে সরকার অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে সুরঞ্জিত বাবুকে নিয়ে জনগণের অনুভূতিকে পুঁজি করে দাবা খেলল। রানা প্লাজার রানারা জামাই আদরে আছেন। তদন্ত কমিটি আঁতুড়ঘরে। অনেক লাশ শনাক্ত হলো না। ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষতিপূরণ পেল না। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনও শেষ পর্যন্ত দৃষ্টির আড়ালে চলে যাবে। ক্ষমতার জন্য সাত খুন মাপের পরিণতি দেখে কেউ তাজ্জব হবে না। আদালত নির্দেশ দিয়ে দিয়ে কত দূর ঠেলবেন!
তদন্ত কমিটি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটা সুখকর স্মৃতি মনে পড়ে গেল। আমরা ফজলুল হক হলের ছাত্র। প্রভোস্ট প্রফেসর মহব্বত আলী স্যার। একদিন দুপুরে খাবার মান নিয়ে ডাইনিং রুমে হট্টগোল শুরু হলো। ছাত্ররা ঘোলা পানির মতো ডালের বালতি ছুড়ে ফেলে দিলো। মরা চাল ও কঙ্করওয়ালা মোটা ভাতের গামলা উপড়ে দিলো। এক টুকরা আলু, সামান্য ঝোল আর আধা ইঞ্চি পাথরের মতো দুটুকরো গরুর গোশত দেয়া বাটিগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিলো। দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেলেন প্রভোস্ট মহোদয়। এসেই ছাত্রদের বাবারা,’ ‘সোনারা,’ বলে সম্বোধন করে আদুরে ভাষায় বললেন, তোমরা আমাকে সাহায্য করো, এুনি তদন্ত কমিটি করে দিচ্ছি, দ্রুত ব্যবস্থা নেবে। কাউকে ছাড়া হবে না। ছাত্রদের রিজিক নিয়ে ছিনিমিনি আই মাইনতান ন। উল্লেখ্য প্রভোস্ট স্যার নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত ছিলেন। আমাদের তাৎক্ষণিক জেগে ওঠা ক্ষোভ প্রশমিত হলো। তদন্ত কমিটির ভাগ্য কী হয়েছিল, জানি না। ছয় মাস পর ছাত্রজীবনের ইতি টেনে আমাদের হলজীবনের সমাপ্তি ঘটল। অবশ্য ঘটনার পরদিন ডালের পানি একটু ঘন হয়েছিল, বাকি কোনো পরিবর্তন দেখে যেতে পারিনি বলে আমাদের কোনো দুঃখও নেই। সাড়ে তিন দশকেরও বেশি বছর পর আজ হলের খাদ্যমান কী হয়েছে জানি না।
প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে কথা তুলে লাভ নেই। যে দেশে সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষা থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়, এমনকি সরকারি অফিসের পিয়ন-দারোয়ান নিয়োগ পরীক্ষা পর্যন্ত ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে হয়, সে দেশে শিক্ষামন্ত্রীর নৈতিক মান ও শিক্ষা বিভাগ নিয়ে ডুগডুগি বাজিয়ে কী লাভ! তদন্ত কমিটিরই বা দরকার কী! এরপরও কোন ধরনের লজ্জার মাথা খেয়ে এসব মন্ত্রী ছাত্রদের ও জনগণকে নীতি-নৈতিকতার সবক দেন, তা ভাবতে লজ্জাও লজ্জা পায়।
ধরুন রানা প্লাজার ঘটনা। একটি দলনিরপেক্ষ স্বাধীন ও যোগ্য তদন্ত কমিটি খতিয়ে দেখতে পারত পুরো বিষয়টি। কারা এ ভবনের ছাড়পত্র দিয়েছে, কারা মান দেখাশোনা করেছে, রানা জায়গাটা পেল কিভাবে, এটি বৈধ সম্পত্তি কি না, এর পাইলিংসহ প্রয়োজনীয় কাজগুলো কারা করেছিল, ভবন নির্মাণের আগে যেসব কাগজপত্র ও ছাড়পত্র প্রয়োজন তা নিয়েছে কি না, বিল্ডিং কোড মানার ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না। তৎকালীন বিতর্কিত, স্বঘোষিত ও মনীষীতুল্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মখার ঝাঁকুনিতত্ত্বের রহস্যটাও খতিয়ে দেখা যেত। তা ছাড়া সে দিন জোর করে কাজ করালো কারা। ফাটল নিয়েও ভবনে কর্মপরিবেশের নিশ্চয়তা এলো কোত্থেকে। রানার আড্ডায় আর কারা ছিল। স্থানীয় এমপি, থানা ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্টতা কী ছিল। উদ্ধার তৎপরতায় কোনো ঘাটতি ছিল কি না। ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমজীবীদের জন্য পাওয়া সাহায্যগুলোর তসরুফ হলো কী পরিমাণ। বিলম্বিত উদ্ধারে একজন শ্রমিকের রহস্যঘেরা অক্ষত অবস্থারও জবাব মিলত। তদন্ত মোটামুটি একটি স্বচ্ছতা উপহার দিলে বিগড়ে যাওয়া বিশ্বসম্প্রদায়ও নরম হতো। কারো কোনো সন্দেহ থাকত না।
যে রানা প্লাজার ঘটনা আমাদের পোশাক শিল্পের চেহারা উদোম করে দিলো, যে পদ্মা সেতুর কেলেঙ্কারি আমাদের বিশ্বের কাছে চোর প্রমাণে সাহায্য করল, রেলের যে কালো বিড়াল বিব্রত করল জনগণ ও সরকারকে তার যখন কোনো সমাধানে সরকার স্বচ্ছতার পরিচয় দিলো না, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের ভেতর শত শত খুন, অপহরণ ও গুমের হদিস আশা করা যাবে, তদন্ত কমিটি হবে শেষ উত্তর পাওয়া যাবে এমন ভরসা করব কিভাবে!
আজকের খুন, গুম, অপহরণ, দুঃশাসন, অস্বস্তি, জননিরাপত্তার অভাব সব কিছুই রাজনৈতিক সঙ্কটের উদর থেকে জন্ম নিয়েছে। ক্ষমতাসীনেরা যে আস্ফালন দেখাচ্ছে, যে দম্ভ ও অহমিকা তাদের পেয়ে বসেছে সবই অন্যায্যভাবে রাষ্ট্রশক্তি ও প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক ব্যবহারের খেসারত। রাষ্ট্রশক্তির অপব্যবহার, রাজনৈতিক ব্যবহার ও প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের দলান্ধ বানিয়ে ফেলার কারণেই নারায়ণগঞ্জের মতো ঘটনাগুলো ঘটছে। এটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছি এসব অপকর্ম রোগ নয়, উপসর্গ। মূল রোগ গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি, আইনের শাসনের অভাব। জনসমর্থনহীন সরকারের ক্ষমতাচর্চা। হ্যাঁ, মায়া ঠিকই বলেছেনÑ হাতি গর্তে পড়লে চামচিকাও লাথি মারে। এটাও ঠিক, মানুষের দণ্ডমুণ্ডের মালিক সেজে আল্লাহর ক্ষমতার আব্রু ধরে টান দিলে আপদ আসবেই। পাপ বাপকেও ছাড় দেয় না। সময় প্রতিকূলে যেতে শুরু করলে নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গও নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে দাঁড়িয়ে যায়।
আমরা বার বার বলে আসছি তাই তদন্ত কমিটি কোনো সমাধান নয়। কিছু লোকের চাকরিচ্যুতি কোনো সুফল বয়ে আনবে না। আদালতের নির্দেশনার মধ্যেও প্রকৃত সমাধান নেই। মন্ত্রীর পদত্যাগও ঘটনা আড়ালে চলে যাবে না। সমাধান একটাই গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করে গণতন্ত্রচর্চা ও আইনের শাসনের ধারায় ফিরে যাওয়া। এ ব্যাপারে সময়ক্ষেপণ পাপ ও প্রায়শ্চিত্তের পরিধি ও বোঝা বাড়াবে। 

মাসুদ মজুমদার


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads