সারা দেশে এমনিতেই প্রতিদিন ডজন ডজন মানুষ খুন হচ্ছে, গুম হচ্ছে আরও দু’চারজন করে। সবক্ষেত্রে গুম হওয়া নাগরিকদের কোনো হদিসই মেলে না। অজ্ঞাত স্থান থেকে পাওয়া যায় অজ্ঞাত পরিচয়ের মানুষের লাশ। প্রধানত বাংলাদেশে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম এসব লাশ দাফনের আয়োজন করে। এর বাইরে আরও কোনো সংগঠন থাকতে পারে, আমার জানা নেই। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম সংগঠনটি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিব শাসনকালে দুর্ভিক্ষের সময়। শেখ মুজিব সরকারের ভয়াবহ অপশাসন ও লুণ্ঠনের ফলে, ব্যাপক চোরাচালানের কারণে বাংলাদেশে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সূচনা হয়। প্রতিদিন রাস্তাঘাটে, বন-বাদাড়ে, এখানে-সেখানে ক্ষুধার তাড়নায় মানুষ মৃত্যুবরণ করে। তখন আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম এসব বেওয়ারিশ লাশ দাফনের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়। তারা প্রতিদিন কাগজে বিজ্ঞপ্তি দিত যে, ঐদিন তারা কত সংখ্যক বেওয়ারিশ আদম সন্তানকে দাফন করেছে। ১৯৭৪ সালের সেই ভয়াবহ মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ তৈরি হয়েছিল রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতির জন্য। ভারতের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার গবেষণায় সেটি দেখিয়েছেন। তার নোবেল পুরস্কার বিজয়ের একটি উপাদান বাংলাদেশের ১৯৭৪ সালে সংঘটিত দুর্ভিক্ষ।
১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় আঞ্জুমান কয়টি লাশ দাফন করলো সেটি প্রকাশের ক্ষেত্রে শেখ মুজিব সরকার কোনো বাধা দেয়নি। তবে যা মনে আছে তা হলো, শেখ মুজিব সরকার সংবাদপত্রের ওপর এই মর্মে নির্দেশ জারি করেছিল যে, কেউ দুর্ভিক্ষে মারা গেছে এ কথা লেখা যাবে না; বরং ঐ দুর্ভিক্ষে যারা মারা গেছে তাদের ক্ষেত্রে বলতে হবে, তারা মারা গেছে অপুষ্টিতে। এখন আর আঞ্জুমান প্রতিদিন তেমন বিবৃতি দেয় না কিংবা দিতে পারে না। আমরা সংবাদপত্রের চাকুরেরা যথারীতি অপুষ্টির আদেশ পালন করে গেছি। এখন অবশ্য আদেশও দিতে হয় না, সংবাদপত্রের মালিকরা নিজে থেকেই বুঝতে পারেন যে, কী তাদের লিখতে হবে, কী তারা লিখবেন না। কীভাবে তারা সরকারকে সন্তুষ্ট রাখবেন। মিডিয়া যে নিছক একটি বাণিজ্য নয়, এটি যে একটি বিশাল দায়িত্ব সেটি বোঝার মতো বিদ্যা-বুদ্ধি এখনকার মিডিয়ার মালিকদের ও তাদের নিয়োজিত কর্মচারীদের আছে বলে মনে হয় না। সাংবাদিকতা পেশা যে নিছক চাকরি নয়, এটি যে একটি বড় ধরনের সেবাÑ এটা তরুণদের বোঝাতে গলদঘর্ম হয়ে যাই।
বর্তমান সময়ে সাংবাদিকতার নামে যা চলছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে তা এর আগে খুব কমই দেখা গেছে। সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা সবসময় অবিচল। আদর্শগত পার্থক্য সত্ত্বেও নীতির প্রশ্নে, সাংবাদিকতার স্বাধীনতার প্রশ্নে তারা দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। এখন নেই। ফলে সংবাদপত্রগুলোকে মালিকের স্বার্থের সংঘাতে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করতে দেখি। সেটি বেদনাদায়ক। সমষ্টির স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি স্বার্থ প্রাধান্য পাচ্ছে। মালিকদের দস্যুতার অংশ হতে বাধ্য হচ্ছেন সাংবাদিকরা। হ্যাঁ, চাকরি দরকার। কিন্তু চাকরি রক্ষার জন্য সাংবাদিকরা এমন কি সত্তরের দশকেও এমন হীন কাজ করতে সম্মত ছিলেন না। সন্দেহ নেই, সাংবাদিকতা পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পেশার একটি। যারা এ পেশায় আসেন, তাদের সেটি মেনে নিয়েই আসতে হয়। এ পেশার চ্যালেঞ্জও তাই। কিন্তু কখনও কখনও এই পড়ন্ত বয়সে এ সে বেদনায় নীল হয়ে যায়। কী করছে আমার সাংবাদিক সহকর্মীরা!
পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিক যখন অপহৃত হলেন, তখন আবারও এই হলুদ বা অপসাংবাদিকতার কুৎসিত দিকটা পুনরায় দেখতে পেলাম। জনস্বার্থে পরিবেশ সংরক্ষণ আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব রিজওয়ানা তার কর্মকা-ের জন্য বিশ্বব্যাপী নন্দিত ম্যাগসাসে পুরস্কার লাভ করেছেন। বাংলাদেশে এর সংখ্যা হাতেগোণা মাত্র কয়েকজন। গোটাদেশ যখন রিজওয়ানা পরিবারের পাশে দাঁড়ালো, তখনও লক্ষ্য করলাম, দু-একটি সংবাদপত্র কী কুৎসিতভাবে রিজওয়ানার চরিত্র হননের জন্য উঠেপড়ে লেগে পড়লো। সেসব সংবাদও পড়েছি। পড়ে মনে হয়েছে, সাংবাদিকতা পেশাকে আমরা কোথায় নামিয়ে এনেছি।
গত ২৭ এপ্রিল দিনে-দুপুরে নারায়ণগঞ্জ থেকে অপহৃত হলেন সেখানকার সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাত ব্যক্তি। তার অপহরণের পরপরই নজরুল ইসলামের স্ত্রী থানায় এই মর্মে অভিযোগ দায়ের করেন যে, কাউন্সিলর নূর হোসেন এই অপহরণের এক নম্বর হোতা। কিন্তু দলীয়করণকৃত প্রশাসন, পুলিশ, আওয়ামী লীগের গডফাদারখ্যাত মনোনীত এমপি শামীম ওসমান প্রমুখের কারণে পুলিশ কেবলই বলেছে, ‘দেখছি’, ‘খুঁজছি’। কিন্তু নূর হোসেনকে আটক বা জিজ্ঞাসাবাদ কিংবা তার বাড়িতে কোনোরকম তল্লাশি চালায়নি। ২৮-২৯ তারিখ পর্যন্ত নূর হোসেন এলাকায় বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। এই অপহরণ নিয়ে ব্যাপক সামাজিক চাপের সৃষ্টি হয়। সারা দেশ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। এরপর ৩০ এপ্রিল দেখা গেল, এই সাতজনেরই লাশ ভেসে উঠেছে শীতলক্ষ্যায়। একই কায়দায়, একইভাবে এই সাতজনকে একই সময়ে খুন করে অপহরণকারীরা। তাদের হাত-পা শক্ত রশি দিয়ে বাঁধা। প্রত্যেকের ঘাড়ের স্পর্শকাতর স্থানে গুরুতর আঘাত করে তারপর নাভির নিচ থেকে পেট চিরে দিয়ে তাদের হত্যা করা হয়। এরপর সিলিকনের বস্তায় ২৪টি করে ইট ঢুকিয়ে সেলাই করে দেয়া হয়। পরে সেই বস্তা তাদের গায়ের সঙ্গে বেঁধে শীতলক্ষ্যায় ফেলে দেয়া হয়। হত্যাকারীদের পরিকল্পনা ছিল পেট ফেড়ে দিলে লাশের পেটে গ্যাস জমবে না। ফলে লাশগুলো আর কোনোদিন ভেসে উঠবে না। নজরুল ও এডভোকেট চন্দনসহ ঐসব নিহত ব্যক্তি চিরতরে গুম হয়ে যাবে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আল্লাহ তায়ালা করেন আর এক। প্রতিটি লাশই শেষ পর্যন্ত ভেসে উঠেছে।
এই গণহত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রী ও মন্ত্রি¿চ্ছু ব্যক্তিরা এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের দায় এড়িয়ে তা বিএনপির কাঁধে তুলে দেয়ার চেষ্টা করে। পহেলা মে গাজীপুরের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী সংশয় প্রকাশ করেন যে, সম্ভবত বিএনপি এই হত্যাকা- ঘটিয়েছে। রেলের বস্তা বস্তা টাকা চুরির হোতা বলে মন্ত্রিসভা থেকে বিতাড়িত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন যে, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানই এদেশে হত্যার রাজনীতি শুরু করেছেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এতটাই হৃদয়হীন ও বিবেকহীন মানুষ (?) যে, তিনি বলে বসলেন, এই সাত হত্যাকা- বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। দুর্নীতির দায়ে মন্ত্রিসভা থেকে বিতাড়িত হাছান মাহমুদ বললেন, বিএনপি এই হত্যাকা- ঘটিয়েছে। এরপর আবার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বললেন, দেশব্যাপী শোরগোল হচ্ছে বলেই খুনিদের ধরা যাচ্ছে না। শোরগোল থামলে ধরা যাবে। কেন ধরা যাচ্ছে না? তার জবাবে তিনি বললেন, নইলে খুনিরা পালিয়ে যেত না। তারা আশপাশেই থাকত আর মন্ত্রী তাদের একবারে টপ করে বেলে মাছের মতো ধরে ফেলতেন। আমি জানি না, তাকে বেওয়াকুফ বলে সম্বোধন করা যায় কিনা।
অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের চুনোপুঁটি মন্ত্রীরা পর্যন্ত এই হত্যাকা-ের দায় এড়িয়ে যেতে চাইলেন। না হয় সাতজন মানুষ খুনই হয়েছে, ১৬ কোটি লোকের দেশ। সাতজন মানুষ খুন হলে কী হয়। সেটা তো হতেই পারে। এমনই ভাব। আইনজীবীদের প্রতিবাদের দিন সেখানে গিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক। নারায়ণগঞ্জে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি দৃঢ়ভাবে বলেছেন যে, এই হত্যাকা- ঘটিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি প্রশিক্ষিত অংশ। অপহরণের ধরন, হত্যার ধরন দেখে নিশ্চিতভাবেই মনে হয়, যারা হত্যা করেছে, তারা এ ধরনের গুপ্তহত্যায় অত্যন্ত প্রশিক্ষিত ও পারদর্শী। জনসাধারণও তাই মনে করে।
এরপর জনমতের চাপে সরকার ও তার বশংবদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কমিশনার নূর হোসেনের বাসভবনে এক লোক দেখানো অভিযানের আয়োজন করে। সেখান থেকে জব্দ করা হয় রক্তমাখা কালো কাঁচে ঘেরা একটি নীল রঙের মাইক্রোবাস। গ্রেফতার করা হয় ১৬ জনকে, তা নিয়েও রহস্যের শেষ নেই। এই ১৬ জন কারা, সেটি জানাতে অস্বীকার করে পুলিশ। এর মধ্যে নূর হোসেনের কোনো স্বজন আছে কিনা, সেটিও ‘তদন্তের স্বার্থে’ জানাতে তারা অস্বীকার করে। কোনো সাংবাদিককে প্রথমে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। পরে ঢুকতে দেয়া হলেও একতলা, দোতলার কোনো কক্ষে তাদের প্রবেশ করতে দেয়নি। আর কী আলামত পাওয়া গেছে? সেটিও ‘তদন্তের স্বার্থে’ জানাতে অস্বীকার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটি বলতেই হয় যে, এই তল্লাশিও ছিল নিতান্তই লোক দেখানো। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে সাতদিন সময় নিয়েছিল, যাতে ঘাতকরা এই ভবন থেকে হত্যাকা-ের সকল আলামত ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করতে পারে। এখন তো মনে হচ্ছে ঘাতকরা তা পারেনি। আর তাই সাংবাদিকদের ভেতরে যেতে দেয়া হলো না। সময় দেয়ার আরও এক কারণ হলো, হত্যায় সহযোগীরা যাতে নির্বিঘেœ পালিয়ে যেতে পারে। এই হত্যাকা-ে নূর হোসেনের সহযোগীদের দুজন ইতোমধ্যে বিদেশে পালিয়ে গেছে। একজন সিঙ্গাপুর, অপরজন ভারতে। নজরুল ইসলামের স্ত্রী আর যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন তাদের টিকিটেরও নাগাল পওয়া যাচ্ছে না। ফলে এটা ধারণা করা সঙ্গত যে, প্রশাসন ও পুলিশ তাদের পালিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় দিয়েছে। যেহেতু সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি, তাতে মনে হয়, এখনও যে কক্ষে হত্যাকা-টি ঘটানো হয়েছে সেখানে বিপুল আলামত পড়ে আছে। সাত-সাতটা মানুষকে তুলে নিয়ে হত্যা করে নদীতে ফেলার জন্য কমপক্ষে ২০/২৫ জন লোকের দরকার হয়েছে। তার জন্য প্রয়োজন হয়েছে তিন-চারটি মাইক্রোবাসের। রক্তমাখা একটি মাইক্রোবাস পাওয়া গেল, বাকিগুলো কোথায়? এসবের কোনো সদুত্তর মিলছে না। সরকার সবকিছু গোপন করার চেষ্টা করছে।
একই কা- ঘটেছিল ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারিতে বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ সেনা কর্মকর্তা হত্যাকা-ের সময়। হত্যাকারীদের সঙ্গে আলোচনার নামে হত্যাকা- শেষে হত্যাকারীদের পালিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় দেয়া হয়েছিল। এমনও অভিযোগ আছে যে, হত্যাকারীদের কাউকে কাউকে বিমানে তুলে দিয়ে দেশ থেকে চলে যেতে দেয়া হয়েছিল। আর পুলিশের জানার বাইরে আওয়ামী লীগের ধানমন্ডির এমপি বিডিআর সদর দফতরের চারপাশের এলাকাবাসীদের বাসা খালি করে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ভয়ে-আতঙ্কে অনেক মানুষ চলেও গিয়েছিল। আর সেই সুযোগে মূল ঘাতক ও হত্যার পরিকল্পনাকারীরা নির্বিঘেœ পালিয়ে যেতে পেরেছিল।
নারায়ণগঞ্জের সাত খুন নিয়ে সরকার যা করলো, তা নিষ্ঠুর, অমানবিক ও বর্বরোচিত। এরা আল্লাহ-খোদায় বিশ্বাস করে কিনাÑ জানি না। কারণ এদের ভাষায় ‘মা দুর্গা’র আশীর্বাদে শস্যের ফলন ভালো হয়। আল্লাহ-খোদাকে না মানলে না-ও মানতে পারে। তবে যাদের দৃষ্টিতে ‘মা দুর্গা’র আশীর্বাদে শস্য ভালো হয়, তারা আর যাই হোক, মুসলমান নয়। কিন্তু এদের ভুলে গেলে চলবে না যে, ‘দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ’।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন